3118
Published on অক্টোবর 28, 2020ড. তানভীর আহমেদ সিডনীঃ
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর যোগ ছিল। তরুণ নেতা শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ আয়োজিত রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ বিষয়ক একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তিনি একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। এ সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য নির্বাচন। একই সঙ্গে ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কিত পশ্চিম পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়াস। সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এই সময়ে করাচিতে থাকায় তাঁর পক্ষে প্রবন্ধ পাঠ করেন মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদের নির্বাচিত অংশ হলো-
“এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি কবি নজরুল ইসলামের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্রোহী জীবন-যাত্রার এক নিখুঁত আলোচনারূপে প্রতিপন্ন হয়। প্রবন্ধের উপসংহারে বর্তমান জগতের অত্যাচার ও অবিচারের বন্যা রোধের জন্য কবির বৈপ্লবিক জীবনাদর্শ ছাত্র, যুবক ও জনগণের কতখানি প্রয়োজন আছে তাহাই অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ‘জয়বাংলা’ স্লোগান উদ্ভাবনের পেছনে যে নামটি জড়িত তা হলো কাজী নজরুল ইসলাম। ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের ৩রা বৈশাখ নবযুগ পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলাম একটি প্রবন্ধ লিখেন। এখানে বিদ্রোহী কবি রচনা করেন,
“হেথায় লক্ষ লক্ষ যোগী মুনি ঋষি তপস্বীর পীঠস্থান, সমাধি, সহস্র সহস্র ফকির-দরবেশ ওলী-গাজীর দর্গা পরম পবিত্র। হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে সঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনি। এখানে যে শাসনকর্তা হয়ে এসেছে সেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলায় আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতা মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি।”
প্রবন্ধের শেষে নজরুলের ভাষ্যই যেন ‘জয়বাংলা’ শেকড়। যেখানে স্বাধীনতা ও দ্রোহের কবি রচনা করেন, “বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।” ‘বাংলার জয় হোক’ আর ‘জয়বাংলা’ অর্থগত দিকে থেকে একই অর্থ প্রকাশ করে। এতে ধর্মীয় চেতনা নেই। নজরুল এই জাতীয় চেতনাকে ধারণ করেছেন। একই সঙ্গে রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবও একই চেতনার প্রচারক ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। নজরুল তাঁর ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায় ‘জয়বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাই বলা যায় ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের সঙ্গে নজরুলের নাম যুক্ত ছিল।
যুক্তফ্রণ্টের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান দেখা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। বাঙালির কবি তখন কলকাতায় মন্মথ রোডে থাকতেন। টালা পার্কের পাশের এই দোতালায় প্রথম দুই মহান বাঙালির সাক্ষাৎ হয়। শেখ মুজিব প্রিয় কবির সঙ্গে দেখা করার সময় উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন, একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ও সন্দেশের একটি প্যাকেট। নজরুল তখন বিশ্রাম করছিলেন। শেখ মুজিবকে দেখেই উঠে বসলেন। প্রিয় কবিকে সালাম জানিয়ে শ্রদ্ধাসহ তাঁর হাতে রজনীগন্ধা তুলে দেন। কবি তা গ্রহণ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার অল্প দিনের মধ্যেই প্রিয় কবিকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। তিনি তো জানতেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুল ছিলেন অবিরাম প্রেরণার উৎস। তাঁর লেখনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উজ্জীবিত করেছে। তাই বাঙালির জয়ে কবির জন্ম উৎসব দেশে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করেন। ‘হে কবি’ সম্বোধন করে নজরুল ও তার পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লিখেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কের প্রতিনিধি হিসেবে পত্র নিয়ে যান তৎকালীন মন্ত্রী মতিউর রহমান ও রাজনৈতিক নেতা মুস্তাফা সারওয়ার। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। কালকাতার স্থানীয় রাজনীতিবিদদের একাংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। কবি নজরুলের ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে কবিকে ফিরিয়ে আনেন।
বাংলাদেশে নিয়ে আসার পর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় কবিভবন-এ। উল্লেখ্য ধানমন্ডিতে নজরুলের জন্য এই বিশেষ বাড়িটিও রাষ্ট্রীয়ভাবে দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির খুব কাছেই ছিল নজরুলের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়িটি। এই বাড়িটি পছন্দ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। ২৪শে মে নজরুল পা রাখলেন খোলামেলা এই বাড়িতে, সবুজ ঘাসের আঙ্গিনা কবিকে মনে করিয়ে দেবে বাংলাদেশে আছেন তিনি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর ভবনে এলেন। তাঁর হাতে বিশাল ফুলের ডালি। এ সময়ের স্মৃতিচারণে কবির নাতনী খিলখিল কাজী লিখেন,
“[...] এর কিছুক্ষণের মধ্যে সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু হাসি মুখে দাদুকে শ্রদ্ধা জানাতে এলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বাবা ও চাচা শ্রদ্ধাভরে দাদুর কাছে নিয়ে গেলেন। [...] তাঁকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন দাদুর প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধাবোধ ও অফুরন্ত ভালোবাসা।”
কবিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে পরিবারের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই কবির বাড়ি নির্ধারণের পর কবি পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। জন্মদিনের আগের দিনে দেশে এলেন বাংলার কবি, বাঙালির কবি নজরুল।
কাজী নজরুল ইসলামের ৭৩তম জন্মদিবস উপলক্ষে নজরুল একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাণী দিয়েছিলেন তার সংক্ষিপ্ত নিম্নরূপ-
“বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। বাঙলার শেষ রাতের ঘনান্ধকারে নিশীথ নিশ্চিন্ত নিদ্রায় বিপ্লবের রক্তলীলার মধ্যে বাংলার তরুণরা শুনেছে রুদ্র বিধাতার অট্টহাসি কালভৈরবের ভয়াল গর্জন নজরুলের জীবনে, কাব্যে সংগীতে, নজরুলের কণ্ঠে। প্রচণ্ড সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মত, লেলিহান অগ্নিশিখার মত, পরাধীন জাতির তিমির ঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়ে ছিলেন এই ধরার ধূলায়।
সাহিত্যে সম্মানের সুউচ্চ শিখরে নজরুলকে পথ করে উঠতে হয়নি, পথ তাকে হাত ধরে ঊর্ধ্বে তুলেছে। মহা অভ্যাগতের মত তাঁর আগমন নন্দিত হয়েছে। সে এসেছে ঝড়ের মাতম তুলে বিজয়ীর বেশে।
..সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নি-মন্ত্র বাঙালি জাতির চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণা, আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সংকল্প।
শুধু বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ক্ষেত্রেই নয়, শান্তি ও প্রেমের নিকুঞ্জেও কবি বাংলার অমৃতকণ্ঠ বুলবুল। দুঃখের বিষয়, বাংলা ভাষার এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্পর্কে তেমন কোন আলোচনাই হলো না। বাংলার নিভৃত অঞ্চলে কবির বিস্মৃত-প্রায় যে-সব অমূল্য রত্ন ছড়িয়ে আছে তার পুনরুদ্ধারে যে কোন প্রচেষ্টাই প্রশংসার যোগ্য।
..শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে তাঁর অনন্য সৃষ্টি আর জীবন্ত অবস্থায় পাথরের মূর্তির মত সকলের কৃপাপ্রার্থী ও অসহায় বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সঙ্গীতকার।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রিয় কবির জন্য এক হাজার টাকা মাসিক ভাতা মঞ্জুর করেন। তাঁর সরকারের সময়ে সাহিত্যে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুল ইসলামকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। নজরুলকে ভারতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ ছিল। বঙ্গবন্ধু চাইছিলেন নজরুল যেন বাংলাদেশে থাকেন। তাই তিনি এ বিষয়ে কবি পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন যে, কবি যেন বাংলাদেশেই থাকেন। কেননা বাড়িটি খোলামেলা, নজরুল এখানে সুস্থবোধ করছেন। নজরুলের পুত্রবধুর কাছ থেকে সমর্থন পেয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যখনই নজরুলের বাড়িতে যেতেন তখন বাড়ির পরিচ্ছন্নতা, খাবার আর চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবি ভবনে আসা প্রসঙ্গে নজরুলের নাতনী খিলখিল কাজী রচনা করেন,
“তিনি প্রায়ই দাদুকে দেখতে চলে আসতেন ধানমণ্ডির ‘কবিভবনে’। মাকে খুব স্নেহ করতেন, মাকে নাম ধরে ডাকতেন উমা বলে। মায়ের কাছে খোঁজখবর নিতেন-দাদুর স্বাস্থ্য, খাওয়া-দাওয়া। সব বিষয়ে তার নজর ছিল প্রখর। এতো সুন্দর বাগানওয়ালা বাড়ি পেয়ে দাদুও খুব খুশিতে বিভোর থাকতেন। আমাদের-ছোটদের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু কথা বলতেন ‘কেমন লাগছে এই দেশে? এখানে থেকে যাবা-আর যাবা না ভারতে।’ যখন তিনি আসতেন দাদুকে দেখতে আমরা তাঁকে ঘিরে থাকতাম। মাঝে মাঝে আমরা, মা, বাপি সবাই মিলে বঙ্গবন্ধু ও দাদুর সামনে গান গাইতাম, তিনিও মাঝে মাঝে গলা মেলাতেন। তাঁর আগমনে আমাদের বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। তিনি সবসময় আমাদের পরিবারের একজন অভিভাবকের মতন ছিলেন। মায়ের সাথে দাদুর সবরকম আলোচনা করতেন। তাঁর ব্যবহার কোনোদিন রাজনৈতিক গণ্ডির মধ্যে পাইনি, অসামান্য আন্তরিকতা ছিল তাঁর ব্যবহারে।”
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে নজরুলের গানকে রণসঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা দেন। নজরুল আর বাংলাদেশকে এমনি করে একীভূত করেছিলেন বাঙালির মহানায়ক। অসুস্থ কবির খোঁজ খবর নেয়ার পাশাপাশি তাঁর নির্দেশে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে কবির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু তখনি তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য নির্দেশ দেন। ২২শে জুলাই কবিকে ভর্তি করা হয় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। ১১৭ নং কেবিনে কবির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এর এক মাস পর খুনীরা হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। আর কবিও ফিরে যেতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর উপহার দেওয়া বাড়িতে। হাসপাতালে একবছরেও অধিক সময় চিকিৎসা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন কবি কাজী নজরুল, সেটাও আগস্টে। বাঙালির শোকের মাসে আরও একজন বাঙালিকে হারালাম আমরা।
আজ যারা রাজনীতির পথে হাটবেন, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, তাঁদের জন্য এ এক শিক্ষা যে, শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে যোগ থাকতে হবে। তা না হলে গণমানুষের জীবন ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করা যায় না। সারাসময় রাজনীতি করা মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের শিল্পসাহিত্যের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।
লেখকঃ প্রভাষক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ