বাঙালির ‘অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রাম দিবস’ হিসেবে পালিত হোক শেখ হাসিনার জন্মদিন

1220

Published on সেপ্টেম্বর 28, 2020
  • Details Image
ড. মুনাজ আহমেদ নূরঃ 

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর, বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের এই দিনে জাতির পিতার জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়াতেই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রাণপ্রিয় নেত্রীর জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন।

গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, পাখির কলকাকলি আর বাইগার নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে শৈশব-কৈশোর কেটেছে তার। শিক্ষাজীবন শুরু হয় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়াতেই। গ্রামের পাঠশালায় প্রথম শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় বন ও কৃষিমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রথমবারের মতো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। তার আগে দাদা, দাদি, মা আর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় থাকতেন। ১৯৫৬ সালে ভর্তি হন টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে। শহরের জীবনের চেয়ে গ্রামই তার অধিক প্রিয়। ছুটি পেলেই চলে যেতেন গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায়। গ্রাম হবে শহর এই সেগান তারই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বাইগার নদীর ঢেউ আর পাখির কলকাকলি বেশ উপভোগ করতেন তিনি। সে কথা নিজেই লিখেছেন তার রচনাসমগ্রে।

১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন আর ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকার বকশীবাজারের পূর্বতন ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে। ১৯৬৭ সালেই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। শিক্ষা এবং শিক্ষকদের প্রতি তার শ্রদ্ধার নিদর্শন চোখে পড়ার মতো। ১৯৬৬-৬৭ সালে ছাত্রলীগ থেকে ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজপথ থেকে অংশ নিয়েছেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ৬ দফা আন্দোলন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সে কারণে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বিশ্বের অন্য যে কোনো নেতা থেকে আলাদা। এখন তিনি শুধু জাতীয় নেতাই নন, বিচক্ষণ বিশ্ব নেতাদের অন্যতম। সর্বশেষ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খ্যাতি অর্জন করেছেন।

কারাবন্দি পিতা বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে ১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে মা, বোন, ছোট ভাই রাসেলসহ বন্দি ছিলেন। প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা মুক্তি পান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। শেখ হাসিনা এর মাত্র ১৫ দিন আগে দেশ ছেড়েছিলেন জার্মানিতে গবেষণারত স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। সেদিন আল্লাহর অশেষ রহমতে দেশের বাইরে থাকায় দৈবক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর অতি আদরের দুই কন্যা।

স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে পুরো পরিবারকে হারিয়ে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ এই ছয় বছর প্রবাসে নির্বাসিত ও কষ্টের জীবন কাটাতে হয় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারির ১৪, ১৫ ও ১৬ তারিখে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। একই বছরের ১৭ মে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।

দেশে ফেরার পর থেকেই নিরলসভাবে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত অসংখ্যবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। বাংলার মানুষের ভালোবাসায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আঘাত এলেও তিনি কখনও মাথানত করেননি। দেশে ফিরেই তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এদেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। জনগণ তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গড়ে তুলেছিল দুর্বার আন্দোলন। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে স্বৈরাচারের সঙ্গে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেননি। এদেশের মানুষকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেননি। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কোন নির্বাচন জনগণের অধিকার আদায়ের আর কোন নির্বাচন স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দলকে সরকারে আনেন তিনি। দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। দেশের মানুষের সামগ্রিক মুক্তির যাত্রা শুরু করেন।

২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হারানো হলে দলের নেতাকর্মীদের ওপর জোট সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন শুরু হয়। ২০০৪ সালের গ্রেনেড মেরে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। সে হামলায় দলের নেতাকর্মীদের মানববর্ম শেখ হাসিনাকে প্রাণে বাঁচালেও আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ২০০৬ সালের পর তাকে গৃহবন্দি করা হয়, জেলে পাঠানো হয় অনৈতিকভাবে; কিন্তু কোনো ঘাত-প্রতিঘাত তাকে দমাতে পারেনি। ষড়যন্ত্র কখনোই পিছু ছাড়েনি তার, এতে অবশ্য তিনি কখনোই বিচলিত নন। দমে যাননি শেখ হাসিনা। বরাবরের মতোই শোককে শক্তিতে পরিণত করে জনগণের কল্যাণে নিজেকে হিমালয়সম অটল রেখেছেন।

২০০৯ থেকে বর্তমান পর্যন্ত টানা তিনবারসহ চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি। ২০০৯ থেকে ২০২০Ñ এই ১১ বছরে শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে ইতিহাসের এক স্বর্ণযুগে। এক মনে ও ধ্যানে পিতার অঙ্গীকার পূরণে নির্ভীকচিত্তে সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তার অনন্য রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কারণে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ে থাকার কারণ। তিনি প্রশাসনকে ধীরে ধীরে মেধাবীদের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করেছেন। নতুন নতুন নীতি গ্রহণের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দুর্বারগতিতে। তার গৃহীত ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের ফলে ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তার প্রদত্ত ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এ বাংলাদেশকে আগামী ১০০ বছর পর আমরা কেমন দেখতে চাই, তার পরিকল্পনাও করে রেখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। সেই লক্ষ্যে তিনি ভিশন-২১০০ ঘোষণা করেছেন এবং ২১০০ সালের মধ্যে এর বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলার। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা তা ২ হাজার ডলারের ওপরে নিয়ে গেছেন। দরিদ্র মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করতে তিনি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র অসহায় মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। এখানে দুটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশ্বের অনেক ধনী দেশেও চিকিৎসাসেবা এবং শিক্ষা বিনামূল্যে দেওয়া হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে এই দুটি একেবারেই বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি সুবিধা। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে টিফিন ও উপবৃত্তি। মাধ্যমিকেও শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে উপবৃত্তি। উচ্চ শিক্ষায় দেওয়া হচ্ছে স্কলারশিপ। তার ওপর হতদরিদ্রদের জন্য সোশ্যাল সেফটি নেট প্রোগ্রাম তো আছেই।

যে কোনো বৈশ্বিক দুর্যোগে সবার আগে এগিয়ে যান শেখ হাসিনা। এ করোনার সময় আমরা দেখেছি তার নিরলস পরিশ্রমের কারণে অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেক কম। এ মহামারি থেকে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করে মানুষর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে একাই লড়ছেন তিনি। সংকট মোকাবিলায় নিয়মিত দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি দুর্গত মানুষকে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি সরাসরি তদারকি করেছেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে বিশ্ববাসীকে রক্ষায় সুদৃঢ় ভূমিকা রেখেছেন। একাধিক ভিডিও কনফারেন্সিং করেছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে। আহ্বান জানিয়েছেন, বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার। বিশ্বে শান্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তার তুলনা তিনি নিজেই। আমরা এখন পর্যন্ত বিশ্বে তার মতো মানবিক নেতা দেখতে পাইনি। একথা একবারে উদাহরণ দিয়ে বলা যায়। করোনাকালীন অনেক দেশ, তাদের দেশে যেসব বিদেশি শ্রমিক কাজ করে, তাদের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। আবার অনেক দেশ পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে তিনি ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে রেখে তাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাই। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেছে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছে, দেশের উন্নয়ন করেছে, আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই ধারা অব্যাহত রেখেছে। আওয়ামী লীগের হাল ধরে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনাও মানুষের উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। শেখ হাসিনার কল্যাণে প্রতিটি সেক্টরে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসোপানে। এখন তার জীবনের একটাই প্রত্যয় জাতির পিতার ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ গড়ার। সে প্রত্যয় নিয়েই এগিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি তাকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে। শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে জাতির পিতার কাক্সিক্ষত মুক্তি সংগ্রাম বাস্তবায়নের শেষ প্রান্তে। এখন তিনি স্বপ্ন দেখছেন ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার। তিনি দেশের নেতৃত্বে থাকলে সফলভাবে ২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পরিণত হবে। শেখ হাসিনা এদেশের মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিচ্ছেন। নিশ্চিত করছেন এদেশের মানুষের সমৃদ্ধ জীবনযাপন। তাই এখন থেকে প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্মদিনটি পালিত হোক বাঙালির ‘মুক্তি সংগ্রাম দিবস’ হিসেবে। প্রাণপ্রিয় নেত্রী আপনার জন্মদিনে জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

 

লেখকঃ উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত