1590
Published on নভেম্বর 11, 2020মীর আব্দুল আলীমঃ
সময়টা বিশ্ববাসীর জন্য দুঃসময় বটে। করোনা মহামারী জনমনে ভীতি তৈরিসহ অর্থনীতিতেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। এমন সময় বাংলাদেশের মৃত্যু হার এবং অথেনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হওয়ার কথা। আমরা তাতে উদ্বিগ্নও ছিলাম। এরপরও কিছু সুখ সংবাদে আমরা সুখ পাচ্ছি; আশার আলো দেখছি।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে এমন আশাজাগানিয়া সংবাদ আমাদের আন্দোলিত করে বৈকি! পত্রিকায় কয়েক দিনের সংবাদ শিরোনাম এমন- ‘মহামারীর ৪ মাসেও রেমিটেন্স বেড়েছে ৪৩ শতাংশ’; ২. এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ; ৩. গার্মেন্টে আশার আলো; ৪. ‘রেমিটেন্স রিজার্ভের মতো রাজস্ব আদায়েও বিস্ময়’; ৫. করোনা দুঃসময়েও মেঘা প্রকল্প থেমে নেই। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে এমন সংবাদে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি আমরা।
করোনা সংকটেও দেশের এমন অগ্রগতির কারণ কী? প্রধানমন্ত্রীর দুঃসাহসী কিছু সিদ্ধান্ত অর্থনীতিতে বাজে প্রভাব থেকে মুক্ত রেখেছে বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্তে ঝুঁকি নিয়ে কারখানা খোলায় ইতিবাচক ফলও এটা। সব মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছিল যেন দেশ পূর্ণ লকডাউনে যায়। সরকারের ইচ্ছায় লকডাউনে শিথিলতা ছিল। গার্মেন্ট, কলকারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার কথা বলছিলাম আমরা। দেশে পরিবহন চালু না রাখার কথাও বলা হচ্ছিল। ভীতিকর পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব যখন লকডাউনে, তখন আমাদের গার্মেন্ট, কলকারখানা চলেছে, পরিবহনও চালু করা হয়েছে। এর সুফল এখন আমরা পাচ্ছি।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন করা এ দেশটার মানুষ আগে থেকেই দুঃসাহসী। ঝুঁকি নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে দেশে যেমন মানুষ থেমে ছিল না, যার যার কাজ করেছে, প্রবাসীরাও হাত পা গুটিয়ে বসেছিল না বলেই আজ রেমিটেন্স, রিজার্ভ, রাজস্ব আদায় বাড়ছে। দুঃসময়ে পোশাক কারখানাগুলো আশার আলো দেখাচ্ছে। বায়াররা ঝুঁকছেন বাংলাদেশের দিকে।
আমাদের সাহসিকতা, সব পরিস্থিতিতে কাজ করার ইচ্ছাশক্তি আমাদের এগিয়ে নিচ্ছে, এগিয়ে নেবে গোটা দেশকে। বাংলাদেশ এখন আর হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে বলেছিলেন- ‘দশ বছর আগের আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান’। কথাটা কিন্তু নিরেট সত্য। এ সময়ে আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, আমাদের সঙ্গতি বেড়েছে। উন্নয়নে, অর্থনীতিতে এগোচ্ছে দেশ। রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। স্বপ্নের মেট্রোরেল হচ্ছে। পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের গাঁটের টাকায়। এটা চাট্টিখানি কথা নয়।
মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে এটা আশাজাগানিয়া সংবাদ। করোনা মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে রীতিমতো ধস নামিয়েছে। অনেক দেশেরই জিডিপির প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও করোনা আঘাত হেনেছে। রফতানি আয় কমে গিয়েছিল।
রাজস্ব আদায়ের হার কমেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। চাকরি হারিয়েছে লাখো মানুষ। দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি পারবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে যেতে- সৃষ্টি হয়েছিল এমন প্রশ্ন বা সন্দেহের। তা কেটেছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এবং সরকারের যৌথ পর্যবেক্ষণে। মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা তিন সূচকেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
আশা করা যায়, ২০২৪ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাবে। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে চলেছে। অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। বিদ্যুতে দেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাথাপিছু আয় দু’হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। করোনার মধ্যেও বর্তমান অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রফতানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানি ছাড়া অন্যান্য খাতেও রফতানি বাড়ছে। বাংলাদেশের ওষুধ যাচ্ছে ১৬৬টি দেশে। প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বীকৃতিও মিলছে। লন্ডনভিত্তিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চ ভবিষ্যতের যে ১০টি উদীয়মান বাজারকে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, গার্মেন্ট ও কৃষিভিত্তিক পণ্য রফতানি করে দেশটি ক্রমেই জোরালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ব্ল–মবার্গ বলছে, বাংলাদেশ হতে পারে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখনই তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার এমন আশাবাদেরই প্রতিফলন দেখা যায় বাংলাদেশের দৃশ্যমান অগ্রগতিতে। শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতি নয়, জনস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, শিক্ষা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, নারীর উন্নয়নসহ সামাজিক নানা সূচকেও বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে চলেছে। ফলে বাংলাদেশ খুব স্বাভাবিকভাবেই এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হতে যাচ্ছে। সিডিপি ও সরকারের যৌথ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘে যে পর্যালোচনা হওয়ার কথা রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
করোনা সংকটে রাজস্ব আদায়েও বিস্ময় দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এনবিআরের তথ্য বলছে, গত বছরের স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও এ বছরের করোনাকালে সরকারের রাজস্ব বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দু’হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।
বাংলাদেশি পোশাকের অন্যতম বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম। সুইডেনভিত্তিক এ ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পোশাক কিনে থাকে। সে হিসাবে ১০ শতাংশ বাংলাদেশি পোশাকের ক্রেতা হচ্ছে এইচঅ্যান্ডএম। করোনায় কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল করেনি তারা। স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের পণ্য নেয়া শুরুর পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের কাছে কোনো মূল্য ছাড়ও চায়নি। পোশাকের ক্রয়াদেশের দাম পরিশোধের শর্তেও কোনো রকম পরিবর্তন করেনি এইচঅ্যান্ডএম।
এইচঅ্যান্ডএমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত দুই থেকে আড়াই মাসে ৫০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ দেয়া হয়েছে। এইচঅ্যান্ডএমের ৩০০ সরবরাহকারী কারখানার সবাই ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এইচঅ্যান্ডএমের ক্রয়াদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। করোনা সংকটে চীন ও তুরস্ক থেকে যেসব ক্রয়াদেশ সরছে, তার একটি অংশ বাংলাদেশে আসছে। কারণ বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম। এটাও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ।
আমাদের সবাইকে এ কথা মানতেই হবে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা। বাংলাদেশ নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখলে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আমাদের প্রত্যাশা, সবকিছু মোকাবেলা করে বাংলাদেশ যথাসময়ে উন্নত দেশের কাতারে ঠাঁই করে নিতে পারবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক