2599
Published on সেপ্টেম্বর 22, 2020মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান:
২৮ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। তিনি ৭৩ বছর পেরিয়ে ৭৪-এ পদার্পণ করতে যাচ্ছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ৫৫ বছর বয়সে হত্যা করা হয়। তিনি ৫১/৫২ বছর বয়সে বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে একটি রাষ্ট্র উপহার দেন এবং তার কন্যা তার স্বল্পকালীন কার্যকালে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিরা থেমে থাকেনি। তারা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থানকালেও তৎপর ছিল। ১৯৮১-র ১৭ মে দেশে ফেরার পর ঘাতকরা তাকে অনেকবার হত্যায় উদ্যত হয়। কিন্তু আল্লাহ্র রহমত ও নেতাকর্মীদের সহায়তায় তিনি রক্ষা পান। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আঘাত ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। এইদিন তিনি বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ তার অনেক প্রাণপ্রিয় নেতাকর্মী নিহত হন এবং তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। ঘাতকদের এই আঘাত তিনি এখনো পরিপূর্ণভাবে অতিক্রম করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় মানুষের জন্য তাকে দিয়ে কিছু কাজ করাবার জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। বিরামহীন এই ব্যস্ততার কারণ একটাই- দেশের মানুষের মঙ্গল সাধন।
শেখ হাসিনার বিগত ১৭ বছরের শাসনকালের বহুবিধ বিষয়াবলি এই স্বল্প পরিসরের আলোচনায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। বিভিন্নজন নিশ্চয়ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখবেন। আমরা তার উচ্চশিক্ষার বিস্তার ও মানোন্নয়ন নিয়ে এখানে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বঙ্গবন্ধুর সময়ে গৃহীত পদক্ষেপসমূহও প্রসঙ্গত আলোচনায় আসবে। যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেন, তারা সচরাচর বলে থাকেন যে, বর্তমান সরকার বা শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। অবিশ্বাসীরা এর বিকৃত ব্যাখ্যা করে উপহাস করে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রতি যাদের আস্থা ও বিশ্বাস নেই, তারাই এ ধরনের মন্তব্য করে থাকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে আসার পর থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন এবং দেশের প্রতিটি সেক্টরের জন্য উন্নয়নের নতুন নীতিমালা তৈরি করেন। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করেন তৎকালীন প্ল্যানিং কমিশন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজে প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম ছিলেন ডেপুটি চেয়ারম্যান। প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান ও প্রফেসর মোশাররফ হোসেন এর সদস্য ছিলেন। এই কমিশন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন ও নতুন করে গড়ে তোলার নিমিত্তে বিভিন্ন রকমের নীতি ও পরিকল্পনা তৈরি করে। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকার যে প্ল্যানিং সেল গঠন করে, তারই ধারাবাহিকতা ছিল প্ল্যানিং কমিশন। কমিশন বাংলাদেশের উন্নয়নকে তরান্বিত করার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো বার্ষিক বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে আর্থিক সামর্থ্যসাপেক্ষে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কাজগুলো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে এবং তার নির্দেশনায় রচিত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে, দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর বা বিভাগকে উন্নয়নের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা তিনি বাস্তবায়ন করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই তাকে হত্যা করা হয়। এই সুলিখিত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার বাইরে তার অনেক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বা নথিতে বা তার নিজ হস্তাক্ষরে লেখা পর্যবেক্ষণ অথবা মন্তব্যে। এসব পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্যে যেসব উন্নয়ন-সংক্রান্ত বা জনসাধারণের মঙ্গলের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় বাস্তবায়িত হতে পারেনি। সামগ্রিকভাবে তার এই অসমাপ্ত কাজ বা পরিকল্পনা এটাকেই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বলে আখ্যায়িত করি।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণীত হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৮ পর্যন্ত এর মেয়াদ ছিল। এই পরিকল্পনায় দেশের প্রতিটি বিষয়কেই আমলে নেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি, ছাত্রানুপাতে শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি সকল তরুণ-তরুণীদের জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ আবশ্যিক নয় সে-বিষয়টি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষার মাধ্যম যেন প্রায়োগিক হয় সে-বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রতিটি শিক্ষিত তরুণ-তরুণী শিক্ষাজীবন শেষ করে যেন দেশের সেবায় নিয়োজিত হতে পারে সে-বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। এক্ষেত্রে শুধু চাকরির পরিবর্তে, যে-বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন, শিক্ষার্থীরা যেন সেই বিষয়ে কাজ পায়, এ ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এজন্য শুধু তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর জোর না দিয়ে হাতে-কলমে শিক্ষার বিষয়টিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ৩০০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বৃত্তি দিয়ে বিদেশে গবেষণায় পাঠাবার সিদ্ধান্ত হয়। তৎকালীন সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এটি ছিল অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ। বাংলাদেশে পরবর্তীকালে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় তা প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা। এমনকি আমরা এখন মানসম্পন্ন যে শিক্ষার কথা বলছি, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সে-বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গতি থমকে যায়। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে এরশাদের স্বৈরশাসনকালে সিলেটে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কোনো নতুন বিষয় চালু হয়নি। এটি অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় যে, বঙ্গবন্ধু ঐ সময়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান ও আবহাওয়া ইনস্টিটিউট এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নতুন দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়াবলির ওপর গবেষণার জন্য আইবিএস প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেটি এতদসংশ্লিষ্ট গবেষণার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে।
১৯৭৩ সালে প্রণীত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভাবানার যে প্রতিফলন ঘটে, তারই আলোকে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হাতে নেন। এরই অংশ হিসেবে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু চার-দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়। ২০০৮-এ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা আবার বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু করেন।
এখানে একটা লক্ষ্য করার বিষয় হলো, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়Ñ এ ধারণা প্রকৃতপক্ষে একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার উদ্যোগ। বৈশ্বিক আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার সাথে সংগতি রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা লক্ষ করব যে, ১৯৭৩-এর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষার সাথে কাজের সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘Education must be responsive to the specific requirements of the nation. It must have relevance to future work and life, and must provide and adequate preparation for productive employment.’ শেখ হাসিনার মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার বিষয়টি, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই প্রাপ্ত।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে প্রচুর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন, তা বঙ্গবন্ধুর মতো শেখ হাসিনাও অনুধাবন করেন। এজন্য তিনি বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ও প্রধানমন্ত্রী বৃত্তি চালু করেছেন। এই বৃত্তির আর্থিক মূল্য এত সম্মানজনক যে, পৃথিবীর যে কোনো দেশে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে পিএইচ.ডি বা মাস্টার্স করে ফিরে আসা যায়। এসব ফেলোশিপ বা বৃত্তির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনও বর্তমানে অত্যন্ত সম্মানজনক হারে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বৃত্তি প্রদান করছে।
শুধুমাত্র বৃত্তি প্রদান নয়; বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রেখে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নতুন বিষয় খোলা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যে সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা তার ধারাবাহিকতায় মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছে। মূলত মিয়ানমারের সাথে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পর এ বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেশে ভূমি-সংক্রান্ত বিবাদ ও ভূমির হিসাব যেহেতু অনেকটা জটিল বিষয়, এজন্য ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নতুন বিষয়ও চালু হয়েছে। এগুলোর সবই মানুষের দৈনন্দিন জীবন পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্ট। বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীদের যাতে দূর-দূরান্তের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে না হয়, এজন্য বেশিরভাগ পুরনো জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পাশাপাশি তরুণ-তরুণীরা যেন মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠতে পারে, সেজন্য সাহিত্যের বিষয়াবলিকেও পাঠ্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সময়োপযোগী শিক্ষা অর্জনের কৌশল হিসেবে বলা হয়েছে, ‘Efforts will be made to improve the quality of Education by making an optimum use of the available facilities and increasing the number of trained teachers…’ ঠিক একইভাবে শেখ হাসিনা শিক্ষার গুণগত মানের ওপর জোর দেন। শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই এ বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। Higher Education Quality Enhancement Project (HEQEP) নামীয় এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন বিভাগ/ডিসিপ্লিনের কারিকুলাম সময়োপযোগীকরণ, নতুন ল্যাবরেটরি স্থাপন, ল্যাবরেটরিতে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের শিক্ষা পদ্ধতির সাথে শিক্ষকদের যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি আধুনিক ও উন্নতমানের শ্রেণিকক্ষ তৈরি করা শুরু হয়। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের পাশাপাশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি করে স্মার্ট ক্লাসরুম তৈরি করা হয়, যেখানে ইন্টারনেট ও ওয়েবক্যামেরাসহ সব আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা রাখা হয়। শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসরুমে বসে একই শিক্ষকের ক্লাসে যাতে অংশ নিতে পারেন, সেজন্যই এ ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে কোনো ক্লাসরুমে প্রবেশ করলে শিক্ষার্থীদের যেন মন ভালো হয়ে যায়, তারা হীনমন্যতায় না ভোগে সেজন্য সবকিছু আধুনিকায়ন করা হয়। এই HEQEP প্রকল্পের বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজস্ব খাতে প্রতি বছরের গবেষণা বরাদ্দ যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের অর্থও বেড়েছে প্রায় শতভাগ। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বিভিন্ন সময়ে ক্রয় করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে। কিন্তু গত তিন-চার বছর বার্ষিক রাজস্ব বাজেটেও প্রচুর অর্থ প্রদান করা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো উন্নয়নও হচ্ছে অকল্পনীয় গতিতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক সভায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে সর্বদা ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প একনেক সভায় উত্থাপিত হলে প্রধানমন্ত্রী এটি ফেরত পাঠান এই বলে যে, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম অর্থ প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি অর্থ বাড়িয়ে প্রকল্পটি যেন দ্রুতই পুনঃউপস্থাপিত হয় সে-বিষয়েও তিনি তাগিদ দেন। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এ ধরনের ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ পায়নি। শেখ হাসিনা শুধু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তার কাজ শেষ করেন তাই নয়, তিনি অর্থের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কি না, সে-বিষয়ে খোঁজখবর নেন। শিক্ষকবৃন্দ নিয়মিত শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেন কি না, সে-ব্যাপারে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। নতুন ইনোভেশনের ওপর তিনি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। বাংলাদেশে University-Industry Collaboration-এর বিষয়টি খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। উন্নত দেশে নতুন নতুন পণ্য বিষয়ে গবেষণার জন্য শিল্পের মালিকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, জাপানের টয়োটা কোম্পানি স্বল্প খরচে আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব গাড়ি তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গড়ঃড়ৎ গবপযধহরপধষ বিভাগকে গবেষণার দায়িত্ব দেয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষকগণকে প্রচুর আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। শেখ হাসিনা প্রথম এ বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন এবং HEQEP-এর কয়েকটি প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাটকাঠি, আখের ছোবড়া প্রভৃতি দিয়ে পার্টিকেল বোর্ড তৈরির একটি প্রকল্পে আকিজ গ্রুপ যুক্ত ছিল। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিল্প-কারখানার যৌথ গবেষণার উদ্যোগ এগিয়ে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি এরই মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে, তা হলো Institutional Quality Assurance Cell (IQAC প্রতিষ্ঠা। এ সেলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার মান বজায় রাখার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে। এ প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো অনুমোদিত হয়ে এখন এটি রাজস্ব খাতের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে।
IQAC-এর মাধ্যমে প্রতিটি ডিসিপ্লিনে আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষা প্রদানে কী কী প্রয়োজন, কী ধরনের সমস্যা রয়েছে তা চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করে। এর ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে তাদের চাহিদা উপস্থাপন করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর বিভাগসমূহ আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে কী অবস্থানে রয়েছে, তা নিরূপণের জন্য বিভাগভিত্তিক পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ টিমে দুজন করে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও দুজন দেশি বিশেষজ্ঞ কাজ করেছেন। দেশি বিশেষজ্ঞদের পূর্বেই বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে IQAC-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকবৃন্দ এই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এভাবে বিভাগগুলোতে তাদের অবস্থা ও অবস্থান বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং বিভাগগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের বিপ্লব। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গত ১০-১২ বছরে কত ধরনের কাজ হয়েছে, তা বাইরে থেকে অনুমান বা অনুধাবন করা সম্ভবপর নয়। এটি শুধুমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আগ্রহ, নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার জন্যই সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের জন্য এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পাঠদানকালে নবীন শিক্ষকবৃন্দ তাদের জ্যেষ্ঠ কোনো শিক্ষককে অনুসরণ করেন।
বর্তমান সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের জন্য একটি নতুন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। শিক্ষাদান পদ্ধতিও (Pedagogy) যে একটি বিজ্ঞান এবং এটিকে যে অনুশীলন ও চর্চা করতে হয়, তা বর্তমান সরকার বা শেখ হাসিনা অনুধাবন করেছেন। ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের IQAC এ কাজটি সম্পন্ন করছে। এর পাশাপাশি ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগ ও পরামর্শে CETL (Centre of Excellence Teaching and Learning) নামে একটি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে সরকার এই ধারণাকে গ্রহণ করে এটিকে প্রাথমিকভাবে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটিও এখন রাজস্ব খাতের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। IQAC এবং CETL-এর কাজ প্রায় একই রকম। তবে নবীন শিক্ষকদের যোগদানের পরপরই CETL তাদের একটি স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। বিগত ১২ বছরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় যে গুণগত ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তা স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কাজের পাশাপাশি শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। শিক্ষকবৃন্দ যাতে নিশ্চিন্তে গবেষণা করতে পারেন, সে-বিষয়ে জাতীয় বেতন স্কেলে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, এমন কিছু বিষয় সামনে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগেই এ সমস্যার সমাধান হয়। জন্মদিনে শেখ হাসিনাকে নিরন্তর শুভেচ্ছা। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে অনেক জায়গায় অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে তার শিক্ষকদের প্রসঙ্গ এনেছেন। ঠিক একইভাবে শেখ হাসিনাও তার শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন। আমরা শিক্ষকবৃন্দ এই সম্মানের মর্যাদা রক্ষা করব এবং সার্বিকভাবে এই শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি তার যে দরদ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তা অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে বাংলাদেশের সর্বস্তরের শিক্ষক প্রত্যাশা করে।
শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবী হোন।
লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ উত্তরণ