ঘাতক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারে জননেত্রী শেখ হাসিনা

2462

Published on সেপ্টেম্বর 22, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী:

’৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ৯টি মাস পাকিস্তান ও তার স্থানীয় দোসররা মিলে আমাদের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক মা-বোনের। ঘর ছাড়া করেছে কয়েক কোটি আর দেশান্তরী করেছে ১ কোটি মানুষকে। অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, পোড়ামাটি নীতিসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে নির্দ্বিধায়। পাকিস্তানের পদলোহীদের মধ্যে ছিল কতিপয় দক্ষিণপন্থি দল, যার শীর্ষভাগে ছিল জামাত। এই অল্প সময়ে এতটা তাণ্ডব সম্ভব হতো না, কিংবা বিজয়ের প্রাক্কালে দেশের সোনার সন্তানরা বেঘোরে মারা পড়তেন না, যদি জামাতের বিশেষ উদ্যোগ ও প্ররোচনায় রাজাকার শান্তি কমিটি, আলবদর আলশামস গঠিত না হতো এবং তারা হত্যাকারী ও পাকিস্তানিদের চোখ, কান ও চেতনা হয়ে কাজ না করত। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরেই এদের বিচারের দাবি সম্বলিত আন্দোলন মাথা চাড়ার আগেই বঙ্গবন্ধু ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য সন্দেহভাজন অপরাধীদের অনেককেই জেলে ভরা হয়। কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গিয়ে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও প্রত্যক্ষ আর্থিক সমর্থনে বাংলাদেশের স্বীকৃতিসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যান্য সদস্যভুক্তিকে প্রতিহত করতে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার জন্য জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ১৯৭৩ প্রণয়ন করেন। সময়াভাবে বড়সড় অপরাধীদের বিচারের আগেই পাকিস্তানি দুর্বৃত্তরা তাকে সপরিবারে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ঘাতক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের খপ্পরে চলে যায়।

ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্রাকারে হলেও আন্দোলন বহু বছর যাবত হয়েছে। তবে ১৯৯২ সালের আন্দোলন ও গণ-আদালতের মতো এমন ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন কমই দেখা গেছে। ১৯৯২ সালের আন্দোলনের পটভূমি বিশাল ও ব্যাপক; কিন্তু তার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযম কর্তৃক জামাতে ইসলামীর আমিরত্ব গ্রহণ। এর আগে জিয়াউর রহমানের কৃপায় পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযম বাংলাদেশে আসে এবং ১৯৭৮ সাল থেকে অবস্থান করে আসছিল।
এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একাংশের ব্যানারে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই বিক্ষোভের ঝড় থামার পূর্বেই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

এই কমিটি গঠন ও তার নেতৃত্ব নির্বাচনে শেখ হাসিনার একটা ভূমিকা ছিল। বস্তুত তারই উদ্যোগে ও বেগম সুফিয়া কামালের পরামর্শে শহিদ জননী জাহানারা ইমামকে নেত্রী নির্বাচন করা হলেও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ শেখ হাসিনার ছিল নিতান্ত সীমিত; কেননা, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তার নির্দলীয় চরিত্র রক্ষায় ব্রতী ছিল। ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে গোলাম আযম ও জামাতবিরোধী সংগঠন ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। ডিসেম্বর ’৯১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চের উদ্ভব হলেও তার পরবর্তী নামকরণ হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি’। বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে ঘাতকবিরোধী আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতাকে মনে রেখেই হয়তো গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ঐ প্রতিরোধ মঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছিল। ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটিতে রাজনীতিবিদসহ সমাজের সকল স্তরের ব্যক্তি বা সংগঠনের সংযুক্তির কোনো বাধা ছিল না। তাই দেখা গেল, চেতনা বাস্তবায়ন কমিটিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব ক’টি রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র-সংগঠন এবং আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অংশগ্রহণের সুযোগ এলো। শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগ থেকে আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক সাজেদা চৌধুরী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রাজ্জাক চেতনা বাস্তবায়ন কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব করেন। জাসদ থেকে কাজী আরেফ, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নূরুল ইসলাম নাহিদ এবং অন্যান্য দল থেকে বদরুদ্দিন ওমর, মোহাম্মদ আফজাল, খালেকুজ্জামান, আবদুল্লাহ সরকার প্রমুখ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট থেকে গোলাম কুদ্দুস চেতনা মঞ্চে সম্পৃক্ত হয়ে যান। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ছাড়া চেতনা মঞ্চের সদস্য সংখ্যা ৪৭-এ উন্নীত হলো।

চেতনা মঞ্চ ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রারম্ভিক লক্ষ্য ও কৌশল এক ছিল না, এমনকি গণ-আদালত অনুষ্ঠানের প্রশ্নে দুটোর মধ্যে মতানৈক্য ছিল। এ কারণে ঘাতকবিরোধী আন্দোলনে গতি সঞ্চার হচ্ছিল না। এ বিষয়টি ছাত্র-সংগঠনগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং রাজনীতিবিদদের ওপর এককেন্দ্রিক ও একমুখী আন্দোলনের জন্য তারা চাপ সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিও উপলব্ধি করে যে জামাতের মতো একটি ফ্যাসিস্ট দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে এবং শেষমেশ গোলাম আযমকে আইনি প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ করতে হলে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদ, ঘনিষ্ঠ সংঘবদ্ধতা ও একাত্মতা প্রয়োজন। অবশ্য তদানীন্তন বিএনপির একাংশের সমর্থন পেতে প্রথম থেকে তারা চেষ্টিত ছিল। সেটা অসম্ভব প্রমাণিত হতে শুরু করলে এবং সমন্বয় কমিটির আওয়ামী লীগপন্থিদের প্রচণ্ড চাপে তারাও জোটবদ্ধ আন্দোলন ও তার সাথে আওয়ামী লীগের গভীর সম্পৃক্ততা আশা করছিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রদের প্রচেষ্টা তীব্রতর হওয়ার প্রেক্ষিতে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে দুটো সংগঠনকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। সংক্ষেপে এর নাম রাখা হয় ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। শহিদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক ও অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরীকে সদস্য সচিব নির্বাচন করে ৪৯ সদস্যের জাতীয় সমন্বয় কমিটির আত্মপ্রকাশে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে ২৬ মার্চ গণ-আদালতে গোলাম আযমের প্রকাশ্য বিচারের প্রশ্নে একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই লক্ষ্যে আন্দোলন এগিয়ে চললেও তার তীব্রতা তেমন একটা লক্ষ করা যায়নি। তার প্রধান কারণ ছিল আন্দোলনের মঞ্চে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতি। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে সমন্বয় কমিটির মঞ্চে আসেন।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের মাঝামাঝি জায়গায় সমন্বয় কমিটি একটি মঞ্চ তৈরি করে। সেই মঞ্চ থেকে ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির প্রত্যয়ে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখছিলেন এবং শহিদ জননী জাহানারা ইমাম সভাপতিত্ব করছিলেন। এক পর্যায়ে পরিশ্রান্ত জাহানারা ইমাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটি বাসায় খানিক বিশ্রামের জন্য চলে যান। তখন মঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী। সে-সময়ে আওয়ামী লীগের মিছিলটি শহিদ মিনারের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ মিছিলের পুরোভাগ থেকে সরে এসে শেখ হাসিনা সমন্বয় কমিটির মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি মঞ্চে এলেন এবং নাতিদীর্ঘ একটি বক্তব্য রাখলেন। তিনি যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন সেই এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ল। আমাদের মনে গভীর বিশ্বাস ও আশ্বস্ততা জন্ম দিল এবং আমি সেদিন উপলব্ধি করলাম যে যুদ্ধে পিঠ বাঁচিয়ে বুক এগিয়ে দেওয়ার একটা জায়গা পাওয়া গেল।

২২ ফেব্রুয়ারি থেকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রতি ব্যাপক হারে ঝুঁকতে আরম্ভ করল আর তার দেখাদেখি অন্যান্য ছোট-বড় সংগঠন কিংবা ব্যক্তিগণ আন্দোলনমুখী হতে শুরু করলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত সমন্বয় কমিটির কর্মকা- প্রসারিত হতে হতে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছল যে, তখন ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রায় নিষ্প্রভ হয়ে গেল। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি-সহ তখন সমন্বয় কমিটির সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল ৭১-এ। কিন্তু যেহেতু ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ও জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক একই ব্যক্তি অর্থাৎ শহিদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন, সেহেতু সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অসাধারণগণও সমন্বয় কমিটিকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। পরবর্তী সময়ে ঘাতকের মুখপত্রগুলো এই কমিটির সংক্ষিপ্ত নাম ঘাদানিক রাখায় আন্দোলনকারীগণ ঐ নামটির বদলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটিকেই সংক্ষেপে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বলেই কণ্ঠস্থ ও আত্মস্থ করে নিল। ৩ মার্চ আন্দোলনের তিন নেত্রী এক মঞ্চে বসলেন। সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে সভাটি আমি পরিচালনা করেছিলাম।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এই মঞ্চ তৈরি হলো। মঞ্চে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহান জাতির মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামাল ও শহিদ জননী জাহানারা ইমাম। বলতে গেলে আওয়ামী লীগের একক প্রয়াসে জনসভা লোকে লোকে ভরে গেল। সেদিনের মতো সমন্বয় কমিটির এত বড় সভা এর আগে হয়নি। এর আগের প্রতিটি সভার উপস্থিতি ছিল যৎসামান্য সর্বোচ্চ ৫০০ জন। জনসভার এই ব্যাপকতার অন্যতম কারণ ছিল নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার উপস্থিতি। আজ একটা কথা নির্দ্বিধায় বলতে হয়, আমার প্রতি শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ সমর্থন আমাকে দুঃসাহসী করে তুলেছিল। সেদিন থেকে আমি গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ হলাম।

এরপর আমরা যতগুলো সমাবেশ করেছি ততগুলোতে প্রতিদিনই বাড়তি উপস্থিতি লক্ষ করি। কয়েকদিন পরই জাতীয় সমন্বয় কমিটির কেন্দ্রীয় পরিষদের কাঠামোগত আদলে ঢাকা মহানগর জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হলো। এই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া; সচিবও ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ সমর্থক। নেত্রীর দ্ব্যর্থহীন সমর্থনে সমন্বয় কমিটি সবাইকে চুম্বকের মতো টানছিল। আওয়ামী লীগ সমর্থক অন্যদের উপস্থিতিও আন্দোলনে কাক্সিক্ষত তীব্রতা লাভ করল। ঢাকাসহ আন্দোলন গ্রামান্তরে ছড়িয়ে গেল। বিদেশেও কমিটি হতে শুরু করল। তবে নেতৃত্বে প্রায় সর্বত্রই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের প্রাধান্য লক্ষিত হলো। সারাদেশে মনে হলো এক উত্তাল জনজোয়ার। এবারে ২৬ মার্চের গণ-আদালতে সফলতা নিয়ে আর সংশয় কারও মনে রইল না। প্রতিদিনই বিভিন্ন ঘটনা ও রটনায় এমনকি হুমকি-ধমকিতে আমরা অটুট ও অটল রইলাম। এ-সময়ে যুবকমান্ড, ফ্রিডম পার্টি, জামাত-শিবির, ছাত্রদল ও বিএনপির অত্যাচারে জর্জরিত নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার কাছে আশ্রয় খুঁজে পেল।

ইতোমধ্যে ২৪ মার্চ গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করা হলো এবং আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হলো এবং আড়ালে-আবডালে ডেকে জীবননাশ, পরিবার ধ্বংস ও সন্তান-সন্ততির ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। গোলাম আযমকে গ্রেফতারের পরই আন্দোলনের একাংশ সরকারের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে গণ-আদালতের পরিবর্তে ২৬ মার্চ একটি গণসমাবেশ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় আমি, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ হন্তদন্ত হয়ে শেখ হাসিনার বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসায় ছুটে যাই। সেদিন শেখ হাসিনা শুধুমাত্র আমাদের মনোবল ধরে রাখেননি, তিনি আন্দোলনের সকল দায়-দায়িত্ব নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এ-সময়ে বাজারে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে ২৬ মার্চ গণ-আদালতে গেলে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রক্তগঙ্গায় ভাসানো হবে। আন্দোলনকারীদের একাংশ এ-কথা বিশ্বাস করেছিল। এমনি মুহূর্তে শেখ হাসিনা এই পরিকল্পিত রক্তগঙ্গা প্রতিহতের দায়িত্বও গ্রহণ করেন।

২৫ তারিখ সন্ধ্যার দিকে এ-কথা জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছিল যে, আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীগণকে আজই গ্রেফতার করা হবে। গ্রেফতার আশঙ্কা আঁচ করে শেখ হাসিনা গণ-আদালতের উদ্যেক্তাদের প্রায় সকলকে তার বাসায় রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করলেন। সেদিন রাতে তার বাসাতে আমিসহ বেশ কয়েকজন ছিলাম। সে-রাতেই তার বাসায় গণ-আদালতের সওয়াল জবাব ও রায়ের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়।

২৬ তারিখ সকালবেলা শেখ হাসিনা তার বাসা থেকে স্মৃতিসৌধের দিকে রওয়ানা হলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের দিকে যাবার আগে আমি তার কাছে এমন সব নির্দেশনা পেলাম, যা সেদিনের গণ-আদালতকে সফল করতে সাহায্য করেছিল। ২৫ তারিখ রাতেই শেখ হাসিনা গণ-আদালতে ব্যাপক উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। আমরাও জানতাম যে শেখ হাসিনা আমাদের সাথে আছেন, যা আমাদের মনোবলকে চাঙ্গা রেখেছিল। বিএনপি ও জামাত-শিবিরের প্রচণ্ড বিরোধিতা ও কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও গণ-আদালত ২৬ মার্চে অনুষ্ঠিত হলো। গণ-আদালতের অব্যবহিত পরেই শেখ হাসিনার একটি চিঠি সেখানে পড়ে শুনানো হয়। এই চিঠি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ বহু কটূ ও রূঢ় মন্তব্য করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম যে, সে-চিঠির লক্ষ্য ছিল সবাইকে জানান দেওয়া যে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ জনগণের এই দাবির সাথে একাত্ম আছে ও থাকবে।

গণ-আদালতের পরেই আমাদের ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো। এ-সময় আবারও আন্দোলনকারীদের আগলে রাখতে ও সার্বিক সহায়তাদানের জন্য শেখ হাসিনা এগিয়ে আসেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় জামিন পেয়ে আমরা আরও উৎসাহ নিয়ে আন্দোলনে নামলাম। এবারে শেখ হাসিনা সংসদের অভ্যন্তরে আন্দোলনকে টেনে নিলেন। তারই নেতৃত্বে ১০০ জন এমপি ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ২৪ জন তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহীর মুক্তির জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন ও সংসদ বর্জনও শুরু করেন। একদিন শেখ হাসিনা গোলাম আযমের বিচারের যৌক্তিকতা নিয়ে সংসদে এক অনন্য, তথ্যবহুল ও আবেগময় বক্তব্য রাখেন। সংসদের ভিতরে তার আন্দোলন ও বাইরে জাতীয় সমন্বয় কমিটির আন্দোলনে সরকার গোলাম আযমের বিচারের দাবি ও ২৪ জন বরেণ্য ব্যক্তির মুক্তির ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে একটি চার-দফা চুক্তি স্বাক্ষর করল। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর সমন্বয় কমিটির আন্দোলনের নৈতিক বিজয় সূচিত হলো।

তারপরও আন্দোলনের সাথে শেখ হাসিনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। সমন্বয় কমিটির সম্পূরক হিসেবে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের ব্যাপারেও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ছিল। বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারপারসন। এই গণতদন্ত কমিশন আরও ১৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে শনাক্ত করতে সমর্থ হয়। দু-দফায় তাদের নাম গণসমাবেশে প্রকাশ করা হয়। এসব সমাবেশ ছাড়াও বেশ কিছু সমাবেশে শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থাকতেন কিংবা মো. জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীসহ দলের সিনিয়র-জুনিয়র সব নেতার উপস্থিতি নিশ্চিত করতেন। কখনো কৌশলি পদক্ষেপ নিতেন। তাই সমন্বয় কমিটির সকল সমাবেশ, পথযাত্রা, মানববন্ধন, হরতাল, ঘেরাও কিংবা ২৫-এর কালরাতের মিছিলে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা ব্যাপকতর হয়। আন্দোলনের পেছনে তার আর্থিক সহযোগিতাও বিদ্যমান ছিল।
আন্দোলনের এই পর্বে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহিদ জননী জাহানারা ইমাম মরণব্যাধি ক্যানসারে উত্তরোত্তর আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগ করেন। তার মরদেহ বিমান বন্দরে শেখ হাসিনা গ্রহণ করেন এবং তার দাফনকাফনের ব্যাপারে তো বটেই, তার শোকসভায় সশরীরে শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকেন এবং অসমাপ্ত আন্দোলনের প্রতি আবারও সমর্থন ব্যক্ত করেন, এমনকি জাহানারা ইমামের পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচনে ও আন্দোলনকে চলমান রাখার ব্যাপারে তিনি বহুবিধ বৈষয়িক ভূমিকা পালন করেন। আবারও তারই পরামর্শে বেগম সুফিয়া কামালকে জাহানারা ইমামের স্থলাভিষিক্ত করা হয়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পর অনেকের মতে ঘাতকবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা কমে গিয়েছিল। তবে আমার মতে তখন ঘাতকবিরোধী আন্দোলনে স্বস্তিবোধ ফিরে আসায় এক ধরনের স্থবিরতার জন্ম হয়েছিল। তবুও সময় ও সুযোগমতো সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দ ঘাতকবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এক পর্যায়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের আইন মোতাবেক একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিলেন, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে সম্ভবত আলোর মুখ দেখেনি।

২০০১ সালের নির্বাচনে সমন্বয় কমিটির একটা ভূমিকা ছিল। তারা আশান্বিত ছিল যে এই নির্বাচনে বিজয় অর্জিত হলে ঘাতকদের বিচার সম্ভব হবে। কিন্তু ২০০১-এর অপনির্বাচনে আমাদের সকল আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীগণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মতোই নির্যাতন, হয়রানি এবং দেশান্তরী হয়ে কোনোরকম নাকটা জাগিয়ে রাখে। তাদের অনেকেই জেল-জরিমানা, অবর্ণনীয়-নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হয়। এ-সময় শেখ হাসিনা ও তার দলই ছিল একমাত্র আশ্রয়স্থল। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তাদের আদর্শগত ঐক্য ও সখ্যতা বিরাজমান ছিল। আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, অর্থাৎ অন্যান্য বহু বিষয়ের মধ্যে ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেটও লাভ করে। এই নির্বাচনের মাত্র এক মাসের মাথায় ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয় এবং একই সাথে ১৯৭৩ সালের আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়। সংসদ নেত্রী ও সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার হতে আরম্ভ করে মন্ত্রীদের অধিকাংশই ঘাতক নির্মূল আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বিধায় ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াটি বেগবান হয়।

শত প্রতিকূলতার মাঝে বিশেষত কতিপয় পরদেশী এবং পরাশক্তির অর্থহীন বিরোধিতা, ভ্রুকুটি ও ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে প্রায় অর্ধশতাধিক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারকাজ সমাপ্ত করে প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। এদেশে কেউ স্বপ্নেও দেখেনি কিংবা অবচেতন মনেও ধারণা করেনি যে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, আবদুল আলিম, মীর কাশেম আলী, কামরুজ্জামান, কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদেরের মতো দুর্ধর্ষ ঘাতক, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের টিকিটি কেউ স্পর্শ করতে পারবে। দেশরত্ন শেখ হাসিনাই এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। আজকে তার জন্মদিনে, আমি তার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি যেন তিনি প্রতিনিয়ত আমাদের মুখোজ্জ্বল করে যেতে পারেন।

যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে তাকে সরিয়ে ফেলার অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ছিল, পশ্চাদে টানার লোকের অভাব ছিল না। বিএনপির অত্যাচার-নির্যাতন ছিল। আন্দোলনকারীদের অনেকেই তাকে অবমাননাকর অবস্থায় ঠেলে দিয়ে নিষ্ক্রিয় রাখার চেষ্টায় ছিল। এসব তাকে নিরুৎসাহিত করেছিল বলে আমার মনে হয় না।

জীবদ্দশায় জাহানারা ইমাম দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থেকে বিরত ছিলেন অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন অপেক্ষা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে দেশরত্ন শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সজ্ঞানে ও স্বচিন্তায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। পরিণামে তাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে অন্তত ২১-দফা সশস্ত্র হামলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় অদম্য সাহসিকতা, দৃঢ়চিত্ততা ও লক্ষ্যের প্রতি একনিষ্ঠতা শুধু তার জীবনকে ঝুঁকিময়ই করেনি, তার পরিবারের সদস্যদের চরম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারপরেও তিনি হাল ছেড়ে দেওয়ার নন। আশা করি, তার শাসনামলে শুধু যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীরাই নন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হন্তারক ও ২১ আগস্টের ঘৃণ্য ঘাতকরা কিংবা তাদের শাখা-প্রশাখা, পোষ্য ও আদর্শের সৈনিকসহ নিকট ও দূর-সুবিধাভোগীরা বিচারিক প্রক্রিয়ায় নির্মূল হবেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত