9996
Published on সেপ্টেম্বর 15, 2020মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী:
বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগকে- সংক্ষেপে বাকশাল নামে ডাকা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হওয়ার পর সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সংবিধানের নতুন এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করার সাংবিধানিক বিধান কার্যকর হয়। এর ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ভেঙ্গে যাওয়ার বিধানও কার্যকর হয়। সংবিধানের এই ধারা মোতাবেক ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(মোজাফফর) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি(সি.প.বি.) একত্রিত হয়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ(বাকশাল) গঠন করে। পরে এই দলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, কৃষক-শ্রমিক কর্মচারীসহ জাতীয় নতুন দলের আদর্শের প্রতি আস্থা স্থাপন করে অসংখ্য মানুষ নয়া রাজনৈতিক দল বাকশালে যোগদানের আবেদন করেছিলেন। দলটি বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনৈতিক দলের মতো প্রতিষ্ঠা, সদস্য হওয়া বা কার্যক্রম পরিচালনা থেকে সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে গড়ে ওঠা, কার্যক্রম পরিচালনা করা, সদস্য হওয়া, দায়িত্ব পালন করা ইত্যাদি নিয়ম প্রবর্তন শুরু করেছিলো। ৭ জুন তারিখে এর গঠনতন্ত্র ও সাংগঠনিক কাঠামো ঘোষিত হয়। বাকশালের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে এই সময় থেকে শুরু হলেও ১৫ই আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্র ক্ষমতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং সংবিধানবিরোধী শক্তির দখল করার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাকশালের অবসান ঘটানো হয়। তবে বাকশাল প্রথাগত রাজনৈতিক দলের চরিত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গঠন করেছিলেন। তাঁর সেই সব লক্ষ্য উদ্দেশ্য পরিকল্পনা চিন্তাধারা ২৫ জানুয়ারি সংসদে প্রদত্ত তাঁর ভাষণ, ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণ, ১৯ জুন তারিখে অনুষ্ঠিত বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁর প্রদত্ত ভাষণ, নবনিযুক্ত ৬১ জন গভর্নরের প্রশিক্ষণ উদ্বোধনকালে প্রদত্ত ভাষণ, ৩ পার্বত্য জেলার বিভক্তি উপলক্ষে ১২ই ফেব্রুয়ারি এবং ৮ মার্চ তারিখে টাঙ্গাইল মওলানা মোহাম্মদ আলী সরকারি কলেজ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণ এবং ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত থেকে নতুন এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের একটি ধারণা স্পষ্ট হয়। মূলত শোষণহীন, উন্নত, আর্থ-সামাজিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৫ পুর্ববর্তী অবস্থার পরিবর্তন সাধন করে জনগণের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিক ধারার পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক এবং জীবনবোধের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের নয়া ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে তাঁর নয়া রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। প্রতিষ্ঠাকালে দেশে জনগণের মধ্যে নতুন এই দলের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিলো, মানুষ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সূচিত ২য় বিপ্লবের কর্মসূচির প্রতি অনেক বেশি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করেছিলো। এটি লক্ষ্য সাধনের জন্য পর্যাপ্ত সময়ের দাবি রাখে। কিন্তু ১৫ই আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ড বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীগণ সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। ১৫ই আগস্টের পর থেকে বাকশাল স্বাধীনতা বিরোধী, অতিডান , অতিবাম, হঠকারী এবং নানা ধরণের উগ্র বিপ্লবী মতাদর্শে বিভক্ত বিভিন্ন গ্রুপের রাজনৈতিক সমালোচনা প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এটিকে তারা গণতন্ত্র হত্যা বা এক দলীয় স্বৈরতন্ত্র আখ্যায়িত করে সাধারণ মানুষ, নতুন প্রজন্মসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরণের ভীতি এবং বিভ্রান্তি তৈরির লক্ষ্যেই প্রচার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তবে সেই সময়ের ঘটনাবলী রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং রাষ্ট্রগঠনে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, স্বাধীনতা অর্জন এবং ১৯৭২ সালের ৪ জাতীয় মৌলিক নীতির আদর্শে একটি উন্নত আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের যে যাত্রা শুরু করে ছিলেন সেটিরই ২য় পর্যায় হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি-পরবর্তী ব্যবস্থা পরিবর্তনের উদ্যোগ হিসেবে বাকশাল কর্মসূচি দেখা ও বোঝার বিষয়।
বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তাঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমসাময়িক কালের রাজনৈতিক, দলীয় বেশিরভাগ নেতা থেকে অনেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। এর অন্যতম কারণ ছিলো। যে সময়ে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তখন একদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রাম, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের চূড়ান্ত লড়াই, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দলীয় অবস্থান থেকে ভারতের স্বাধীনতাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা এবং মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব, ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার নানান বাস্তবতা মিলিয়ে এমন এক ঐতিহাসিক কালপর্ব তখন অতিবাহিত হচ্ছিল, যখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার এক উত্তেজনাকর মুহুর্ত অতিবাহিত হচ্ছিল। এই সময়ে তরুন শেখ মুজিব কলকাতায় নানান রাজনৈতিক ঘটনা, দুর্ঘটনা, বিভাজন ইত্যাদির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার একজন প্রত্যক্ষ আন্দোলনের কর্মী হিসেবে যুক্ত রেখেছিলেন। ভারতবর্ষ তখন আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে একটি অভিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করবে, নাকি জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের গোলকধাঁধায় একাধিক রাষ্ট্রে আত্মপ্রকাশ করবে, নাকি সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসু যুক্ত বাংলায় স্বাধীন হবে এমন দোলাচল এখানে সবাইকে দ্বিধান্বিত করেছিলো। কেবিনেট মিশন অবশ্য ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ভিত্তিক ভারতীয় স্বাধীনতা দানে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু নেপথ্যের শক্তির প্রভাবে শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তানে গিয়েই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার রূপ নিলো। কিন্তু সাথে নিয়ে এলো ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত বাংলা, পাঞ্জাব সহ অনেক অঞ্চল, লক্ষ লক্ষ মানুষের উদ্ভাস্তু হওয়ার এক দীর্ঘমেয়াদী সংকট। এই সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তরুন শেখ মুজিব কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় ঠিকানাবিহীন ভাবে চলতে শুরু করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র যে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষা করবে না কিংবা প্রদান করবে না সেটি তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রদর্শন থেকেই বুঝে নিয়েছিলেন। সেকারণে তিনি ভাষা আন্দোলন এবং পাশাপাশি মুসলিম লীগ বিরোধী ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন এবং পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই সময়ে তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনকে সর্বাধিক গুরত্ব দিয়ে যে ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা সংগ্রাম শুরু করেন সেটি অচিরেই পাকিস্তান রাষ্ট্র শক্তির কোপানলে পড়ে। তিনি জেল জুলুম নির্যাতন বরন করেও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি এক মূহুর্তের জন্য ত্যাগ করেন নি। এই দাবির অন্তর্নিহিত রাষ্ট্র দর্শন হচ্ছে ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা অধিকার লাভ করা। পাকিস্তান সেই রাষ্ট্র কাঠামোতে কিছুতেই যাওয়ার রাষ্ট্র ছিলো না। সুতরাং অনিবার্যভাবেই শেখ মুজিবকে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত করার চূড়ান্ত লড়াইয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন দূরবর্তী পথ তাঁর সম্মুখে খোলা ছিলো না। তিনি রাষ্ট্রচিন্তার এইসব দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা লাভ করেই চূড়ান্ত সংগ্রামের রূপরেখা ৬ দফা জনগণের কাছে তুলে ধরলেন। এটিকে তিনি মুক্তির মহাসনদ তথা ম্যাগনাকার্টা নামে অভিহিত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সকল ষড়যন্ত্র, কারা নির্যাতন, রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে দণ্ডিত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এক গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তিনিই শুধু বের হয়ে এলেন না, পাকিস্তান স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ব বাংলায় অচল করে দিলেন। আদায় করে নিলেন সাধারন নির্বাচন, ৬ দফার গণরায়ও নির্বাচিত হলো। শেখ মুজিব হলেন জনগণের বঙ্গবন্ধু এবং অবিসংবাদিত নেতা। এরপরে পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের সকল কুটচাল ব্যর্থ করে দিয়ে ৭ মার্চ পূর্ব বাংলার জনগণকে স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক দিলেন। সেটিকে নস্যাৎ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামিয়ে গণহত্যা শুরু করা হলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকই নিরস্ত্র মানুষকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত করতে উদ্ভুদ্ধ করেছিলো। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার জন্য ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরো অনেককেই ঐক্যবদ্ধ করেছিলো। সেকারণেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সকল অত্যাচার এবং আন্তর্জাতিক পরাশক্তির ষড়যন্ত্র ভেদ করে ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করে, পাকিস্তান আত্মসমর্পন করে এখান থেকে বিদায় নেয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে জাতির জনক এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিজয়ীর বেশে ফিরে এলেন। বঙ্গবন্ধুর এই ২৩ বছরের রাজনীতির পেছনে ছিলো রাষ্ট্রচিন্তার প্রয়োগ ঘটানো- যা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল, নেতা এবং সমর্থকরা কখনো ভাবতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘, ‘কারাগারের রোজনামচা ‘ এবং ‘আমার দেখা গণচীন ‘ ছাড়াও ১৯৪৭ সাল থেকে তাঁর উচ্চারিত ভাষণ সমূহ, বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে প্রদত্ত রাজনৈতিক বিবৃতি, দলীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পঠিত সাংগঠনিক বিবরণ ৬ দফার পুর্নাংগ বিবরন এবং পাকিস্তান সরকারের মুখোমুখি হয়ে যেসব লিখিত এবং মৌখিক বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন সেগুলো গভীর অনুসন্ধিৎসু পর্যবেক্ষন সহকারে যারা বোঝার চেষ্টা করবেন তারা যে বিষয়টি সর্বত্র দেখতে পাবেন তা হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর চরম দূর্বলতা যা পাকিস্তানকে একটি অমানবিক বিবর্তনমুলক স্বৈরাচারী রাষ্ট্র রূপে পরিচালিত হতে দিচ্ছে। এমন রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি প্রদেশ হওয়ার কারনে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের আধা উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং পূর্ব বাংলার জনগণকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে নূন্যতম ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রদেশের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবেই নতুবা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রের পথ রচনা করতেই হবে। নেতৃত্বের এই রাজনৈতিক সচেতনতা, দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা এবং দুরদর্শিতা নিয়ে শেখ মুজিব ১৯৪৭ সাল থেকেই আন্দোলন সংগ্রাম এবং জনগণকে সংগঠিত করার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করেন, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৯ জুন তারিখে প্রদত্ত এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন যে জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামো সম্পর্কে অনেক ধরণের ভাবনা চিন্তা করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শুরু হয় তাঁর রাষ্ট্র গঠনের প্রথম পর্ব। এই পর্বে তিনি চার জাতীয় মৌল নীতির ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন, পাকিস্তানকালের অগঠিত প্রদেশ হিসেবে পূর্ব বাংলাকে রেখে যাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে নতুনভাবে প্রশাসনিক সকল মন্ত্রণালয় বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগসহ অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয় সকল দফতর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যাত্রা শুরু করলেন। জনগণের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্টা করার লক্ষ্য স্থির করে অগ্রসর হতে থাকলেন। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে ১ কোটি মানুষের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে ৪ লক্ষ মানুষকে ফিরিয়ে আনা, তাদের কর্মসংসস্থানের ব্যবস্থা করা, বাংলাদেশের নতুন মুদ্রা প্রবর্তন, অর্থনৈতিক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন, শিক্ষানীতি প্রণয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ একের পর এক নিতে থাকে। ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে তিন মাসের মধ্যেই চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি , সাহায্য, সমর্থন আদায় করতে থাকলেন। তবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন ছিলো নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তখন ছিলো অনেকটাই বৈরী এবং প্রতিকূলে। ১৯৭৩ সালে তেলের মূল্যবৃদ্ধি,১৯৭৩-১৯৭৪ সালে পর পর দুটি বন্যা বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অভিযাত্রায় বড়ো ধরণের আঘাত হিসেবে দেখার বিষয় । কিন্তু এর চাইতেও বড়ো সংকট ছিলো স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। তখন আওয়ামী লীগ, ন্যাপ(মোজাফফর) এবং সি পি বি ব্যতীত অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্র পুনর্গঠনে নিয়মতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি চর্চা করেনি। স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেকেই আত্মগোপন করলেও তাদের একটি অংশ উগ্র বিপ্লববাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যায়। এছাড়া বেশ কিছু বিপ্লববাদী রাজনৈতিক দল সরকার উৎখাতে গোপনে থানা-পুলিশ ফাঁড়ি লুট করা, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের হত্যা করা সহ চরমপন্থায় দেশে একটি অরাজক অবস্থা তৈরি করতে থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্র কখনো আমাদের মতো এতো পশ্চাৎপদ যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এক নতুন রাষ্ট্রে কার্যকর করা মোটের উপর অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। সেই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী আনায়নের মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। এই প্রবর্তনের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, তাদের কার্যক্রম সরাসরি রাষ্ট্র ও জনগণের নানা ধরনের সেবার সঙ্গে যুক্ত করা উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রূপে বিকেন্দ্রীকরনের মাধ্যমে নবগঠিত জেলা পরিষদ, থানা পরিষদ,ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। দেশে কৃষি উৎপাদন কয়েকগুন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কৃষি সমবায়, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করনে বহুমুখী সমবায় ব্যবস্থা, কলকারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবার পরিকল্পনা, ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যপক পরিকল্পনা তিনি প্রণয়ন করেন। এর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছিলেন, সেটিকে তিনি শোষিতের গণতন্ত্র এবং ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই ব্যবস্থাটি দুনিয়ার অন্যান্য দেশের সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে হুবহু মেলানোর ছিলো না। বরং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, জনগণের মনোজাগতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি একটি জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কর্মসূচি উপস্থিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক ২ পর্বের এই রাষ্ট্রচিন্তার গভীরে প্রবেশ না করে বাহ্যিকভাবে শত্রু ও বিরোধী পক্ষ সবসময়ই সমালোচনা এবং স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে সেটি রাষ্ট্রচিন্তার বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পথচলাকে না বুঝতে পারার অক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বঙ্গবন্ধু কেনো সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেনঃ
৩ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টত বুঝতে পারলেন যে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি লাভের ক্ষেত্রে জটিল সমস্যায় আক্রান্ত। এর একটি হচ্ছে মান্দাতা আমলের কৃষি ব্যবস্থা, কৃষিজ পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা জটিলতা বিরাজ করছে। অন্যটি হচ্ছে শিল্পের পশ্চাৎপদতা এবং অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশের শিল্পখাত পিছিয়ে আছে। কিন্তু কৃষিখাতে যে উর্বর জমি বাংলাদেশে রয়েছে তাতে আমূল পরিবর্তন সাধন করা গেলে। কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন কয়েকগুন বৃদ্ধি করা সম্ভব, একইভাবে শিল্প খাতেও। বাংলাদেশকে তখন প্রতি বছর ২০-৩০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষিব্যবস্থায় আমূল সংস্কার সাধন জরুরী। বিশেষ করে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ তাকে ভীষণভাবে পীড়িত করেছিলো। পর পর ২ বছরের বন্যায় খাদ্যের সংকট তীব্রতর হয়েছিল যা পূরণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কৃষি ও শিল্প খাতের এই পরিবর্তন সাধনের জন্য তাঁর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো বড়ো ধরণের সংস্কার সাধন। সেটি বাস্তবায়ন করার জন্য ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ৩ বছরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘুষ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের মনোজাগতিক, প্রশাসনিক সমস্যা তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করেন। ৩ বছর তিনি সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করিয়েও সামগ্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করলেন। তবে সেই বিকেন্দ্রীকরণটি তিনি জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক শক্তি, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রশাসনকে কাঠামোগতভাবে নতুনভাবে একীভূত করার মাধ্যমে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত ঢেলে সাজানো ছাড়া সুফল নাও দিতে পারে বলে তিনি অনুভব করেন। তিনি বিশেষভাবে অনুভব করেছিলেন প্রচলিত রাজনৈতিক দল এবং সেগুলোর কার্যকারিতা বাংলাদেশের মতো একটি পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশে সহায়ক হচ্ছে না, বরং উগ্র হঠকারী রাজনৈতিক মতাদর্শে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছে, নানা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডে বিরাটসংখ্যক তরুন যুক্ত হচ্ছে, দ্বন্দ্ব সংঘাত ও বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়ছে এবং দেশি বিদেশি নানা ইস্যুতে অপপ্রচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এমন একটি দেশ এতো বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অর্থনৈতিক বিকাশ সাধন তথা সকল মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধন অসম্ভব ব্যাপার হয়ে পড়ছে। সেকারণে তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন দেশপ্রেমে উদ্বুব্ধ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং সংবিধানের ৪ মৌল নীতিতে বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দল অরাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলোতে কর্মরত যেকোনো নাগরিক বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিকাশে অবদান রাখার সুযোগ সম্বলিত একটি জাতীয় দলীয় ঐক্য গড়ে তোলা আবশ্যক। তাঁর এই চিন্তা ভাবনা ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৭৪ এর ১৫ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে তিনি দেশে বড়ো ধরণের পরিবর্তনের প্রয়োজনের কথা নিঃসংকোচে উল্লেখ করে বলেন, “ আমি জানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি জিনিসের অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধিতে আপনারা কী নিদারুন কষ্ট পাচ্ছেন। বিশেষ করে সীমাবদ্ধ আয়ের লোকদের দুঃখ-কষ্টে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। আমাদের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও কয়েক হাজার লোককে আমরা অনাহারের কবল থেকে বাঁচাতে পারিনি-এ সত্য স্বীকার করতে আমার কোনো লজ্জা নেই। কারণ আমি জানি , সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও একমাত্র আমরাই এসব হতভাগা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সামান্য যা কিছু পেয়েছি, তা নিয়ে এ দেশের সেবায় এগিয়ে গিয়েছি। কিছু সংখ্যক ভাববিলাসীর ন্যায় বক্তৃতা বিবৃতির ঝড় তুলেই ক্ষান্ত হইনি। খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে অনাহারে মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি রোধ করার সুকঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।“ তবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সামগ্রিক বিপ্লবী পরিবর্তনের অপরিহার্যতা সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তাঁর সহজ সরল ভাষায় দিয়েছেন ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদে তাঁর দেওয়া ১.৫ ঘন্টার ভাষণে।
সংসদীয় থেকে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার সাংবিধানিক পরিবর্তনঃ ২য় বিপ্লবের যাত্রাঃ
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। নতুন সংবিধান অনুযায়ী ৪ জাতীয় মৌল নীতি তথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের আদর্শে রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। সংবিধান গ্রহণের সময় তিনি তখন সংসদকে অবহিত করেছিলেন যে জনগণের কল্যাণে তিনি এই সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে উদ্যোগ নেবেন। ৩ বছর সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার বেশ কিছু সাফল্য থাকলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্ত্রের ঝনঝনানি, থানা- পুলিশ লুটপাট, পুলিশ ফাঁড়ি ও কলকারখানা গুদামে অগ্নিসংযোগ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ ছাড়াও দেশে উগ্রপন্থীদের অপতৎপরতায় হত্যা-খুন, গোপন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়ে যায়, এছাড়া ঘুষ দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে দেশে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছেনা। এই অবস্থায় তিনি ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রচলিত কৃষি, শিল্প, প্রশাসন, রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গঠনের একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন। সংসদে ২ জন সদস্য ব্যতীত বাকি সকলেই তাঁর উত্থাপিত সংশোধনীর বিল সমর্থন প্রদান করেন। সংসদে তিনি শোষণ হীন সমাজ গঠন, বৈষম্য দূরীকরণ এবং জাতীয় ঐক্য গঠনের যে বিস্তারিত বিবরন প্রদান করেন সেটিকে তিনি আমাদের ২য় বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “ আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশিদের পয়সা ভোট কেনার জন্য দেয়, তাদের গণতন্ত্র নয়-শোষিতের গণতন্ত্র।“ এই ভাষণে তিনি জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন, সংসদ ও সরকার ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থার পাশাপাশি জবাবদিহি করারও নিশ্চয়তা প্রদান করেন। ওইদিনই তিনি সংসদ ভবনে রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহণ করেন। ২৬ জানুয়ারি তারিখে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৭ সদস্যের একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। ২৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক ৩টি জেলায় রূপান্তরিত করার ঘোষণা দেয়। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১২ই ফেব্রুয়ারি নবঘোষিত ৩ পার্বত্য জেলার নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে রাঙামাটিতে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি প্রতিটি নৃজাতিগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক,জাতিগত উন্নয়ন, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, সমান অধিকার বাস্তবায়নে তাঁর সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেন।বক্তৃতায় তিনি বলেন, “ স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্যে কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে এবং উপজাতীয় এলাকাগুলোতে আদর্শ গ্রাম গড়ে তোলা হবে। আদর্শ গ্রামগুলোতে বসবাস ও আবাদের জন্য বিনামূল্যে জমি দেওয়া হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।“ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সরকার ৩ এপ্রিল ১৯৭৫ তারিখে দেশের সকল গুপ্তহত্যাকারী ও সন্ত্রাসীদের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ জারি করেন। এই সময়ে বেশ কিছু দুষ্কৃতকারী গ্রেপ্তার হয়। দেশের কালোবাজারিদের হাতে সঞ্চিত অবৈধ অর্থ অকার্যকর করার উদ্দেশ্যে ৬ এপ্রিল ১০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করা হয়। ৮ এপ্রিল অচল টাকা জমাদানে কারচুপির অভিযোগে ৪ জন ব্যাংক ম্যানেজারসহ ১৬ জন ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে চাকরী থেকে অপসারণ করা হয়। বিগত বছর গুলোতে দুষ্কৃতকারীরা পাটের গুদাম ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় রাতের আঁধারে অগ্নিসংযোগ করে জনগণের সম্পদ ধ্বংস করার যেসব নজির স্থাপন করেছিলো। তাঁর পুনরাবৃত্তি ১৪ই এপ্রিল তারিখে তারা ক্রিসেন্ট জুটমিলে ঘটায়। এখানেও বিপুল সম্পদ পুড়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৬ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠনের একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। ওইদিনই ঢাকায় ফারাক্কা বাঁধ ইস্যুতে ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৮ই এপ্রিল ভারতের গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।এই চুক্তির শর্তানুসারে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদীর ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশের জন্য সুনিশ্চিত করে ভারতকে মাত্র ১১ হাজার কিউসেক পানি ফারাক্কা বাঁধ হতে প্রত্যাহার করার অনুমতি প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার ২৫ এপ্রিল ১৯৭৫ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিল গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে আড়াই হাজার নলকূপ বিদ্যুতায়নের সিদ্ধান্ত ১১ই মে তারিখে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ও গণচীনের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৯ মে তারিখে। যদিও তখনো চীন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। তবে এই বাণিজ্যিক উদ্যোগ সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পদক্ষেপ হিসেবেই বাংলাদেশ মনে করে। নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর অনেকে বেসরকারি উদ্যোগের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সন্দেহপ্রবন ছিলেন। কিন্তু ৩ জুন ১৯৭৫ তারিখ বঙ্গবন্ধুর সরকার বিদেশী রুটে আন্তর্জাতিক রুটে বিদেশি জাহাজ বেসরকারি সংস্থা গুলোকে ভাড়া করার অনুমতি প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে দেশের ৬০টি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করার একটি ঘোষণা ২২ জুন ১৯৭৫ তারিখে প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু সরকার ২৮ জুন তারিখে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিগ্রাম ও টেলিফোন বোর্ড গঠন করে। পূর্বে ঘোষিত জেলাসমূহে ১৬ জুলাই তারিখে রাষ্ট্রপতির আদেশে ৬১ জন গভর্নর নিয়োগ করে তাদের নাম প্রকাশ করেন। এতে সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, উচ্চ পদস্থ আমলাসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর কেউ কেউ মনে করেছিলো আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও দেশগুলো বাংলাদেশের ব্যাপারে নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে কিন্তু বাস্তবে সেটি পরিলক্ষিত হয় নি। সরকার গঠিত হওয়ার পর ৫ মার্চ তারিখে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা আই ডি এ বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১২ কোটি টাকা , আশুগঞ্জ সার কারখানা প্রকল্প খাতে ২৪ কোটি টাকা এবং ১২ই মার্চ তারিখে আরো কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াই কোটি ডলার ঋণ প্রদান করে। বাংলাদেশ ও জাপানের সঙ্গে ২৮ মার্চ তারিখে ৩০ কোটি টাকার পণ্য বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশে সাড়ে ১৫ লাখ মণ খাদ্য শস্য ২৯ মার্চ তারিখে মঞ্জুর করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশের জয়দেবপুরস্থ নির্মানাধীন মেশিন টুলস কারখানার নির্মাণে ৩ মে তারিখে বাংলাদেশ সরকারকে এক কোটি ডলার প্রদানের প্রস্থাব জানায়। বিশ্ব ব্যাংক ৫ জুন তারিখে বাংলাদেশকে ১৫ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ব্যাংকটি ৬ জুন তারিখে কনসোর্টিয়ামভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশকে ১২০ কোটি ডলারের সাহায্য ঋণ প্রদানের আবেদন জানায়। মিশর সুয়েজ খাল তীরে বাংলাদেশকে একটি ভূখণ্ড দান করার সিদ্ধান্ত ২১ জুন তারিখে গ্রহণ করে। বৃটেন এবং বেলজিয়াম ২৫ জুন তারিখে বাংলাদেশের জন্য পণ্য ও ঋণ সাহায্য মঞ্জুর করে। এর ফলে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোসহ চীন, জাপান, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তা লাভ এবং দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নতুন ভাবে শুরু করার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এর যাত্রাঃ
২৫ জানুয়ারি সংবিধানে আনীত চতুর্থ সংশোধনী ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে একটি জাতীয় দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় সংবিধান অনুযায়ী অন্যসব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(মোজাফফর) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি(সি পি বি) মিলিতভাবে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ(বাকশাল) গঠন করে। এখান থেকেই বাকশালের যাত্রা শুরু হয়। বাকশালের ৫ টি অংগ সংগঠন রাখা হয়। এগুলো হচ্ছে ১ জাতীয় কৃষক লীগ, ২ জাতীয় শ্রমিক লীগ, ৩ জাতীয় যুবলীগ, ৪ জাতীয় মহিলা লীগ এবং ৫ জাতীয় ছাত্রলীগ। ৭ জুন তারিখে বাকশাল এবং এর অংগ সংগঠন গুলোর কেন্দ্রীয় কমিটির নাম ঘোষিত হয়। অবশ্য ৭ জুন তারিখে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। বাকশালের সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক হন প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এম মনসুর আলী। জাতীয় কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ফণিভূষণ মজুমদার, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জাতীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান জনাব তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান সাজেদা চৌধুরী এবং জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ শহিদুল ইসলাম।
অবশ্য ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাকশালের উদ্যোগে একটি জনসভা ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম প্রকাশ্য জনসভায় নতুন রাজনৈতিক দল, সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করার নয়া ব্যবস্থাপনা, ঘুষ-দুর্নীতি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা গঠনে তিনি যেসব উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন সেসম্পর্কে প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী প্রদত্ত ভাষণে জনগণকে জানান। নয়া রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি দেশে কী কী পরিবর্তন সাধন করতে যাচ্ছে সেটি সম্পর্কে তাঁর ভাষণে বলেন। এর একটি হচ্ছে মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করা, সেখানে জেলা কাউন্সিল , এর অধীনে থানা কাউন্সিল, সর্বত্র কৃষি সমবায় এবং বহুমুখী সমবায় ব্যবস্থা প্রুবর্তন করা। প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে জেলা, থানা এবং গ্রাম পর্যায়ে গঠিত কাউন্সিল গুলোতে নিয়ে যাওয়া। তিনি সমবায় গুলোকে দ্বিগুন ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরনের কথা উল্লেখ করেন। কলে-কারখানায় প্রচলিত ট্রেড ইউনিয়ন বাদ দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষাসহ মজুরি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কলে কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করার কথা বলেন। মূলত দেশে অফিস-আদালত,কল-কারখানা এবং মাঠে উৎপাদন বৃদ্ধিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই হচ্ছে নতুন এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় সরকার প্রধান এবং সংসদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে বলেও তিনি বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। সংসদ সদস্যের প্রতিটি আসনে একাধিক ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার যেমন সুযোগ থাকবে তেমনি জনগণেরও ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ থাকবে বলে তিনি সবাইকে অবহিত করেন। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রের ৪ জাতীয় মূলনীতিতে বিশ্বাসীদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি জাতীয় দল গঠনের ব্যবস্থা রেখেছেন। এই দলে কৃষক,শ্রমিক, পেশাজীবী ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরাও সদস্য হতে পারবেন। ২৬ মার্চ তারিখে উক্ত ভাষণে বাকশালের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যে ধারণা প্রদান করেন সেটি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া কয়েকটি ভাষণে আরো সুবিন্যস্ত করা হয়। ৭ জুন বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির নাম ঘোষিত হওয়ার পর ১৯ জুন তারিখে অনুষ্ঠিত বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের সম্মুখে তিনি একটি দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন, “ ...বহুদিন কারাগারে একলা একলা বসে বসে আমি চিন্তা করতে সময় পেয়েছি।...সবাইকে একতাবদ্ধ না করতে পারলে সমাজের দুর্দিনে দেশের মঙ্গল হতে পারে না।...সমস্ত লোককে একতাবদ্ধ করে দেশের মঙ্গলের জন্য যদি এগিয়ে যেতে না পারি, তবে দেশের মঙ্গল করা কষ্টকর হবে। সেজন্য নতুন সিস্টেমের কথা বহুদিন পর্যন্ত চিন্তা করেছি।...আমার সমাজের যে সমস্ত গুণী-জ্ঞানী লোক আছেন ও অন্য ধরণের যত লোক আছেন, তাদের নিয়ে আমার একটা পুল করা দরকার। এই পুল আমি করতে পারি, যদি আমি নতুন একটা সিস্টেম চালু করি এবং একটা দল সৃষ্টি করি-জাতীয় দল, যার মধ্যে একমত, একপথ, একভাব, এক হয়ে দেশকে ভালবাসা যায়, যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে, তারা এসে একতাবদ্ধ হয়ে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে পারে। এজন্য আজকে এটা করতে হয়েছে।“ বক্তৃতায় তিনি কৃষক সমবায় প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন সেগুলোর দেখভালের দায়িত্ব বাকশালের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অন্য দেশ থেকে ধার করে নয়। বরং , “ আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমাকে ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে।“ তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে বলেন, “ আগস্ট মাসে আমি আপনাদের সভা ডাকছি উইথ ডেফিনিট এজেন্ডা। ফুড , এগ্রিকালচার, ইন্ডাস্ট্রি, এডুকেশন, কো-অপারেটিভ, সমস্ত প্রোগ্রাম দিয়ে তারপর আমি আপনাদের এই হাউজটাকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দিচ্ছি।“ এই দায়িত্বসমূহ তিনি তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকর করার ধারণাও উপস্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর এই দীর্ঘ ভাষণের সর্বত্র আগস্ট পরবর্তি এক বছরে যেসব প্রশাসনিক কাউন্সিল তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গঠিত হবে তারও ধারণা দেওয়া হয়। কার্যত বঙ্গবন্ধু নয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে বাকশালকে দেশের নয়া প্রশাসন এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় সংযুক্তির মাধ্যমে দলকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ করার রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হন।
১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধু গণভবনে নতুনভাবে প্রবর্তিত ৬১টি জেলার গভর্নরদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু জেলা গভর্নরদের বহুমুখী দায়-দায়িত্ব পালনের বিষয়ে অবহিত করেন। গভর্নরদের নেতৃত্বে গঠিত বিভিন্ন কাউন্সিল কিভাবে কাজ করবে, কিভাবে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা তাদের সংস্থার পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়নে কাজ করবে, সমস্ত সংস্থার সঙ্গে গভর্নরগণ কিভাবে সমন্ব্য় সাধন করবেন। জেলার আইন, শৃঙ্খলা, বিচার, ব্যবসায়, বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে গঠিত সমবায় সমূহ, বহুমুখী সমবায় সমিতিগুলো কার্যকর থাকবে, জেলার রাস্তাঘাট, শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবার পরিকল্পনা, টেস্ট রিলিফসহ যাবতীয় বিষয়গুলো গভর্নরগণ কিভাবে প্রতিনিয়ত পরিবিক্ষণ করবেন, উদ্বুব্ধ সমস্যার সমাধানে মন্ত্রণালয় এবং প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারবেন বলে তিনি গভর্নরদের এক বছরের মধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে থানা ও গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। গভর্নরদের নতুন এই প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে পরীক্ষামূলক বলে অভিহিত করেন। এই ব্যবস্থায় সবাইকে দুর্নীতির উর্দ্ধে উঠে জনগণের কল্যাণে কাজ করারও আহ্বান জানান।
বাকশাল প্রবর্তিত হওয়ার পর শুধু আওয়ামী লীগ ন্যাপ বা সি পি বি এর নেতৃবৃন্দই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং প্রবীণ সংসদ সদস্যগণও বাকশালে যোগদান করেন। জাতীয় সংসদের প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খান, আব্দুস সাত্তার, খোয়াই বেয়োজর এবং সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বাকশালে যোগদান করেন। ৮ জুলাই তারিখে মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মওলানা খোন্দকার নাসির উদ্দিন বিভিন্ন জেলার ৫৫ জন নেতাসহ ৪৯০৫১ জন মাদ্রাসা শিক্ষকের বাকশালে যোগদানের আবেদনপত্র বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম মনসুর আলীর হাতে হস্তান্তর করেন। এই সময় থেকে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও সংস্থার অসংখ্য মানুষ বাকশালে যোগদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন করেন। উল্লেখযোগ্য পেশা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে ঢাকা বারের আইনজীবী, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের কর্মকর্তা, বাংলাদেশ বিমানবন্দর উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ গৃহনির্মাণ সংস্থা,ন্যাপ(ভাসানী) এর ৪৫০ জন নেতাকর্মী,বাংলাদেশ দমকল বাহিনী, আনন্দবাজার বণিক সমিতি, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথ সমিতি, বিভিন্ন সংবাদ পত্রের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা বাকশালে যোগদানের আবেদনপত্র জমাদান করে। এই সময় দেশে ১৬ই জুন তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস সরকারি মালিকানা মুক্ত কর হয়। এই সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত সাংবাদিক কর্মচারীদের নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত ৪ টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত করা এবং তাদের চাকরী ও বেতন সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিলো। সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমকে নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার মধ্যে ছিলো।
জানুয়ারি মাস থেকে নতুন ব্যবস্থা গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দেশে শান্তি শৃঙ্খলা আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক দ্রুত স্বাভাবিক হতে থাকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর উদ্ভাবিত রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ,প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের প্রতি একদিকে গভীর আগ্রহ যেমন পরিলক্ষিত হচ্ছিল, অন্যদিকে দেশে নতুন কিছু হতে যাচ্ছে এমন ধারণাও সর্বত্র প্রচারিত হচ্ছিল। এতদিন যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নানা ধরণের গুপ্ত হামলা, অপ্প্রচার, নৈরাজ্য সৃষ্টির পায়তারায় লিপ্ত ছিলো তারা অনেকটাই চুপসে যেতে থাকে। দেশে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকায় জনজীবনে স্বস্তির ভাব ফিরে আসে। সেকারনেই বঙ্গবন্ধু ১৯ জুন তারিখে নবনিযুক্ত গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেছিলেন, “আমি এটুকু বলতে পারি, আমাদের ইকোনমিক কন্ডিশন ইজ নোট সো ব্যাড এন্ড ইট উইল ইম্প্রুভ ডে বাই ডে।“
জানুয়ারি মাসের পর থেকে আগস্ট মাসের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যেসব পরিবর্তন সাধনের প্রস্তুতি গ্রহন করছিলেন তা সকল মহলেই আগ্রহের সৃষ্টি করছিলো। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় একটি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাষ্ট্রব্যবস্থাটি গড়ে উঠছিলো তা তারা মেনে নিতে পারছিলো না। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত নতুন দেশ হওয়ায় এর সমস্যা ছিলো বহুমুখী। অনেক দেশের বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিলো বাংলাদেশ কঠিন এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দাঁড়াতে পারবে না কিন্তু বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সর্বক্ষেত্রে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, আইনি বিধিবিধান, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া বিচার ও নির্বাহী বিভাগের সামগ্রিক কর্মকান্ড যেভাবে ৩ বছরের মধ্যে দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন সেটি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর ছিলো। বাংলাদেশ একটি আধুনিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচরিত্র নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে পরিচিত হয়ে উঠছিলো। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনায় ৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশের উর্বর মাটিতে দ্বিগুন বা তিনগুনের বেশিই ফসল ফলানো সম্ভব যদি- এর কৃষি ব্যবস্থা সমবায় পদ্ধতি প্রবর্তন করা যায়। আর এর জন্য কৃষক শ্রেণীকে কৃষজ উৎপাদনে যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে কলকারখানায় শিল্প উৎপাদনে শ্রমিক শ্রেণীকে যথাযথ ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসন ব্যবস্থাকে এই সব উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এবং দায়বদ্ধ করতে হবে। সর্বোপরি রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জনকল্যাণবাদী চিন্তাধারা ও সংযুক্তির উদ্ভাবন ঘটাতেই হবে। তাহলেই বাংলাদেশ পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে আত্মনির্ভর ও আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্ররূপে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দুনিয়ায় স্থান করে নিতে পারবে। সেকারণেই ৭৫ এর ২৫ শে জানুয়ারির পর তিনি ২য় বিপ্লবের কর্মসূচির নামে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে চরিত্রগতভাবে একটি জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁর এই উদ্ভাবনী পদ্ধতি কোনো কোনো মহলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা হিসেবে মনে করা হয়- যদিও তিনি চীন, সোভিয়েত বা অন্যকোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধাঁচে বাংলাদেশে কোনো পরিবর্তন ঘটানোর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না, সেটি তিনি বার বার স্পষ্টও করেছিলেন। তারপরেও ষড়যন্ত্রকারী মহল তাঁর পথচলাকে থামিয়ে দিতে তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশে ১৫ই আগস্টে রক্তাত্ত হত্যাকান্ড সংগঠিত করার মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল ঘটায়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলো দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা বর্ণচোরা ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী। এর ফলে বাংলাদেশ শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারায় নি। একটি শোষণ হীন সমাজব্যবস্থা তৈরির মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায়।
উপসংহার:
বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত বাকশাল কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করার আগেই বাংলাদেশে ঘটে গেছে ১৫ই আগস্টের রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লব। এর ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠার যে নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছিল তা থেকে বঞ্চিত হয়। বঙ্গবন্ধু যদি তাঁর সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেতেন তাহলে দেশের অর্থনীতি, সমাজ, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে শুধু উন্নয়নশীল নয়, উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবেও কয়েকবছরের মধ্যে গড়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলো। কারণ তাঁর রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে তিনি যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো বাংলাদেশের মতো একটি পশ্চাৎপদ, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত, অথচ ব্যপক সম্ভাবনময় শক্তিকে উৎপাদন সহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনে কাজে লাগানোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিলো। কারণ তিনি ছিলেন একজন যথার্থই রাষ্ট্র চিন্তক ও প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ছিলো রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট আধুনিক ধারণা, সেকারণেই তিনি পেরেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ২৩ বছরের মধ্যে এই ভূখণ্ড থেকে বিদায় করতে এবং একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সফলও হলেন। সেই রাষ্ট্রটি কি কি আধুনিক আদর্শে পরিচালিত হলে একটি জনকল্যাণ বাদী রাষ্ট্র গঠন করা যায়। সেসম্পর্কেও তাঁর ছিলো জ্ঞান ও দক্ষতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন থেকে ৭৫ এর ১৫ই আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা, অভিজ্ঞতা, বাস্তববোধ, উদ্ভাবনী চিন্তার ক্ষমতা কাজে লাগিয়েই তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে আত্মমর্যাদার একটি ধারায় উপনীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একমাত্র রাষ্ট্রচিন্তক নেতাই পারেন আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই নেতৃত্বদানের মাধ্যমেই পাকিস্তানকে হঠিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করলেন, স্বাধীণ বাংলাদেশকে তিনি আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, শোষণ হীণ, জনকল্যাণ বাদী রাষ্ট্রের চরিত্রদানে সাড়ে তিন বছর নিরন্তর কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তাঁর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতেই হত্যা ও ক্ষমতা দখলের অপশক্তিরা আঘাত হানে। এই আঘাত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপরও। ৭৫ পরবর্তী রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে জনকল্যাণ বাদী রাষ্ট্র চিন্তা বিরোধী ধারায় পরিচালিত হয়েছে। এখন সময় এসেছে পরিবর্তিত বাস্তবতায় কিভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নূন্যতম অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত রাষ্ট্রের ধারায় ফিরিয়ে আনা। সেই লড়াইটি মোটেও সহজ নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের ধারক বাহক, প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতৃত্ব পারবেন জনকল্যাণবাদী ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে।
লেখকঃ অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ।
তথ্যসুত্রঃ
1. বাংলাদেশ, শেখ মুজিবুর রহমান, সম্পাদকঃ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক, বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, ২০১৭, পৃঃ৭৮৮-৭৯২
2. বিস্তারিত দেখুন, শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ(সম্পাদিত), বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহ্মান(১৯৭২-১৯৭৫), আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী,১৯৯৮
3. বাংলাদেশ, পৃঃ৮০৩
4. দৈনিক বাংলা,বাসস, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫
5. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউ পি এল, ১৯৯৩, পৃ-২৪৭
6. পুর্বোক্ত, পৃ-২৪৭
7. বাংলাদেশ...পৃঃ৮৩৪-৮৩৫
8. পুর্বোক্ত,পৃ-৮৪০
9. পুর্বোক্ত,পৃ-৮৪২
10. পুর্বোক্ত,পৃ-৮৪০