শেখ হাসিনা: অন্ধকারের বিপরীতে আলোর দিশারী

1040

Published on সেপ্টেম্বর 28, 2020
  • Details Image

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

একজন ব্যক্তি একটি অঞ্চলের, একটি দেশের এমনকি গোটা পৃথিবীর মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে পারেন, মানুষের চিন্তার পরিবর্তন ঘটাতে পারেন, এমনকি দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থাকে পর্যন্ত পাল্টে দিতে পারেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭০-’৭১ এ পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর ছিলেন, নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন সাদা মানুষই ‘মানুষ’ কালোরা ‘মানুষ’ নয়-এই চিন্তার বিপরীত অবস্থা তৈরী করেছিলেন, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যেমন সেবার উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন, ঠিক তেমনি শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের এবং অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জন্য সংগ্রাম করেছেন। ১৯৮১’র ১৭ মে তিনি যখন ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন, সেদিন বাংলার উত্তর আকাশে কালবৈশাখীর মেঘ ছিল, তাঁর সম্বর্ধনা সভা লোকে লোকারন্য ছিল এবং প্রচন্ড ঝড়ের সম্ভাবনার বিপরীতে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারা ছিল। লক্ষ জনতার পাশাপাশি বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি সেদিন শেখ হাসিনাকে বরণ করেছিল, বঙ্গবন্ধুর জন্য কেঁদেছিল। তিনি মঞ্চে উঠে বেশী কথা বলতে পারেননি। শুধুই কেঁদেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার চেষ্টায় ব্যাপৃত হন। খণ্ড-বিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগকে তিনি একত্রিত করার চেষ্টা করেন।

তিনি গ্রাম-গ্রামন্তরে ঘুরতে শুরু করেন, তিনি বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের দাবীতে সরব হন। তিনি এই সত্য প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিবেদিত করেন যে, হত্যাকারীর বিচার হতে হবে। কোন ব্যক্তি যদি গুরুতর অপরাধে যুক্ত থাকে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে প্রচলিত আদালতে বিচার করতে হবে। এমনকি খুনীকেও হত্যা না করে আইনের হাতেই সোপর্দ করতে হবে। এই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে যে খুনের রাজনীতি ও খুন করে বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল, তিনি তার বিপরীতে অবস্থান নেন। খুনীর বিচার বন্ধে আইন প্রণয়ন যে শুধুমাত্র বেআইনি তা নয়, এটি যে অসভ্যতা তা তিনি প্রমান করার চেষ্টা করেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে শায়েস্তা করার মত শক্তি আওয়ামী লীগের ছিল, কিন্তু শেখ হাসিনা সেই শক্তি প্রয়োগের দিকে যান নি; তিনি আইনানুগ পন্থায় অপরাধীদের বিচার চেয়েছেন। তিনি বারংবার বলেছেন, ‘এই বাংলাদেশের মাটিতে খুনীদের বিচার হবে’। তিনি এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ‘খুনের বদলা খুন’ করতে চান নি। বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে ঘোষণা দেন, ‘বন্দুকের নল নয়, জনগণই ক্ষমতার উৎস’। এরই অংশ হিসেবে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয়।

একসময়ে বাংলাদেশ একটি সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়। ’৭২ থেকে সর্বহারা-জাসদের মাধ্যমে এই খুন-খারাবির শুরু। জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধী ও খুনীদেরকে জেলখানা থেকে বের করে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। এমনকি অন্য দলের নেতাদেরকে ভয় বা প্রলোভন দেখিয়ে নবগঠিত দলে টানেন। এইভাবে সামরিক গোয়েন্দাদেরকে ব্যবহার করে রাজনীতিকদের কেনা-বেচার এক সংস্কৃতি চালু হয়। শেখ হাসিনা এই সংস্কৃতি বন্ধ করার চেষ্টা করেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে দলে টেনে জিয়া-এরশাদ বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জায় নেবার জন্য প্রয়াস পান। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সন্ত্রাস স্থায়ী রূপ নেয়। শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদেরকে সেই অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন। সন্ত্রাসের কারণে এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অনির্ধারিত বন্ধ বা সেশনজট থাকে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ তা একসময়ে অনুভূত হয়নি। প্রতিদিন সেখান থেকে বিভিন্ন বাহিনীর কোন না কোন লাশ আসত। শেখ হাসিনা ’৯৬ এ ক্ষমতায় এসেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে শান্তি-চুক্তিতে পৌঁছান। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সাথে এত স্বল্পতম সময়ের আলোচনার মাধ্যমে চুক্তিতে পৌঁছানো বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন চোখে পড়ার মত। ভারতের সাথে গঙ্গার পানি, সমুদ্রসীমা ও ছিটমহল সমস্যার সমাধান অত্যন্ত তাৎপুর্যপূর্ণ ঘটনা। সমগ্র বিশ্বে এ সকল ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে বিবাদ-এক চিরায়ত বিষয়। কিন্তু শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় দীর্ঘকালের এই জটিল সমস্যাসমূহের সমাধান হয়েছে।

সর্বোপরি বাঙালির বাংলাকে পাকিস্তানি বাংলাদেশ বানাবার যে অপচেষ্টা জিয়া-এরশাদ শুরু করেছিলেন শেখ হাসিনা তা থামিয়ে দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের পথ তিনি বন্ধ করেন। বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে তিনি এই সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন যে, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে না-এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় তিনি সদা ব্যস্ত। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলোকে আবার তিনি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। জয় বাংলা, পহেলা বৈশাখ ও একুশকে তিনি যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে শুধু সশস্ত্র সংগ্রাম নয়-এটি ছিল সর্বস্তরের মানুষের তথা জনযুদ্ধ-এটিই তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শেখ হাসিনা তাই বাঙালিত্বে বিশ্বাসী জনগণের আশা-আকাক্সখার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ঘাতকেরা বারংবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে ও করছে। কিন্তু তিনি অকুতোভয়। তিনি আছেন এবং থাকবেন আরও অনেক দিন-অনেক বছর। শেখ হাসিনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

লেখকঃ উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত