2469
Published on সেপ্টেম্বর 21, 2020আবদুল মান্নানঃ
২০২০ সালটা মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি ভয়াবহ বছর হিসেবে উল্লিখিত থাকবে। কারণ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই কভিড-১৯, যার প্রচলিত নাম করোনা, তার আগ্রাসনে ধরাশায়ী ছিল। এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কারণে এই কভিড-১৯ সৃষ্ট রোগকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি বা অতিমারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এর আগে সর্বশেষ এমন এক ধ্বংসাত্মক মহামারি বিশ্বকে আঘাত করেছিল গত শতকের গোড়ার দিকে, যার বিস্তার সীমাবদ্ধ ছিল ইউরোপ ও পূর্ব আমেরিকায়। এই মহামারির নামকরণ হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু, যদিও ওইটাও একটি কভিড ছিল। স্প্যানিশ ফ্লুতে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তার সঠিক হিসাব মেলা কঠিন। ধারণা করা হয়, পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আক্রান্ত হয়েছিল ৫০ কোটি। হিসাবে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল পৌনে সাত লাখে। তারও ১০০ বছর আগে আরেক প্রাণঘাতী মহামারি প্লেগ ইউরোপে হানা দিয়ে কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। ধারণা করা হয়, প্রতি ১০০ বছরে এ রকম একটা মহামারি বিশ্বে হানা দেবে এবং প্রচুর মানুষের প্রাণহানি হবে।
এই শতকের শুরুর দিকে বিশ্বের কোনো কোনো দেশে সার্স ও ইবোলা নামের একটি ভাইরাসের আবির্ভাব হয়েছিল। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, এগুলোও মহামারি আকার ধারণ করবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করেনি। কারণ তার আগেই এ রোগের প্রতিষেধক বাজারে এসে গিয়েছিল, মানুষ হয়েছিল সচেতন। বর্তমান এই ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক করোনার বিস্তার আর প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব; আর এই রোগ সম্পর্কে আগাম কোনো ধারণা না থাকায় পরিস্থিতি শুরু থেকেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তার ওপর ছিল না কোনো প্রতিষেধক ব্যবস্থা। এই প্রাণঘাতী ভাইরাসটার জন্ম চীনে। গত বছরের শেষের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। এই ভাইরাসের কারণে চীনে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা বলা মুশকিল। কারণ চীন থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া সহজ নয়। বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষের এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজ চলাচল। কেউ যাচ্ছে ব্যবসার কাজে, কেউ দাপ্তরিক কাজে, আবার কেউ বা ছুটি কাটাতে। কেউ যায় একা, কেউ বা দলবদ্ধ হয়ে পরিবার নিয়ে। মানুষ বা অন্য যেকোনো প্রাণী হচ্ছে বেশির ভাগ ভাইরাসজনিত রোগের বাহক। একজন মানুষই একটি দেশে যেকোনো রোগ ছড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। এবার তা দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘটেছে। বাংলাদেশে করোনা এসেছে একজন ঘরে ফেরা প্রবাসীর সঙ্গে। সেটি গত মার্চের প্রথম দিকে। সরকার প্রথম দিকে চেষ্টা করেছিল দেশে ফেরা এসব প্রবাসীকে সপ্তাহ দুয়েক পৃথক করে রাখতে। সফল হয়নি। বাংলাদেশকে মা-বাপ তুলে গালাগাল দিয়ে তারা নিজেদের গন্তব্যে চলে গিয়েছে। তারপর পুরো পরিস্থিতি খারাপ হওয়া শুরু হলো। বন্ধ হওয়া শুরু হলো সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, আন্ত জেলা চলাচল, মুদি দোকান থেকে শুরু করে শপিং সেন্টার, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা। স্বাভাবিকভাবেই দেশ পড়ে গেল এক মারাত্মক আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের মুখে। এমনটি শুধু বাংলাদেশে ঘটেছে তা নয়; বিশ্বের প্রায় ২১০টি দেশ এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়ল। করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটল ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, ইরান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত প্রভৃতি দেশে। সব দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ধস নামার কারণে লাখ লাখ মানুষ বেকার হওয়া শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে থাকে।
মার্চে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের সরকার বা মানুষ অনেকটা অন্ধকারে থাকলেও এর প্রকোপ বুঝতে দেরি হয়নি। যখন সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল, তখন দেখা দিল যারা দিন আনে দিন খায় তাদের না খেয়ে থাকার অবস্থা। এই সময় সরকারের দ্রুত পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের কোনো মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থায় মানুষের দোরগোড়ায় বিনা মূল্যে খাদ্য পৌঁছে যাওয়া শুরু হলো। যেকোনো মানদণ্ডে এটি একটি অসাধারণ কর্মসূচি। বাংলাদেশের অনেক রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের অর্ডার বাতিল হওয়া শুরু করলে এই ব্যবসার জড়িতরা পড়ল বিপদে। শ্রমিকরা নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। যেসব দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের বিমানবন্দর ও নৌবন্দর বন্ধ করে দিলে পণ্য রপ্তানির আর কোনো উপায় থাকল না। এখানেও সরকার এগিয়ে এলো। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলো স্বল্পসুদে ঋণসহ আরো নানা রকমের সুবিধা আর প্রণোদনা। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসাব কষে বলল—সব দেশের গড় প্রবৃদ্ধি শুধু থমকে দাঁড়াবে না, উল্টো দিকে নামা শুরু করবে। গত আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের এক প্রতিবেদনে জানাল, ২০২০ সালে বিশ্বের অনেক দেশের গড় প্রবৃদ্ধি মাইনাস হবে। হিসাব করে দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি হবে মাইনাস ৫.৯ শতাংশ আর ইতালির মাইনাস ৯.১ শতাংশ। বেশির ভাগ দেশেরই একই অবস্থা। শুধু ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ১.৯ শতাংশ আর চীনের ১.২ শতাংশ। আর বাংলাদেশ? আঁতকে ওঠার মতো তথ্য। এই সময়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হয়েছে ৩.৮ শতাংশ। এর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাব করেছিল ৫ শতাংশের মতো। এ নিয়ে সিপিডির সে কী হৈচৈ! হতেই পারে না। যখন আইএমএফ তাদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করল, তখন কাউকে আর উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেল না।
যাঁরা বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র বা অর্থনীতির অবস্থার ভালো খবরে হৈ-হট্টগোল করেন (বিএনপির মির্জা ফখরুল আর রিজভী আহমেদ বাদে), তাঁদের একটু বেকায়দায় ফেলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) গত ১৪ সেপ্টেম্বর জানাল, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ৬.৮-এ দাঁড়াবে। এর আগে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, কভিড-১৯-এর কারণে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা বলে, ‘আশা করা গিয়েছিলে এই বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি ৮.১৫ পর্যন্ত হতে পারে; কিন্তু কভিডের কারণে সারা বিশ্ব যে বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার প্রভাবে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দুই থেকে তিনের মধ্যে থাকতে পারে এবং তা যদি হয়, তবে বাংলাদেশের স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে এটি হবে সবচেয়ে খারাপ চিত্র। শুধু ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে এই সংখ্যা ২.৬১ শতাংশে ছিল। তখন ক্ষমতায় ছিলেন সেনাশাসক এরশাদ। বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ সাধারণত কিছুটা রক্ষণাত্মক হয়ে থাকে। তাদের পরিসংখ্যানের সঙ্গে আইএমএফ, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ও এডিবির পরিসংখ্যান একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে কিছুটা বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়।
এডিবি তাদের পরিসংখ্যানের পেছনে যুক্তি হিসেবে বলেছে, ‘এটি এখন পরিষ্কার যে বাংলাদেশ তার থমকে যাওয়া অর্থনীতির চাকা আবার চালু করেছে। তাদের শিল্প-কারখানা (ক্ষুদ্র ও মাঝারি) আবার চালু হয়েছে। দেশটির রপ্তানিপণ্য নতুন নতুন গন্তব্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি সত্য যে শুরুর দিকে মহামারি দেশটিকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল। তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা খাতে বেশ চাপ সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু সরকার এ পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবেলা করেছে এবং শুরুর দিকে সরকার ব্যবসা ও সামাজিক খাতের সুরক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা ভালো ফল বয়ে এনেছে। নিম্নবিত্তদের সুরক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তা-ও ফলপ্রসূ হয়েছে।’ (ইংরেজি থেকে অনুবাদ)
এটি সত্য যে কভিড-১৯ যখন বাংলাদেশে হানা দেয়, তখন এটার ভয়াবহতা সম্পর্কে সরকার বা কারো কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর একাধিক দ্রুত পদক্ষেপে পরিস্থিতি যতটা খারাপ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, ততটা হয়নি; যা এখন এডিবির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এই কয় মাসে একাধিক মাপকাঠিতে অনেক এগিয়ে আছে। দেশে রেমিট্যান্স বেড়ে এখন প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এটি হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ, সরকার ঘোষিত ২ শতাংশ প্রণোদনা। তৈরি পোশাক আমদানিকারকরা আবার বাংলাদেশে ফিরছে। বিদেশ থেকে যেসব শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছিল, তারা আবার নিজেদের কর্মক্ষেত্রে ফেরা শুরু করেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এ মুহূর্তে ৩৯ বিলিয়ন ডলার, যা একটি রেকর্ড। স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা আবার চালু হয়েছে। গতবারের বোরো ফসলের মতো এবারের আউশ ফসলের ভালো ফলন হয়েছে। ন্যায্য দামের নিশ্চয়তা দিয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো সরকারের দায়িত্ব। দেশের কৃষিমন্ত্রী একজন দক্ষ মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। নিজে একজন কৃষিবিদ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষির অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন শুধু শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফেরার পালা। তা-ও দ্রুততম সময়ে হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক বিশ্লেষক বাংলাদেশকে একটি রহস্যময় অর্থনীতির দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁদের এই মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলতে হয়, এখানে রহস্যের কিছু নেই। এ দেশের মানুষ অত্যন্ত পরিশ্রমী। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক আরব দেশে তারা গিয়ে দেখিয়েছে কেমন করে মরুভূমিতেও ফসলের আবাদ করা যায়। তাদের প্রয়োজন একটু সহায়তা আর সঠিক নেতৃত্ব, যা সব সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ