2773
Published on অক্টোবর 4, 2020ওয়াহিদা আক্তার:
পিতা হিসেবে কেমন ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান? ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ দুটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমরা পেয়েছি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার দীর্ঘ দুই যুগের পরিশ্রমের ফল হিসেবে। সত্যি বলতে কি এ বই দুটি প্রকাশিত না হলে বাঙালি কী হারিয়েছে তা জানতে পারত না। বঙ্গবন্ধু বা তাঁর জীবনাদর্শ বলতে অস্পষ্ট অর্ধসত্য ভাবমূর্তিতে তাঁর খন্ডিত অবয়ব বিরাজ করত সবার অন্তরে। এখানেও বঙ্গবন্ধু স্বহস্তে আমাদের সবার অক্ষমতা, মলিনতা, দীনতা ও সীমাবদ্ধতা ঘুচিয়ে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করেছেন নিজেকে, নিজের দেশকে, নিজের দর্শনকে, নিজের ভালোবাসাকে, নিজের পরিবারকে। বাংলার ইতিহাসকে, দেশের ইতিহাসকে। বিশ্লেষণ করেছেন নির্মোহ যুক্তিতে। আমরা জেনেছি বঙ্গবন্ধু কবে স্বাধীন একটি দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এ দেশের গরিব-দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ছিল তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি সংগঠন গড়েছেন, আন্দোলন করেছেন এবং তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কারাভ্যন্তরে কাটিয়ে দিয়েছেন। বাংলার দুখী মানুষের অধিকার আদায়ে সব বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রতিবাদ করেছেন, বারবার গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁর জীবন-মরণের সঙ্গী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব কারাগারে লেখার খাতা জোগান দিয়েছেন লেখার জন্য, একাকিত্বের কষ্ট লাঘবের জন্য। তাই তো আজ পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনটি গ্রন্থ।
কি দূরদৃষ্টি ছিল গ্রামের ওই ছোট্ট বালিকাবধূর! কি শক্তিতে বলীয়ান ছিল ওইটুকুন মেয়ের! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো প্রখর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সুদর্শন জননেতার স্বপ্নসারথি হয়েছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনি দল পরিবারের ১৮ সদস্যকে খুন করে বাড়িঘর লুট করে। কিন্তু লুট করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর লেখার খাতা; বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন বয়সের ছবি। আজ তাঁর দুই কন্যা ধুলায় ধূসরিত সেসব স্মৃতি পরম মমতায় আলোয় নিয়ে এসেছেন। বাঙালি জেনেছে তাদের ভালোবাসার মানুষের শক্তির অমোঘ বাণী। কিছুই হারিয়ে যায়নি, শুধু মানুষগুলো নেই!
আমার বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন কর্মী। যিনি আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার অনুসারী ছিলেন। পরিবারের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকার সুবাদে কিছু বই পড়েছি। কিন্তু সত্যি বলতে কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং বাঙালি ও বাংলার প্রকৃত ইতিহাস জানতে পেরেছি এবং দেশের প্রতি মমতায় যে চোখের পানি আসে তা অনুভব করেছি। এ দুটি বই উপহার দেওয়ার জন্য বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অবদানকে স্মরণ করবে। সাধারণ মানুষের রাজনীতির অধিকার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। একটি লাল সবুজের অনন্য পতাকা আমাদের বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমাদের নিজস্ব ভাষা, জাতীয়তা ও কৃষ্টি নিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে আমরা বিশ্বে এখন মাথা উঁচু করে বুক চিতিয়ে দাঁড়াই। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে একটি দেশ দিয়েছেন তাই তো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাই তো তিনি আমাদের জাতির পিতা।
প্রথম যে প্রশ্ন রেখে এ লেখা শুরু করেছিলাম- কেমন ছিলেন তিনি পিতা হিসেবে? হ্যাঁ, পিতার লেখায় দেখেছি তাঁর সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও অনুভূতির কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর যে দুজন শ্রেষ্ঠ সন্তান মহান রব্বুল আলামিনের অশেষ কৃপায় বেঁচে আছেন, যারা প্রতিটি দিনকে জীবনের শেষ দিন মনে করে দায়িত্ব পালন করছেন, প্রতিনিয়ত দেশ পরিচালনায়, মৌলিক উন্নয়ন চিন্তায় দেশকে শুধু দিয়েই চলেছেন তারা কী বলছেন বাবার কথা, দৈনন্দিন কাজে, চলাফেরায় মায়া-মমতায় জড়াজড়ি করে। একটি পরিবারের সদস্যদের কথা উঠে আসে তা সামান্য জানার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি ২০১৭ সালের জুলাইয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব হিসেবে যোগদানের পর থেকে দাফতরিক কাজকর্ম, ওঠা-বসায় তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, শোনার সুযোগ হয়েছে। বেশির ভাগ সময় শুধু চুপ থেকে শুনে গেছি। চোখে-মুখে উচ্ছলতা, উজ্জ্বলতা নিয়ে দুই কন্যা যখন স্মৃতিচারণা করেন মনেই হয় না পরিবারের কোনো সদস্যকে তাঁরা মৃত হিসেবে মনে করেন। মনে হয় পুরো পরিবারটি এখনো মায়া-মমতায় জড়াজড়ি করে পরস্পর পরস্পরকে শক্তি জুগিয়ে চলেছে। নিত্যনতুন স্মৃতিচারণামূলক কথার মালা গেঁথে চলেন দুই বোন। পারতপক্ষে কোনো শব্দ করি না পাছে ছন্দপতন ঘটে। রাষ্ট্রীয় দিবসের কর্মসূচিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর তিনি দোতলার সিঁড়িতে ও এক তলার ডান দিকে কর্নারের ঘরটিতে কিছু সময় কাটান। এর ব্যত্যয় হতে দেখিনি। গল্পচ্ছলে একদিন বললেন, ১৯৬১ সালে বাড়ি করার শুরুতে এ ঘরটা দিয়ে শুরু হয় বাড়ি নির্মাণ। খরচ বাঁচানোর জন্য ইটের গাঁথুনি ও এর কিউরিং করার দায়িত্ব বেগম মুজিব নিজেই পালন করতেন। নিজ হাতে পানি দিতেন। পরবর্তীতে এ ঘরে থাকতেন শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল। টেপরেকর্ডারে গান দিয়ে ফ্যান ছেড়ে কাঁথা গায়ে টেনে বিস্তৃত লম্বা চুল খাট থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করতেন শেখ হাসিনা। এজন্য মা তাঁকে আলসে মেয়ে হিসেবে অভিহিত করেন। এ ঘরটিকে তিনি ‘আলসে ঘর’ হিসেবে নাম দেন। রাষ্ট্রীয় কাজে এখনো শেখ হাসিনা যতবারই আসেন একটু সময় হলেও বের করে আলসে ঘরে বসে কোরআন তিলাওয়াত করে বের হন। সরকারি দায়িত্ব পালনের কারণে অনেকবার আলসে ঘরে ঢোকার সুযোগ হয়েছে। নানা স্মৃতিচারণায় হারিয়ে যান তিনি এ ঘরে এসে। পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে মিলাদ মাহফিল শেষ হলে প্রত্যেককে কুশল জিজ্ঞেস করে শ্রেণিমতো আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন। যারাই উপস্থিত থাকেন শেখ হাসিনার মনোযোগ সবাই পান। রেহানা আপা থাকলে আরও মজার সব স্মৃতিচারণা হয়। রেহানা আপার মতো চৌকস বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষ দ্বিতীয়জন দেখিনি। প্রতিটি কথায় অবলীলায় মজার মজার স্মৃতি বলে যেতে পারেন।
কণ্ঠস্বরটিও ভিন্ন মাদকতায় টানে। স্মৃতিচারণায় কখনো কখনো তাঁদের কণ্ঠস্বর ভিজে আসে কোমলে কঠোরে যেন দুই বোন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে চলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখেই শুনেছি ১৯৮১ সালের পর থেকে তাদের সবকটি সন্তানের মা রেহানা আপা। জয়, পুতুল, টিউলিপ, ববি, রূপন্তী যেন একবৃন্তে পাঁচটি ফুল। তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত রেহানা আপা নেবেন এবং দেশ, রাজনীতি ও দলের সব সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার- এই হচ্ছে দুই বোনের অলিখিত চুক্তি।
স্মৃতিচারণায় প্রায়ই রেহানা আপা বলেন, তিনি ছিলেন মায়ের টিকটিকি। আত্মীয়স্বজনের কত রকম সামাজিক দায়িত্ব যে মা পালন করতেন তার ইয়ত্তা নেই।
বঙ্গবন্ধু সন্তানদের বিলাসিতার ভিতরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত করতে চাইতেন না, বঙ্গমাতা বেগম মুজিব প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির স্ত্রী যা-ই হোন না কেন, রান্নাঘরের দায়িত্ব সব সময় নিজের কাছেই রাখতেন। ছেলেমেয়েদের গণভবনে খুব কমই আনতেন। ঝরসঢ়ষব ষরারহম, যরময ঃযরহশরহম-এর মাহাত্ম্য নিয়ে তিনি ছেলেমেয়েদের লালন করতেন। ব্যক্তিত্বের প্রখরতা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক বন্ধুসুলভ ছিল বলেই মনে হয়েছে। বৈষয়িক, সাংসারিক, দৈনন্দিন খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি দারুণ অনভিজ্ঞ ছিলেন। সাধারণত দলের যে কোনো ধরনের মিটিং বাসায় হলে রান্নার কাজ বেগম মুজিব করতেন। পান বানানো, শরবত বানানো, প্লেট-পিরিচ এগিয়ে দেওয়া-নেওয়া ছেলেমেয়েরাই করতেন। একদিন ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু শরবত যেন সুস্বাদু হয় সেজন্য বেগম মুজিবকে বললেন, ‘রেণু, জানেসাবা দিয়ে শরবত তৈরি করে দিও।’ বেগম মুজিব বললেন, ‘ঠিক আছে, জানেসাবা দিয়েই শরবত বানিয়ে দেব।’ পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েদের হাসিতে তিনি বুঝতে পারলেন কিছু একটা ভুল হয়েছে। আসলে তিনি বলতে চেয়েছেন ‘রুহ আফজা’ কিন্তু বলেছেন ‘জানেসাবা’। জানেসাবা নামে তখন একটা সাবান পাওয়া যেত। ছোট ছোট স্মৃতির মণিমুক্তো সব সময় তাঁদের আলোচনায় পাওয়া যায়।
শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিয়েতেই পরিবারটি যেন জীবনের প্রথম ও শেষ আনন্দ উপভোগ করেছিল। বিয়েতে শেখ রেহানা আপা ও শেখ হাসিনা অন্য বোনদের সঙ্গে সাজগোজ করেন এবং হইহুল্লোড়ে মাতেন। বঙ্গবন্ধু লোকজন নিয়ে বসে ছিলেন, সেখানে সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শেখ হাসিনা দেখলেন বাবা তাঁর দিকে চেয়ে আছেন। চাউনিটা তাঁর কাছে কেমন যেন অস্বস্তি আনল, তিনি কানে পরা বড় ঝুমকো দুলটা খুলে এক বোনের হাতে দিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু খেয়াল করলেন যে একটু আগের কানের অলঙ্কারটা শেখ হাসিনা খুলে ফেলেছেন। কাছে এসে বললেন, ‘মা, কী পরেছিলি কানের ওটা?’ শেখ হাসিনা বললেন, কেন আব্বা, খারাপ লাগছিল?’ তিনি বললেন, ‘না মা, তবে অত বড় না পরে ছোট ছোট দুল পরবি।’
গয়না, দামি শাড়ি পরার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘মা, এগুলো পরে কাকে দেখাবি, এ দেশের গরিব-দুখী মানুষকে!’
একবার শেখ কামাল, সুলতানা কামাল, বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব ও সুলতানা কামালের বাবা-মা ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়েছেন এমন সময় শেখ হাসিনা ঢুকে বললেন, ‘আমিও তুলব ছবি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এ ছবিতে তুমি থাকবে না। এখানে শুধু আমরা।’ শেখ হাসিনা দুপদাপ শব্দ করে ঘর থেকে বের হয়ে বললেন, ‘তুলবই না ছবি।’ সেই ১৯৭৫ সালে তোলা ছবি ২০১৯ সালে দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি হাতড়ে কথাগুলো বললেন। ফুফাতো বোন শেখ রোজী পারিবারিক অনুষ্ঠানে মাথায় ফুল গুঁজে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চোখে পড়ে যেতেই বলে ওঠেন, ‘জামাল মেয়ে খোঁজে, রোজীকে বিয়ে করলেই তো পারে।’ শেখ কামাল খুব লাজুক প্রকৃতির ও সংস্কৃতিমনা। সুলতানা কামালের মিষ্টি চেহারায় মুগ্ধ বাড়ির সবাই। তাকে চেপে ধরে শেখ রেহানা বলেন, ‘দাদা, মেয়েটার চোখ এত সুন্দর, আমার সব গয়না দিয়ে দেব, রাজি হয়ে যাও।’ শুনেছি বৃদ্ধ দাদা অসুস্থ ছিলেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো অপূর্ণ কোনো ইচ্ছা আছে কিনা। বললেন, কামালের বউ দেখার ইচ্ছা ছিল। রেহানা আপা এ কথা শুনে সুলতানা কামালকে ধরে এনে দাদার সামনে দাঁড় করান শেখ কামালের হবু বধূ হিসেবে।
২৮ জুলাই, ১৯৭৫। দিনটিতে শেখ হাসিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। একদিকে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা প্রদান করবে। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় তার ওপর তৎকালীন ভিসি মতিন স্যার অনুরোধ করেছেন ১৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে থেকে যেতে। অন্যদিকে ড. ওয়াজেদ মিয়া জার্মানি থেকে তাড়া দিচ্ছেন তাঁর কাছে যেতে। বাড়িতে তখন একটিই টেলিফোন। জার্মানি থেকে ফোন এলো। বঙ্গবন্ধুর রুমে টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ওয়াজেদ সাহেব যেতে বলছেন আর শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য পরে যাওয়ার কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধু বিছানায় শোয়া। টেলিফোন শেষ হলে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মা, জামাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তোমাদের দেখার জন্য, প্রস্তুতি নিয়ে নাও।’ তারপর ঠিক হলো শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানাও জার্মানি যাবেন। তার পরের ইতিহাস সবাই জানে। ১৫ দিন আগে সবই ছিল। ১৫ দিন পর দুনিয়ায় শেখ হাসিনার আপন বলতে ছোট বোন শেখ রেহানা ছাড়া আর কেউ ছিল না।
নেত্রকোনার এমপি মিসেস রেবেকা মোমিন একটি অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, ‘বড় মেয়ে শেখ হাসিনার যখন বিয়ে হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন কারাগারে। বেগম মুজিব এক অনাড়ম্বর আয়োজনে মেয়ের বিয়ে দিলেন। বাড়ি থেকে ১০০ জনের মতো খাবার জেলখানায় পাঠানো হলো। মোমিন সাহেবও তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাগারে। তিনি আদরের বড় মেয়ের বিয়ের খাবার সামনে নিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন ও বলেন, “এ খাবার আমাকে খেতে দিও না”।’
বঙ্গবন্ধুর মতো একজন সুদর্শন জনদরদি তেজস্বী নেতাকে শুধু ভালোবাসাই যায়, তবে কারা ঈর্ষা করেছিল, কারা হিংসা করেছিল! ছোট রাসেলকেও তারা ভয় পেয়ে বাঁচিয়ে রাখেনি! ‘রাসেল বাবার হাঁটাচলা, পোশাক পরা সবকিছুই অনুকরণ করত।’
বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ ১০০ বছর বয়স হতো। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তাঁকে পরিবারসহ এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর সেই তেজোদীপ্ত ভাষণ, তাঁর সৌন্দর্য, তাঁর দেশপ্রেম ঈর্ষার কারণ হয়েছিল। মৃত্যুকে জয় করে আজ তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লি সফরে যান। দিল্লির বিদেশ মন্ত্রকের প্রটোকল কর্মকর্তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলেমেয়ের আপ্যায়ন তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন ‘ববি’ ছবিটি সুপার হিট হয়েছিল। ‘ববি’ ছবি দেখার আয়োজন হয়েছে শুনতে পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মৃদু ভর্ৎসনা করে বলেন, তাঁর সন্তান হিসেবে ছবি দেখতে চাওয়া তিনি প্রত্যাশা করেননি। রেহানা আপার সে কি অভিমান, দেখবেই না ছবি! শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, ‘রেহানা আমার ১০ বছরের ছোট প্রায় আমার সন্তানের মতো।’ আমি দেখেছি এ ছোট বোনটিই সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়ে, শক্তি দিয়ে বড় বোনের কাঁধ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কথায় কথায় চোখ ভিজে যাওয়া, কান্নায় গলা বুজে আসা শেখ হাসিনার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেওয়া এ বোনটি, পরম মমতায় গায়ে চাদর জড়িয়ে দেন। চোখ অপারেশনের পর একঘেয়ে ঘরে আটকে থাকা থেকে বাইরের খোলা হাওয়ায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া এ বোনটিই খেয়াল করেন। শেখ হাসিনা আদর করে ‘মুনা’ ডাকেন ছোট বোনকে। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বিদায় জানান।
পরিবারের সবচেয়ে কঠিন দায়িত্বটি পালন করেন বোন রেহানা। পাঁচ ছেলেমেয়ের ১০ জন বাচ্চা কাকে কখন সময় দিতে হবে, তাদের পড়াশোনা, সুস্থতা সব কিছুর দায়িত্ব শেখ রেহানার। দুই কন্যা ও তাদের সন্তানরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের পতাকা বহন করে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের নিরীহ জনগণ, নারী ও শিশু হত্যার জন্য পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি ওঠে। দাবির সপক্ষে জনমতও গঠিত হয়। আপন আয়নায় মুখ দেখি না আমরা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি আমরা যে অবিচার করেছি, অন্যায় করেছি, মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছি এখনো সুযোগ পেলেই মিথ্যা গল্প ফেঁদে পরিবারের সদস্যদের চরিত্রহননের চেষ্টা করি। তার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে কি আমরা ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি?
নানা অজুহাতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার পা ছুঁয়ে সালাম করে মনে মনে বলি, আমাদের ক্ষমা করুন আপনারা। আপনাদের পরিবারের ওপর আমরা বড় অন্যায় করেছি। সত্যিই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমরা বড় অবিচার করে ফেলেছি। আলোর পথযাত্রী এ পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
ও আলোর পথযাত্রী
এ যে রাত্রী
এখানে থেম না... ।
লেখক : প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ (অতিরিক্ত সচিব)
সৌজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন