4131
Published on অক্টোবর 19, 2020ড. মীর মেহবুব আলম নাহিদঃ
আমাদের পরিচয় বাঙালি সংস্কৃতিতে, আর মুক্তিযুদ্ধ তার শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমরা ঋণী তাঁদের কাছে, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করে আমাদেরকে মুক্ত আকাশ দেখবার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর চলমান। এখনও এ দেশে ঘাপটি মেরে থাকা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রামরত। এ সংগ্রাম সফল করবার জন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী একঝাঁক টগবগে তরুণ। তারাই হয়ে উঠবেন আওয়ামী মূল্যবোধ আশ্রিত একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের গৌরবের অংশ এবং এর সাথে জড়িত জাতির হাজারো বীরগাঁথা আর শোকস্মৃতি। শোকগাঁথা হিসেবে এতে জড়িত টুকরো টুকরো দুঃখবোধ, মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, স্ত্রীর সম্ভ্রম, বোনের খন্ডিত দেহ প্রভৃতি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির জনকের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই আহবান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, মাতৃভূমি রক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছি, তাঁর নেতৃত্বে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু এ মহাবিশ্বের ‘বিষ্ময় পুরুষ’।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শর্ত ছিলো স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয় আশা-আকাঙ্খার ভিত্তি স্থাপিত হলেও সর্বস্তরে এবং সর্বমনে এর আশানুরূপ বিকাশ ঘটেছে কিনা সে প্রশ্ন থেকে যায়। স্বাধীনতার পরও প্রতিনিয়ত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সাথে চলছে অদৃশ্য লড়াই।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিলো শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থায় পৌঁছবার বহমান প্রক্রিয়ার একটি অংশ। এ প্রক্রিয়ায় ভুলত্রুটি এড়াতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন প্রয়োজন। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা বিরোধী চিহ্নিত শত্রু স্বৈরাচারী সরকারের ছত্রছায়ায় ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত থেকেছে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের উপর হামলা চালিয়েছে, অপপ্রচার করেছে। ১৯৭৫-এ রাজনৈতিক পট বদলের পর স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় সংস্কৃতির ওপর এই আক্রমণ সুচিন্তিত নীল নকশা বলে চিহ্নিত।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব কাজ করেছে, ধর্মবিরোধিতা বা নাস্তিকতা কাজ করেনি। সমাজের সর্বস্তরে যখন অসততার ছড়াছড়ি, তখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী কর্মীগণ সকল অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রচন্ড সাহস নিয়ে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করা পর্যন্ত নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন। তাই প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংহত করে নতুন প্রজন্মের কর্মী প্রস্তুত করে মূল লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।
মৌলবাদী স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বিরুদ্ধে অপপ্রচার করবে এটা যেমন স্বাভাবিক, তার চেয়েও স্বাভাবিক হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর নানা অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা যেকোনো মূল্যে এই ঔদ্ধত্বকে প্রতিহত করবে। আমাদের কর্মীরা কখনোই শত্রুর সাথে আপোষ করেননি এবং ভবিষ্যতেও করবেন না এটা অহংকার করেই বলা যায়। কর্মীরা সবসময় সাহস আর প্রত্যয় নিয়ে সত্য কথা বলেছেন এবং বরাবরের মতোই তাঁরা ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ মানুষের সামনে উন্মোচনে বিরত থাকবেন না। ধর্মের মুখোশ পড়ে যারা এ দেশের সহজ সরল মানুষকে বিভিন্নভাবে প্রতারণা করেছে কিংবা করবে, তাদের মুখ থেকে মুখোশ সরিয়ে দেবার চেষ্টা কখনোই ধর্মের বিরোধিতা করা নয়।
প্রসঙ্গত বলা জরুরি যে, ব্যক্তি ও রাষ্ট্র এ দু’য়ের পারস্পরিক চালিকাশক্তি রূপে ‘শিক্ষা’ পরিগণিত। শিক্ষা গ্রহণে ব্যক্তি নিজেও আলোকিত হয় এবং জীবন ও জগত সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। তার মধ্যে উৎসারিত মানবীয় গুণাবলী ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর চিন্তা জাগরুক হয়।
শিক্ষার গুণগত মান বিবেচনায় একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভরশীল। শিক্ষার চরম নীতি, ব্যক্তির মধ্যে যেসব ক্ষমতা সুপ্তভাবে আছে সেগুলোর বিকাশ সাধন। কিন্তু এর উদ্দেশ্য নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন শিক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য ‘ব্যক্তি’, আবার কেউ বলেন ‘সমাজ’। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যক্তির ক্রমোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করে এবং বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির পরিবর্তে কর্মঠ নাগরিক তৈরি করে। শুধু পাঠ মুখস্থ করা ও পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনেও শিক্ষায় অপূর্ণতা থেকে যায় এবং ‘জীবনের’ বিশাল দিকটি অনাবিষ্কৃত থাকে। ছাত্রদের চেতনাবৃদ্ধি করা এবং মূল্যবোধের পুননির্মাণ হবে শিক্ষার মূল কাজ, পরীক্ষাগ্রহণ বা সার্টিফিকেট প্রদান নয়। শিক্ষা গ্রহণ করে তারা আত্মবিশ্বাসী হবে, সমাজের অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গে সমপর্যায়ে চলাফেরার উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে এবং সুনাগরিক হিসেবে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করবে।
জীবনের প্রথম কটি বছর শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা তার জীবনের প্রথম চার বছরে তার পরিবার এবং আশপাশ থেকে যা শেখে পরবর্তী বারো বছরেও তা শিখতে পারে না। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পারিবারিক পরিমণ্ডলই তার শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান; স্কুলে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার যে সময়টুকু তার গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। এই পারিবারিক শিক্ষা পরবর্তী একজন মানুষের শিক্ষাজীবন-কর্মজীবন এক অর্থে সারাজীবন প্রভাব ফেলে।
একজন মানুষকে পরিবারের গণ্ডি ছেড়ে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়, এর নিয়মনীতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। তার প্রথম সোপান ‘স্কুল’। স্কুলের নির্দিষ্ট আইন কানুনকে মেনে চলতে শেখার মাধ্যমে শিশু বৃহত্তর সমাজের নিয়ম নীতিকেই শ্রদ্ধা করতে শিখে, মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে শুরু করে, তার মধ্যে নৈতিকতা, চরিত্র ও বৃহৎ অর্থে মূল্যবোধ সম্পর্কে দৃঢ় ধারণা পুঞ্জীভূত হয়। এভাবেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা শিক্ষায়তনের শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর সাফল্য ও ব্যর্থতার ভিত্তি নির্মাণ করে।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় শিক্ষা দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হওয়া উচিত; যেখানে জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সুর এবং ছন্দ তৈরি হবে। শিক্ষা বিষয়টি শ্রেণিকক্ষ নামক খাঁচাবন্দি বিষয়বস্তু হয়ে থাকবে না। তাঁর শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘সম্পূর্ণ মানুষ’, ‘শাশ্বত মানুষ’ এবং ‘সার্বজনীন মানুষ’-- একের মাঝে সকল সত্ত্বার উপস্থিতির উপলব্ধি সম্পন্ন মানুষ। শিশুরা যখন অধিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়, তখন তারা আরো স্বাধীনতা লাভ করে। এভাবে তারা পরিপক্ক হয়ে বেড়ে ওঠে এবং ভালো সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। এটাই জীবন। এটাই এই পদ্ধতির অগ্রগতির পথনির্দেশ। আমাদের ঘরে ঘরে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে একনিষ্ঠ, মূল্যবোধ সম্পন্ন, সাদা মনের রাজনৈতিক কর্মী প্রয়োজন। যে যুবা আপনার রাজনৈতিক ছায়াতলে দীক্ষা নেবার জন্য উপস্থিত, তার পরিবারের পুরনো ইতিহাস একটু ভালো করে দেখে নেয়াই সমীচিন। নয়তো যে কেউ মুখোশ পড়ে আপনার সাজানো বাগান তছনছ করে দেবে। যার দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিককালে বারবার ঘটে যাচ্ছে।
কীভাবে সম্ভব? এককথায় ‘প্রেরণা’। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘একাত্তরের চিঠি’ বইটি তার প্রমাণ। চিঠিগুলো পড়লে দেখা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ দেশমাতৃকার টানে কেবল নিজের প্রেরণায় যুদ্ধে ঝাঁপ দিয়েছেন। এরকম দু’টি চিঠির উদ্ধৃতি তুলে ধরবার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। প্রথমটি ‘যেভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে আমাদের বেঁচে থাকাটাই লজ্জার। আপনাদের দোয়ার জোরে হয়তো মরব না। কিন্তু মরলে গৌরবের মৃত্যুই হতো। ঘরে শুয়ে শুয়ে মরার মানে হয় কি?’ আর দ্বিতীয়টি ‘মাগো, তুমি যখন এ পত্র পাবে, আমি তখন তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে থাকব। মা, জানি তুমি আমাকে যেতে দিবে না, তাই তোমাকে না বলে চলে যাচ্ছি। তবে যেদিন মা-বোনের ইজ্জতের প্রতিশোধ এবং এই মাতৃভৃমি সোনার বাংলাকে শত্রুমুক্ত করতে পারব, সেদিন তোমার ছেলে তোমার কোলে ফিরে আসবে।’ তাই আমাদের অন্বেষণ হোক বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী প্রতিশ্রুত তরুণ, আওয়ামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যে অবিচল-অনঢ়।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়