2698
Published on অক্টোবর 25, 2020অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাবঃ
সম্প্রতি বাংলাদেশের জিডিপি নিয়ে আইএমএফের রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আবারও আলোচনায় বাংলাদেশ। যতটা না নিজের মিডিয়ায়, তার চেয়ে বেশি ভারতের। ভারতের মিডিয়ায় লেখালেখি শুরু হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে দেশের কিছু কিছু গণমাধ্যম, সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও। আইএমএফের রিপোর্টটি বহুল আলোচিত এবং ঘটনাবহুল আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় এখন পুরাতনও বলা চলে। যে ভারতের জিডিপি আজ থেকে মাত্র পাঁচ বছর আগেও আমাদের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি ছিল, এখন সেই ভারতকেই জিডিপিতে টক্কর দিচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফ বলছে আগামী বছর জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাব আমরা। ভারত আমাদের পেছনে ফেলবে ২০২২ সালে। তবে ২০২৪ সালে আবারও সমান সমান হবে দুই দেশের জিডিপি। কিন্তু তখন পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশ।
এই কোভিড প্যান্ডেমিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির এহেন গতি-প্রকৃতি অবশ্য বোদ্ধাদের বোধের বাইরে ছিল। গার্মেন্টস সেক্টরে ধসের আশঙ্কা করেছিল পাশ্চাত্য মিডিয়া। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই রকম শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন দেশের গার্মেন্টস শিল্পের কর্ত্রীও। বৃথা গেছে নামজাদা একটা দেশী থিংক ট্যাঙ্কের ভবিষ্যদ্বাণীও। বলা হয়েছিল এ বছর জিডিপি কমে দাঁড়াবে ২.৫ শতাংশে, যা গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আশঙ্কা করা হয়েছিল বেকার হবে কোটি মানুষ। আর বেকার হয়ে দেশের ফিরবে আরও প্রায় এক কোটি প্রবাসী। কার্যত এসবের কিছুই হয়নি। তবে এসব নিয়ে চর্বিত চর্বণও আমার উদ্দেশ্য নয়।
আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণীটি প্রকাশিত হবার পরপরই তা লুফে নিয়েছে ভারতীয় মিডিয়া এবং সঙ্গত কারণেই বিশেষ করে ভারতীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের প্রতি সংবেদনশীল মিডিয়াগুলো। না নেয়ার অবশ্য কোন কারণও নেই। সরকারকে এক হাত দেখে নেয়ার এই সুবর্ণ সুযোগটি তারা হাত ছাড়া করতে চাইবে কোন দুঃখে? এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে খোঁচা দিয়ে টুইট করেছেন ভারতীয় বিরোধী রাজনীতির প্রধান ব্যক্তিত্ব রাহুল গান্ধীও। তাই ইদানীং বাংলাদেশ নিয়ে সরগরম ভারতীয় ইলেক্ট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়া। লক্ষণীয় এ নিয়ে আজকাল বেশ সরব এদেশের কিছু চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী ও গুটিকয় মিডিয়াও। বিশেষ করে পাকিস্তানপন্থী কিছু আঞ্চলিক মিডিয়া। আর অবশ্যই এদেশের বিএনপি। কারণ বিষয়টি তাদের কাছে ডুবন্ত মানুষের কাছে সহসা খড়কুটোসম। বিষয়টি নিয়ে এই বিশেষ গোষ্ঠীর লেখা আর বলার পেছনে বাংলাদেশ প্রেম বা বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করার বিষয় রয়েছে, এমন মনে করলে অবশ্য বড় ধরনের ভুল হবে। একটু পরেই আসছি সে প্রসঙ্গে।
কাছাকাছি সময়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য আরও দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে। মার্কিন উপ-বিদেশ মন্ত্রী স্টিভেন রিগেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘনঘটার মধ্যেই সহসা দুদিনের জন্য বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। করোনাকালে দেশে এমন উচ্চপর্যায়ের একজন মার্কিন কর্মকর্তার সফর বিশেষ ইঙ্গিতবহ। সফরকালে নানা কথা বলেছেন রিগেন। জানিয়েছেন মার্কিন ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পেতে যাচ্ছে। মার্কিন প্রশাসন সহসাই বঙ্গবন্ধুর দ-িত খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে পারে, এমন ইঙ্গিতও ছিল তার বক্তব্যে। মিডিয়াই জানাচ্ছে, শত চেষ্টায়ও রিগানের সাক্ষাত পাননি বিএনপি নেতৃত্ব। ‘আগুন সন্ত্রাসী সংগঠনের’ সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে মার্কিন প্রশাসনের অনীহাটা এতে স্পষ্ট।
আমার অবশ্য দারুণ লেগেছে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রিগানের ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতে ৩২’এ সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ যে মার্কিন প্রশাসনের অগোচরে ঘটেনি তা এখন দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। সেই মার্কিন মুলুকে নির্বাচনী দামামার মধ্যেই রিগানের বাংলাদেশ সফর, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্বের স্বীকৃতি মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে দুই মোড়লের যে শীতল যুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই পৃথিবী চলে গিয়েছিল এক মোড়লের কর্তৃত্বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ছিল ইউরোপের ন্যাটো আর এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল আর দক্ষিণ আমেরিকায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট গঠনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চার দিক থেকে টুঁটি চেপে ধরা। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উল্টোপথে চলা শুরু হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঢোকার পর থেকে। এখন মার্কিন নীতি ‘আমেরিকা ফাস্ট’। ইউরোপে রাশিয়াকে মোটামোটি খেলার জন্য খোলা মাঠই ছেড়ে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ব্যতিক্রম একটা জায়গাতেই আর তা হলো চীন। আর এর কারণটাও স্পষ্ট। ট্রাম্পের আমেরিকা ফাস্ট নীতির সুবিধা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি রাশিয়া, করেছে চীন। দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের ধান্ধাবাজি আর তাইওয়ানের প্রতি কুদৃষ্টি ভালভাবে দেখছে না আমেরিকা। আমেরিকা তো বটেই, এমনকি এ অঞ্চলে তাদের ঘনিষ্ঠতম মিত্র জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়াও। চীন ঠেকাতে অস্ট্রেলিয়া, জাপান আর ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উদ্যোগ তাই কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ, সংক্ষেপে ‘কোয়াড্র’। উদ্যোগটি এখনও ঘরোয়া আলোচনায় সীমিত ঠিকই, তবে কোয়াড্রর বড্ড প্রয়োজন বাংলাদেশকে পাশে পাওয়া। রিগানের সফর শেষ হতে না হতেই যার বাড়তি প্রমাণ রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা সংগ্রহে বিশেষ সম্মেলনটি। শুরুতে এর নাম ছিল ‘দাতা সম্মেলন’। বাংলাদেশর আপত্তিতে দাদারা দাতা থেকে সম্মেলনটির নামকরণ করেছেন ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য টেকসই সহায়তা সম্মেলন’। এতে আশ্বাস পাওয়া গেছে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বাড়তি সহায়তার। সম্মেলনে বাংলাদেশ সাফ জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতেই হবে। আর কুতুপালং আর বালুখালীতে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো অবশ্যই ঘিরে দেয়া হবে কাটা তারের বেড়ায়।
সম্মেলনটি শেষ হওয়ার একদিন পরেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিসিভ করেছেন তার চীনা কাউন্টারপার্টের ফোন। চীনা পররাষ্ট্রকর্তা আমাদের মন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন, কোভিড শেষ হলেই মিয়ানমার নাকি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেবে। তিনি মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে এমনটাই জেনেছেন। বিষয়টা অনেকটা ‘গাছে কাঁঠাল, গোফে তেল’ টাইপের হয়ে গেলেও, যে চীনের ভেটোতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দফায় দফায় ভেস্তে গেছে আমাদের যত রোহিঙ্গা উদ্যোগ, সেই চীনের কাছ থেকে এমন তড়িঘড়ি প্রতিশ্রুতিও আমাদের নিয়ে আন্তর্জাকিত আগ্রহের আরেকটি নমুনা নিশ্চই। যথারীতি ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর এবার চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীও জানিয়েছেন চীনা করোনা ভ্যাকসিন পাওয়ার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকছে বাংলাদেশ।
‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশের’ এই যে এত সব বহুমাত্রিক অর্জন আর দেশটাকে নিয়ে এই যে এত নানা কেন্দ্রিক টানাপোড়েন, এই বিষয়টি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ বলাটা আমার অবশ্য ইচ্ছাকৃত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ আজকের এই জায়গাটায়। ’৭৫-এর পর যে দেশে ইতিহাস ছিল শুধুই পেছনে ছোটার, হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ বাংলাদেশকে রিগানের আজকের বাংলাদেশ বানানোর শত ভাগ কৃতিত্ব একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই। হয়ত একশ’র উপরেও দুএক শতাংশ বেশি হতে পারে, কিন্তু কম হবে না। কাজেই এই বাংলাদেশ তো শেখ হাসিনার বাংলাদেশই।
লেখার এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণী কেন্দ্রিক স্থানীয় এবং আঞ্চলিক একটি গোষ্ঠীর লম্ফঝম্ফ প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। এই চক্রটি বাংলাদেশ নিয়ে আদৌ ভাবে না। তাদের ভাবনায় সারাদিন শুধু কিভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে একটু খাদ ঢুকিয়ে দেয়া যায়। তাদের লেখাগুলো পড়ে আর বলাগুলো শুনে মনে হতেই পারে যে আগামী বছর জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়াটা বোধকরি আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমরা যেমন ভারতীয় মিডিয়ার ব্যাপারটা বুঝি, এরা আমাদের বোকা ভাবলেও, আমরা কিন্তু এদের ব্যাপারটা ঠিকই বুঝি। আমার কাছে বরং মনে হয় আমাদের প্রতিযোগিতার জায়গাটা আমাদের সঙ্গেই আর সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার বিবেচনায় আইএমএফের এই ভবিষ্যদ্বাণীটি আমাদের আরও বহু কিছু অর্জনের মাঝে আরেকটি অর্জন মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।
আমাদের তো ছাড়িয়ে যেতে হবে আমাদেরই। আমাদের ভাল ভাল সব অর্জনগুলো অটুট রেখে এগুতে হবে সামনের দিকে। পদ্মা সেতুর যখন প্রায় পুরোটাই দৃশ্যমান, তখন তো আমাদের পরিকল্পনা শুরু করতে হবে পদ্মায় দ্বিতীয় সেতুটা কবে হবে এবং কোথায়? ঘরের সামনে মেট্রো রেলের কাজ যখন দ্রুতলয়ে এগিয়ে চলেছে, আমাদের চায়ের কাপে তো তখন ধোয়া ওঠা উচিত রেলটির সপ্তম কিংবা অষ্টম লাইনগুলো কখন, কোন দিক দিয়ে যাবে। আমাদের তো দুরবিন চোখে মহাশূন্যে খুঁজতে থাকা উচিত বঙ্গবন্ধু সেটেলাইট-২ এবং ৩। ভিন দেশের কোন মিডিয়া তার সরকারকে ঘায়েল করতে কখন কোন নিউজ নিয়ে মাতামাতি করল তা নিয়ে বগল না বাজিয়ে, আমাদের তো উচিত যে চিকিৎসকরা জীবন দিয়ে জীবন বাঁচাল, তাদের পেশার অপমানে প্রতিবাদমুখর হওয়া। ধর্ষিতা পূর্ণিমাকে যারা এখন সপরিবারে সামাজিক মিডিয়ায় ধর্ষণ করছে, তারা যদি আমাদের লাইক আর কমেন্ট পায়, তাহলে আমাদের কিসের অর্জন, কিসের কি? আমরা যেদিন দেখব এসব অসুরের দোসররা আমাদের অর্জনগুলোকে আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে সিঁদকাটার সুযোগ হিসেবে আর ব্যবহার করতে পারছে না,কোন পূর্ণিমা অপমানিত হচ্ছে না, সেদিন আমরা জিতব। আর সেই জিত আমাদের শেখ হাসিনার বাংলাদেশেই জিততে হবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ