রাসেল কি দোষ করেছিল?

2470

Published on অক্টোবর 16, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক ডাঃ দীন মোহাম্মদ নূরুল হকঃ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিনশ্বর, চিরঞ্জীব। একটি জাতি ও রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও মহান স্থপতি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার সিংহ পুরুষ আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিস্মরণীয় ডাক দেন। স্বাধীনতার সেই অমর বাণী তাঁর মুখে উচ্চারিত হওয়ার ফলে কোটি বাঙালি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

আবার ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেও জাতির পিতার কণ্ঠে বাঙালি জাতি শুনেছিল স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা। যার নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলো সেই বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান কারাগার থেকে সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে আসা না পর্যন্ত বীর বাঙালির কাছে স্বাধীনতা অসুম্পূর্ণই হয়ে রইল। পাকিস্তান কারাগার থেকে জাতির পিতা বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু পা রাখলেন। সারাদেশের মানুষের মনে সেকি আনন্দ। মনে হলো বাংলাদেশের মানুষ এই প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করল।

জাতির পিতা দেশের মানুষকে অনেক বেশি ভালবাসতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশের মানুষ অন্তত তাঁকে কোনদিন ভুল বুঝবেনা এবং অকৃতজ্ঞ হবে না। আর তাই রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও মানুষের ভালবাসায় সিক্ত জাতির পিতা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে একটি অরক্ষিত সাধারণ বাড়িতেই থাকতেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসররা পরাজয়ের জ্বালা ভুলতে পারেনি। তাদের চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র কখনো থেমে থাকেনি। স্বাধীনতার সূতিকাগার বা কেন্দ্রবিন্দু বলে খ্যাত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাড়িতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোর রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম, ঘৃণ্য, নারকীয় এক পৈশাচিক হত্যাকান্ড চালিয়ে হত্যা করা হয় জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের।

বাড়ির ভিতর নির্বিচারে যখন হত্যাকান্ড চলছিল তখন অবুঝ শিশু রাসেল বাঁচার জন্য নিচে এসে আব্দুর রহমান রমার হাত ধরে কাঁপতে ছিল। অসহায় রাসেল প্রথমে রমা পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল "ভাইয়া আমাকে ওরা মেরে ফেলবে না তো?" মহিতুল তখন বলেছিল "না ভাইয়া ওরা তোমাকে মারবে না।" ঐ কথা শুনার পর রাসেল মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। বাড়ির বাইরে পাঠানোর কথা বলে যে সৈনিকটি রমার হাত থেকে রাসেলকে নিয়ে গিয়েছিল সেই সৈনিককে রাসেল - তাকে না মারার জন্য আল্লাহর দোহাই দিয়েছিল।

রাসেলের হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে কোন এক সৈনিক রাসেলকে সেন্ট্রি বক্সের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিল। তখন হয়তো বেঁচে থাকার ক্ষীণ একটি আশা নিষ্পাপ রাসেলের মনে জেগে উঠেছিল। একজন খুনি মেজর লুকানো অবস্থায় দুঃখাভিভূত রাসেলকে ধরে ফেলে। তখন রাসেল কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে যাবার কথা আবারো বলতে ছিল। "চলো তোমাকে মার কাছে নিয়ে যাচ্ছি" বলে ঘাতক তাকে মিথ্যা আশ্বাসও দিয়েছিল।

একজন শিশু সন্তানের কাছে মা তো হলো তার পৃথিবী, বিশাল যার পরিধি। শিশু সন্তানের কাছে মা তো হচ্ছে মমতায় ভরা ক্ষমতার উৎস। শিশুর চোখে মা হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সব শিশুরাই মনে করে মা এক অজানা শক্তির উৎস এবং মায়ের শক্তির কাছে কোন অপশক্তিই কোনদিন টিকতে পারে না। অবুঝ শিশু রাসেলও কি সেদিন প্রাণনাশের হুমকির মুখে বেঁচে থাকার শেষ ভরসা হিসাবে - "বাবা রাসেল, আয় আমার বুকে আয় বাবা, কেউ তোকে কিছুই করতে পারবে না, তোর কোন ভয় নেই" - মায়ের মায়াভরা মুখের আদরের এই ডাকটিই শুনতে চেয়েছিল?

মৃত্যু আতংকে দিশেহারা শিশু রাসেল কি সেদিন মহিতুল ইসলামের "না ভাইয়া ওরা তোমাকে মারবে না" কথাটি বিশ্বাস করেছিল? অথবা "চলো তোমাকে মার কাছে নিয়ে যাচ্ছি" - ঘাতকের এই মিথ্যা আশ্বাসটি তার মনে বেঁচে থাকার আশা জাগিয়ে ছিল? মায়ের কথা বলে উপরে নেওয়ার পর বাবা, মা ও ভাই ভাবীদের - হিংস্র ঘাতকের নিষ্ঠুর নির্মম বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত মৃতদেহগুলো দেখে, বেঁচে থাকার কোন উপায় না পেয়ে, রাসেল আবার কাতর কণ্ঠে খুনিদের বলেছিল - "আল্লাহর দোহাই আমাকে মারবেন না। জার্মানিতে আমার হাসু আপা ও দুলাভাই থাকে, আমাকে আপনারা হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন।"

হায়রে নিষ্ঠুর পৃথিবী, ইতিহাসের এক মহানায়ক যিনি বাঙালি জাতির পিতা এবং যিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি, তাঁর সবচেয়ে আদরের ছোট সন্তান খুনিদের হাত থেকে বাঁচার কত চেষ্টাই না করল। তার কাতর কণ্ঠের বেঁচে থাকার আর্তনাদে হয়তো খোদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল কিন্তু নিষ্ঠুর ঘাতকের অভিশপ্ত মনে এতটুকু দয়ার উদ্রেক হয় নাই। দোতালায় ভীতিকর দৃশ্য দেখে বাকরুদ্ধ রাসেলকে মা বাবার লাশের পাশে দাঁড় করিয়ে খুনি হায়েনা গুলো বীভৎস হাসি দিয়ে "যা তোর মার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি" বলে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে নিষ্পাপ রাসেলকে ছিন্ন ভিন্ন করেদিল। চিরদিনের জন্য নিভে গেল শেখ পরিবারের অতি আদরের সর্বশেষ প্রদীপ।

যে প্রশ্নের উত্তর আজও আমরা পাই নাই তা-ই আরেকবার জাতির বিবেকের কাছে রাখতে চাই। জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কেন নির্মম ভাবে হত্যা করা হলো? বঙ্গবন্ধু তো কেবল একজন ব্যক্তি নন - বঙ্গবন্ধু মানেই তো বাংলাদেশ, একটি মানচিত্র, একটি বিপ্লব, স্বাধীনতার প্রতীক, সর্বযুগের ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। যে মানুষটি বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে জীবনের মূল্যবান ১৪টি বছর কারাগারে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। এ দেশের গরীব দুঃখী আর মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফুটানোই যার জীবনের একমাত্র চাওয়া ছিল। নিজের কথা, নিজের সন্তান ও সংসারের কথা যে মানুষটি কোনদিন ভাবেননি - তিনি কি এমন দোষ করেছিলেন যে তাঁকে একদম সপরিবারে নির্মম ও নির্দয় ভাবে হত্যা করতে হবে? সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন পুরুষের এত বিশাল আত্মত্যাগের এটাই কি প্রতিদান?

বঙ্গবন্ধু তো যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে শতভাগ আত্মনিয়োগ করেছিলেন। জাতির পিতার নেতৃত্বে সবকিছুই তো সঠিক ভাবেই চলছিল। তর্কের খাতিরেও যদি বলি কিছু ভুলত্রুটি হয়তো হয়েছিল। তাই বলে কি বিশ্ব মানবতার প্রবক্তা, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা, বাঙালি জাতিকে বুকে ধারণ করে চলা নির্ভীক, অকুতোভয়, হাজার বছরের শেষ্ঠ বাঙালি সন্তান - জাতির জনককে সপরিবারে একদম শেষ করে দিতে হবে?

অবুঝ শিশু রাসেল কি দোষ করেছিল? সে তো ছিল পূত পবিত্র। অপ্রস্ফুটিত ফুলের কুঁড়ির মত। সকলের আদর, ভালবাসা, অপার সম্ভাবনা ও সোনালী ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে ওঠা এক প্রাণচঞ্চল শিশু - যাকে ঘিরে পরিবারের সকল আনন্দ ঘুরপাক খেত। তাকে কেন হত্যা করা হলো?

যারা এই হত্যাযজ্ঞ করেছিল তাদের পিছনে কারা ছিল? কাদের কাছ থেকে তারা এই সাহস পেয়েছিল? দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোন শক্তি ইতিহাসের এই হৃদয় বিদারক হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল? এই উত্তর কি আমরা কোনদিন জানতে পারব না? পৃথিবীতে অসাধ্য বলে কিছু নেই। আর কালক্ষেপণ না করে এখনি রহস্য উৎঘাটনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতিহাসের কোন সত্যই কিন্তু গোপন থাকে না। প্রচেষ্টা নিলে সত্য একদিন বেড়িয়ে আসবেই।

লেখকঃ চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সাবেক মহাপরিচালক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত