5674
Published on অক্টোবর 8, 2020অজয় দাশগুপ্ত:
১৮ ডিসেম্বর, ১৯৫৪। পৌষের শীত, রাত ৯টা। প্রায় সাত মাস বন্দি থাকার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। শীতের পোশাকে চারদিক থেকে নানা বয়সের মানুষ ছুটে আসছে জেল গেটের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা জেল গেটে ভিড় করে। অনেকের হাতে মালা। মুজিবকে পরিয়ে দিচ্ছেন। স্লোগান- মুজিব ভাই জিন্দাবাদ। আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ।
মুজিব- অনেক সহকর্মীকে জেলে রেখে এসেছি। বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খান কয়েক মাস আগে আমার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন জেল গেটে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল জেল গেট থেকে। সব রাজবন্দির মুক্তি দাবি করি আমি।
মানিক মিয়া- আপনার আব্বার শরীর খুব খারাপ। ভাবি আজই বাদামতলি ঘাট থেকে স্টিমারে টুঙ্গিপাড়া রওনা হয়ে গেছেন।
মুজিব- এই স্টিমারটিই নারায়ণগঞ্জ থেকে মাঝ রাতে ছাড়বে। আমি নারায়ণগঞ্জ গিয়ে এই স্টিমার ধরব।
মানিক মিয়া- চলেন, আপনার নাজিরাবাজারের বাসায় যাই। সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া যাবে।
মুজিব- নাজিরাবাজারের বাসা রেনু ভাড়া নিয়েছে আমি জেলে যাওয়ার পর। আমি তো চিনি না। কেউ সে বাসা চেনেন?
এক লোক- চিনি, চিনি। চলেন, জেলগেট থেকে বেশি দূরে নয়।
মুজিব- আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
অনেকে একসঙ্গে- মুজিব ভাই, আপনার সঙ্গে আমরা মিছিল নিয়ে যাব।
মুজিব নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে। বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী উপস্থিত। স্লোগান- জেলের তালা ভেঙেছি মুজিব ভাইকে এনেছি। এক গোয়েন্দা, অপর গোয়েন্দারাকে- এত লোক শেখ মুজিবের মুক্তির খবর পেল কী করে? ওনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা এই স্টিমারেই আছেন। গোপালগঞ্জ যাবেন। আমি একটু আগেই তাদের কামরা দেখে এসেছি। তারা শেখ সাহেবের মুক্তির বিষয়ে কিছুই জানে না।
আরেক গোয়েন্দা- একেই বলে মুজিবের ক্যারিশমা। তাঁর খবর বাতাসে ছড়ায়।
বেগম মুজিব স্টিমারের কামরায়। হাসিনা, কামাল ও জামাল ঘুমিয়ে পড়েছে। বেগম মুজিব, স্বগতোক্তি- এত স্লোগান কেন? মুজিব, মুজিব বলছে মনে হয়? কেবিনের দরজায় ঠক ঠক করছে কে?
দরজা খুলে বিস্মিত বেগম মুজিব- তুমি?
মুজিব- হ্যাঁ, আব্বার অসুখের কথা শুনে সরকার বাহাদুরের দয়া হয়েছে। বের হয়েই দেখি, অনেক কর্মী হাজির জেল গেটে। কীভাবে খবর পেয়েছে, কে জানে। একজন বলল, তুমি রওনা হয়েছ বাদামতলী ঘাট থেকে।
বেগম মুজিব- ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে।
চোখ ডলতে ডলতে হাসিনা- মা, কথা বলছ কার সঙ্গে? আব্বা তুমি? কী মজা। ভাই, ওঠ। দেখ, আব্বা জেল থেকে চলে এসেছেন।
মুজিব ঘুমš— জামালকে কোলে তুলে নেন। কামাল ও হাসিনাকে বার বার আদর করেন।
গোয়েন্দারা আসে। যাত্রীরা আসে মুজিবকে দেখতে। সালাম দেয়। এক গোয়েন্দা- স্যার, আমাদের লোক থাকবে স্টিমারে। যা দরকার লাগে, বলবেন।
নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ কর্মীরা ফুল নিয়ে আসে। সঙ্গে ফল, বিস্কুট। বেগম মুজিব- আপনারা একটু আগে এত খাবার দিয়ে গেলেন। আবার এনেছেন কেন?
এক কর্মী- ও সব ছিল আপনাদের জন্য। এখন দিয়ে গেলাম মুজিব ভাইয়ের জন্য। ভাত-মাছও নিয়ে এসেছি।
স্টিমারের এক অফিসার- স্যার, বেগম সাহেবাকে খাবার দিয়েছি। আপনার জন্য আমরাও খাবার রেডি করছি। আর এই যে আপনার টিকিট।
বেগম মুজিব- পুলিশ সিকিউরিটির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
মুজিব- ভাবতেই পারছি না যে আজ রাত আটটার সময়েও আমি জেলখানায়, আর এই মধ্য রাতে তোমার ও ছেলেমেয়েদের কাছে। আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব।
হাসিনা- আব্বা, নদী দেখবে চল। আমরা বিকেলে দেখেছি। কী সুন্দর।
বেগম মুজিব- শীতের রাত, ঠাণ্ডা লাগবে।
মুজিব- চল মা, একটু দেখে আসি। কামাল, তুই আয় কোলে।
মুজিব দুই সন্তানকে নিয়ে স্টিমারের পাশে দাঁড়ান। যাত্রীরা কথা বলতে এগিয়ে আসেন। এক যাত্রী- মুজিব ভাই, সোহরাওয়ার্দি সাহেব কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে কি যুক্তফ্রন্ট আবার ক্ষমতায় আসবে?
আরেক যাত্রী- এই পথে একবার আপনি ও ভাসানী সাহেব গিয়েছিলেন বরিশাল। আমি সেই দিনও যাত্রী ছিলাম। আজ আপনি জেল থেকে মুক্ত হয়েছেন। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
একটু দূরে এক যাত্রী অপর যাত্রীকে- ওই দেখ, শেখ মুজিব। আজই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
অপর যাত্রী- তিনি মন্ত্রী ছিলেন। তারপর জেলে গেলেন। ভাষা আন্দোলনেও জেলে ছিলেন। ওনার কি এত কম বয়স?
প্রথম যাত্রী- হ্যাঁ, যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে কম বয়সী মন্ত্রী ছিলেন। উনি আজ জেল থেকে বের হয়ে শোনেন যে তাঁর স্ত্রী এই স্টিমারে বাদামতলি থেকে গোপালগঞ্জ রওনা হয়েছেন। উনি জেল থেকে নারায়ণগঞ্জ ছুটে এসে এই স্টিমার ধরেন।
দ্বিতীয় যাত্রী- এ তো সিনেমার চিত্রনাট্য!
হাসিনা- আব্বা দেখ, একটা স্টিমার যাচ্ছে উল্টা দিকে। আর কত নৌকা, দেখ।
মুজিব- ওটাকে স্টিমার না, লঞ্চ বলে। আর যে সব নৌকা দেখছ, ওরা ইলিশ মাছ ধরছে। কাল দিনের বেলা মাছ ধরা দেখব আমরা। এখন মায়ের কাছে চল।
হাসিনা- আমরা ঢাকা আসার সময় ইলিশ মাছ ধরা দেখেছি। মা বাড়ি থেকে রান্না করে তোমার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। জেলে সেই মাছ খেয়েছিলে?
মুজিব- হ্যাঁ মা, আমার সঙ্গে যারা জেলের বাড়িতে ছিল, তাদেরও দিয়েছি।
হাসিনা, কামাল ও জামাল ঘুমিয়ে পড়েছে। মুজিব তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বেগম মুজিব তাকিয়ে।
মুজিব- রেণু, তোমার মনে আছে চার বছর আগে ১৯৫০ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে এক স্টিমারে তুমি চলেছিলে ঢাকা, আমি আরেক স্টিমারে চলেছিলাম টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে। আমি তোমার জাহাজটি দেখে মনে মনে বলেছিলাম- ওই জাহাজে রেণু নেই তো!
বেগম মুজিব- আর আমি বলেছিলাম- ওই জাহাজে উনি নেই তো! হায় আল্লাহ, তাহলে কী হবে?
মুজিব- আমি বলেছিলাম- দুই জাহাজের দেখা হলো, শুধু দেখা হলো না আমাদের- এমনটি সিনেমায় হয়। আমাদের ক্ষেত্রে হবে নাতো? আমি হেসে উঠি।
বেগম মুজিব- আমার চোখ দিয়ে পানি পড়েছিল।
মুজিব- আজ আমি মুক্ত জীবনে তোমার সঙ্গে চলেছি। সেই রাতে আমি নিজের মনে হেসে উঠি। তখন পুলিশ ছিল পাহারায়। একজন হাসির কারণ জানতে চাইলে বলি- একটা সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। নায়ক এক জাহাজে নায়িকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। উল্টো দিকে চলেছে আরেকটি জাহাজ, নায়িকা সেই জাহাজে চলেছে নায়কের সঙ্গে দেখা করতে। জাহাজ দুটি এক সময় পাশাপাশি অতিক্রম করে যায়। কিন্তু নায়ক-নায়িকার দেখা হয় না। এই গল্প শুনে এক পুলিশ বলেছিল- স্যার, আপনি খুব রসিক মানুষ।
আরেক পুলিশ জানতে চেয়েছিল- আমি কবিতা লিখি কীনা?
বেগম মুজিব- তুমি কী বলেছিলে?
মুজিব- জীবনটাই আমার কবিতা! স্ত্রী-মেয়ে-ছেলের জন্য সারাক্ষণ মন কাঁদে। আর আমি থাকি জেলে জেলে। পাটগাতি নামার পর একজন বলেছিল- নদীতে যে স্টিমার দেখেছেন, সেটাতেই ভাবী সাহেবা বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকা গেছেন জেল খানায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আপনি জানেন না? তখন সঙ্গের পুলিশ বলেছিল- স্যার, আপনি সিনেমার যে গল্প বলছিলেন, সেটাই সত্য হলো। জান রেণু, তখন আমার বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠেছিল।
বেগম মুজিব- আমরা যে আজ একসঙ্গে যাচ্ছি, সেটাও কিন্তু সিনেমার চেয়ে কম না।
মুজিব- শীতের কুয়াশা নেমে এসেছে। গোপালগঞ্জের সন্তান আমরা। খাল-বিল-নদী পথ আমাদের কাছে অতি চেনা। কিন্তু আজকের এই রাত স্মরণীয় হয়ে থাকবে। হয়ত এমন রাতের কথা মনে রেখেই লেখা হবে কবিতা। কেউ বা গেয়ে উঠবে গান- এই রাত তোমার আমার..।
বেগম মুজিব- তুমি সত্যিই কবি হয়ে উঠেছ। একজন সাবেক মন্ত্রী কবি- বিষয়টা খারাপ না।
মুজিব- পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতি, গড়াই, কুমার- এসব নদী আমাদের চেনা। নিজে নৌকা বাইতে জানি। বাড়ির নৌকা আছে। মাঝি-মাল্লা আছে। কিন্তু আজ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যখন শুনি তুমি স্টিমারে রওনা দিয়েছ বাদামতলি থেকে, আমি মুহূর্তে ঠিক করে ফেলি- নারায়ণগঞ্জ গিয়ে তোমাকে পাবই। আজ যদি পূর্ণিমা থাকত, তাহলে হতো সোনায় সোহাগা।
বেগম মুজিব- তোমার মনে আছে- মনে আছে, গোপালগঞ্জ থেকে পূর্ণিমা রাতে আমরা টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে এসেছিলাম বড় নৌকায়। নৌকা ভর্তি আত্মীয়-স্বজন। আমরা ছইয়ের ওপর বসেছিলাম। মাঝিরা গান গাইছিল- নদীর বুকে দেখ চাঁদের বাতি...। তুমি ১৯৪৬ সালে পূর্ণিমা রাতে আগ্রার তাজমহলের সামনে বসে থাকার গল্প বলেছিলে।
মুজিব- দুই পাশের বাড়িতে কুপি বাতি জ্বলছিল। শেয়ালের হাক শোনা যাচ্ছিল। তখন ভরা বর্ষা। আমরা ৪-৫ ঘণ্টা চাঁদ দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিয়েছি। রেণু, প্রায় মাস পর আমি মুক্ত জীবনে। জেলে চাঁদ দেখার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আজ আমার সামনেই চাঁদ বসে আছে। আর এই তিনটি চাঁদের টুকরা সোনা-মানিক কী শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। জীবন আজ ধন্য।
নদীর বুকে সুমধুর ধ্বনি তুলে এগিয়ে চলে স্টিমার। সকাল হয়েছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে পূবের আকাশে উঠছে সূর্য। শেখ মুজিব ও বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব কেবিনের বাইরে এসে দাঁড়ালে সেই সূর্যের আলো পড়ে তাদের মুখে, সারা শরীরে। নদীর দুই তীরের ধানের ক্ষেতে দেখা যায় কেটে রাখা পাকা ধানের আঁটি। নদী তীরের অনেক ঘাটে গৃহবধূরা থালা-বাসন ও কলসী নিয়ে তাকিয়ে স্টিমারের দিকে। কৃষকরা লাঙল ও গরু নিয়ে মাঠের পথে।
মুজিব- কবিগুরু লিখেছেন- অগ্রহায়ণে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি...। এখন ধান কাটা হয়েছে সারা। এই ধান ঘরে ঘরে আনন্দ আনুক, হাসি আনুক- পৌষের শুরুতে এটাই কামনা করি। বাড়ি গিয়ে নতুন ধানের নবান্ন খাব, তুমি পিঠা বানাবে- চুলা থেকে গরম গরম পিঠা তুলে দেবে হাতে। কী যে আনন্দ।
বেগম মুজিব- সন্ধ্যায় খেজুরের রস খাবে, আবার সকালেও খাবে। খেজুরের রসের গুড়ে পিঠা ভিজিয়ে রাখব। কত লোক আসবে তোমাকে দেখতে। সবাইকে নিয়ে কাচারি বাড়িতে গল্প করবে আর পিঠা খাবে।
মুজিব- রেণু, তোমার মনে আছে- খেজুরের রস চুরি হলে গাছিরা কেমন গালি দিত। আমি আর নাসেরও ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির গাছের রস চুরি করেছি। আব্বা যেন না জানে- তুমি আর আমার বোনেরা সে জন্য কত লুকোচুরি খেলতে।