3797
Published on সেপ্টেম্বর 9, 2020ড. কামালউদ্দীন আহমদঃ
যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৪৪ বছর আগে ১৫ মার্চ রোমের গৌরব জুলিয়াস সীজারকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারই সন্তানপ্রতিম ব্রুটাস ক্যাসিয়াস এবং অন্য ষড়যন্ত্রকারীরা। সিজারের বিজয়াভিযান গড়েছিল রোমের ভিত্তি। সিজার হত্যার দু’হাজার বছরেরও কিছু পর স্বাধীনতার আরেক সৈনিক, জাতীয়তাবাদের প্রতীক, রাষ্ট্রের স্থপতি এবং জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ তারই কৃপার পাত্র কিছু সামরিক ও বেসামরিক ষড়যন্ত্রকারী। ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি। তারা জানত যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই এই মূলনীতিগুলো রক্ষা করার আর কেউ থাকবে না। এখানে তৈরি করতে পারবে এক মিনি পাকিস্তান। তারা জানত যে, বাঙালীকে আর পাকিস্তানী করা যাবে না, তবুও সৃষ্টি করতে হবে এমন একটি রাষ্ট্র, যা চলবে পাকিস্তানের ছত্রছায়ায়, যেখানে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বকে এই উপমহাদেশে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করা যাবে। রক্ষা করা যাবে কায়েমি স্বার্থ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, কেবল ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফলও নয়। এর পেছনে ছিল গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
অনেকে এটাকে সামরিক অভ্যুত্থান বলে মনে করেন। এটাকে সামরিক অভ্যুত্থান বলা চলে কি না সেটা আলোচনা সাপেক্ষ। আন্তর্জাতিক আইনে সেই অবস্থাকে ক্যু বা সামরিক অভ্যুত্থান বলা হয় যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সাংবিধানিকবহির্ভূত উপায়ে হঠাৎ বা জবরদস্তিমূলকভাবে গ্রহণ করা হয় এবং সাধারণত এটা সামরিক বাহিনীর একটি অংশ বা সমগ্র সামরিক বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হয়। ১৯৭৫-এর আগস্ট হত্যাকা-ে সামরিক বাহিনীর কয়েক জুনিয়র অফিসার জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে দুজন চাকরিচ্যুত এবং বাকি ৫ জন মেজর পদের। এদের মধ্যে মেজর ফারুক হোসেন ও আবদুর রশীদের লন্ডনের সানডে টাইমসের অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সঙ্গে একটি টেলিভিশন সাক্ষাতকারে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য বেরিয়ে পড়ে। এই সাক্ষাতকারটি লন্ডনের আই টিভি থেকে সম্প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাতকারে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, মার্চ ৭৪ থেকে এই হত্যার একক পরিকল্পনা করে ফারুক হোসেন, যখন সে (তার নিজের কথামতো) একজন সাধারণ সৈনিক ছিল এবং রাষ্ট্র চালনা বা রাজনীতি সম্বন্ধে কোন জ্ঞানই তার ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়ার জন্য সে প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ ব্যাপারে তার ভায়রা এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুর রশীদকে অবহিত করে। ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় জেনারেল জিয়ার (তখন ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ) সঙ্গে ফারুক দেখা করে এবং দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করার পর জুনিয়র অফিসারদের মুজিব হত্যার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে এতে তার সমর্থন ও নেতৃত্ব চায়। জুনিয়র অফিসাররা এ ধরনের পরিকল্পনা করে থাকলে তারা এগিয়ে যেতে পারে বলে জিয়া অভিমত ব্যক্ত করেন। ফারুক জিয়ার মনের কথা বুঝতে পেরে যোগাযোগ করে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে। সামরিক বাহিনীর আর কারও প্রত্যক্ষ সমর্থন ফারুক ও রশীদ পেয়েছিল বলে কোনো উল্লেখ এই সাক্ষাতকারে নেই। এরপর রশীদ যোগাযোগ করে চাকরিচ্যুত সেসব জুনিয়র অফিসারের সঙ্গে যাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল জাতির পিতার প্রতি। চাকরিচ্যুত কয়েক জুনিয়র অফিসারকে নতুন এয়ারপোর্টে ১৪ আগস্ট রাতে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানানো হয়। তখনই তারা বঙ্গবন্ধু, সেরনিয়াবাত ও শেখ মনিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে এই হত্যার পরিকল্পনা কাজে পরিণত করার জন্য মার্চ ১৯৭৫ থেকেই ফারুক তার ইউনিটের ট্রেনিং শুরু করে এবং প্রতি মাসে দুইবার রাতে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। এই ট্রেনিংয়ে অংশ নিত ফারুক রহমানের বেঙ্গল ল্যান্সারস এবং সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি, যার অধিনায়ক ছিল রশীদ। এই ট্রেনিংয়ের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেয়া। কাজেই এটাকে কোনমতেই সামরিক অভ্যুত্থান আখ্যা দেয়া যায় না।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এবং চোরাচালানি, কালোবাজারি ও মজুদদারি বন্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার দুইবার সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগান। এতে কিছুটা উপকার হলো। এর মধ্যে দেশে যে সমস্ত রাজাকার আলবদর লুকিয়েছিল তারা আস্তে আস্তে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। ১৯৭২-এর গোড়া থেকেই মানুষ এদের সিক্সটিন ডিভিশন নামে অভিহিত করতো। এরাই প্রধানত দায়ী ছিল দেশে বিরাজমান অরাজকতার জন্য। এই অরাজকতা বন্ধের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার কয়েকটি আইন প্রণয়ন করে। তার মধ্যে কোলাবরেটর অর্ডার এবং স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট অন্যতম। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং অতি বিপ্লবী ভূমিকাও বঙ্গবন্ধুকে বিব্রত করার চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এসব বিপ্লবী নেতার দেশপ্রেমের ফাঁকা আওয়াজের সঙ্গে দেশের মানুষ এখন অনেকটাই অবহিত। যে সব নেতা তখন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে, তাদের অনেকেই এখন সুবিধাবাদী এবং স্বার্থান্বেষী হিসেবে চিহ্নিত।
কালোবাজারি ও চোরাচালানবিরোধী অভিযানের সময় একটি কুচক্রী মহল বঙ্গবন্ধু সরকারকে তাদের কার্যকলাপের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে নিন্দনীয় করে তোলে।
দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার ’৭৩-এর নবেম্বর মাসে সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে তাদের নিজস্ব এলাকায় নাগরিক কমিটি গঠন করেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোঃ) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে ‘গণঐক্যজোট’ গঠন করে চোরাচালান ও কালোবাজারি বন্ধের জন্য সরকারকে সাহায্য করার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা এবং দেশের সিক্সটিন ডিভিশনখ্যাত আলবদর ও আলশামস সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
’৭২ থেকে ’৭৪-এর শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সরকার দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যেও অল্প সময়ের প্রচেষ্টায় গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন এবং ৭৩-এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। পাকিস্তানী সৈন্যদের ফেলে দেয়া এবং বিভিন্ন সময়ে সংগৃহীত অবৈধ অস্ত্র জমা দেয়ার জন্য সরকার আবেদন করে। যার ফলে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও রাজাকার, আলবদরখ্যাত সিক্সটিন ডিভিশনের লোকেরা অস্ত্র জমা দেয়নি। সেইসব অস্ত্রধারী শহরে, গ্রাম-গঞ্জে, রাজনৈতিক দলের মুখোশ পরে খুন, জখম, রাহাজানি ও হাইজ্যাক করতে থাকে। তবে বঙ্গবন্ধু সরকারের তৎপরতায় অনেকাংশে এসব অত্যাচার ’৭৪-এর শেষের দিকে বন্ধ হয়। এর মধ্যে যুক্ত হয় মার্কিন সরকারের সুপরিচিত খাদ্যসহ অর্থনৈতিক অবরোধ নীতি। অবরোধনীতির শিকার হয় তৃতীয় বিশে^র অনেক দেশ। এই অবরোধনীতি পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে, আলেন্দের চিলির বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয় ।
বাংলাদেশের ওপর এই নীতি এলো বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে চরম বির্পযয়ের মুখে তখন বিশ^ব্যাংকের নেতৃত্বে দাতা দেশগুলো দাবি জানাল যে, বাংলাদেশকে সাবেক পাকিস্তানের ঋণের একাংশের দায় নিতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশকে সাহায্য দেয়া সম্ভব নয়। তাদের কাছে এটা অবিদিত ছিল না যে, পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে বিপুল সম্পদের জন্য ঋণী ছিল। তা সত্ত্বেও বিশ^ব্যাংক অবস্থার নাজুকতা বুঝে চাপ দেয় পাকিস্তানের ঋণের ভার গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নীতির প্রশ্নে আপোস না করে বললেন, ‘দাতা মহল তাদের দাবি না ছাড়লে কালই তারা ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে পারেন। ওই শর্তে আমরা সাহায্য নিতে পারি না।’ বিশ্বব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্টকে এই সিদ্ধান্ত জানালেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এবং পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নূরুল ইসলাম। বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট এই কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান এবং বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, ‘শুনেছি আপনারা বলেছেন যে, সাহায্য নিতে হলে আপনাদের শর্ত মানতে হবে আগে। ভদ্র মহোদয় এই যদি আপনাদের শর্ত হয়ে থাকে তা হলে সাহায্য আমরা নেব না, আমাদের জনগণ রক্ত দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং আমাদের বাঁচতে হলে জনগণের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়েই বাঁচতে হবে। আমরা আপনাদের সাহায্য ছাড়াই চলব।’ এর তিন সপ্তাহ পর বিশ্বব্যাংক জানায় যে, তারা শর্ত উঠিয়ে সাহায্য দিতে রাজি হয়েছে।
এটা ছিল ’৭২ সাল। ষড়যন্ত্রকারীরা তখনও তাদের দোসরদের সংগঠিত করতে পারেনি। কিন্তু ’৭৪-এ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো সংগঠিতভাবে এবং মার্কিন সাহায্যকারীরা তাদের নিজস্ব রূপ দেখাতে থাকে। ’৭৪-এর বন্যার পর দেশে যখন খাদ্যশস্যের অভাব তখন খাদ্যশস্যের চালান (পিএল ৪৮০-এর অধীনে) বন্ধ হয়ে গেল। শস্য বোঝাই জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শস্য খালাস না করে ফেরত গেল। এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল কৃত্রিম খাদ্যাভাব। সঙ্গে ছিল চোরাচালানি এবং কালোবাজারি।
বঙ্গবন্ধু বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বক্তৃতায় হতাশার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে বিদেশ থেকে খাবার নিয়ে আসি আর চাটার দল সব খেয়ে ফেলে।’ যাদের ওপর তাঁর ভরসা ছিল তারাই তাঁকে হতাশ করেছিলেন। বিরোধী দলগুলো কোন গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারেনি। তারা তাদের বিপরীতমুখী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে, যেন বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ঘটানোই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। পরবর্তীতে কি হবে সে সম্বন্ধে তারা ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি পরাজিত মুসলিম লীগ, জামায়াত ও তৎকালীন চীনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ছাত্র সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আলেন্দের মতো মরে যাব, কিন্তু মাথা নোয়াব না।’ সেই ঘটনা ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট আকস্মিক হয়ে দেখা দিয়েছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু কালের দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে ঘটনা যখন বিশ্লেষণ করি তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্তের সঙ্গে উপযোগী তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি ঘটনা তৈরিতে কিভাবে তারা সক্ষম হয়েছিল।
তবে আমরা এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরম আশাবাদী। তাঁর আমলেই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার ও রায়ের আদেশ কার্যকর হয়েছে। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এজন্য জননেত্রীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্ব থাকলে পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
লেখক : ট্রেজারার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্রঃ দৈনিক জনকন্ঠ