1635
Published on সেপ্টেম্বর 9, 2020জেসমিন আমিন: দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, যাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়ে থাকে, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য এবং অভিভূত হয়েছিলাম। এখানে শ্রদ্ধেয় মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই, আহমেদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, নীলিমা ইব্রাহীম, রফিকুল ইসলাম প্রমুখকে আমরা শিক্ষক রূপে পেয়েছি। এত বড় সৌভাগ্য ক’জনের হয়! এদের মধ্যে প্রথম তিনজনকে আমরা একাত্তরে হারিয়েছি।
পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গেও বড় চমৎকার দিন কাটে। এখানে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছি বেবী মওদুদ, কণা, মিনু, আলেয়া, সেলিমা, বেলিদের এবং শেখ হাসিনাকে, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কলেজেও আমরা সতীর্থ ছিলাম।
লম্বা ছিপছিপে গড়নের হাসি-খুশি প্রাণচঞ্চল সুশ্রী মেয়েটিকে ভালো লাগত। কৌতুকময় চঞ্চল চোখ, পিঠের ওপর লম্বা একটি বেণি, পোশাক-পরিচ্ছদে সাদাসিধা এবং সুরুচিসম্পন্ন। কলেজে পড়াকালীন সাদা সালোয়ার-কামিজেও দেখেছি সম্ভবত। সদালাপি মেয়েটি মজা করে কথা বলত। হাসাতে পারত।
সেই সময় শনিবার ১০টায় বলাকা সিনেমা হলে বাংলা ছবি হতো। আমাদের ক্লাসের মেয়েরা দল বেঁধে ছবি দেখতে যেতাম। আমি তো সবসময় ছবির পোকা ছিলাম। দেখা ছবি বলে যদি না যেতে চাইতাম, হাসিনার কথামতো কণা সবার কাছ থেকে একআনা করে চাঁদা উঠাত আমার টিকিটের দাম দেওয়ার জন্য। পনেরোআনার টিকিট দিয়ে দল বেঁধে রিয়ারস্টলে বসে সবাই হাসি-গল্পে মজা করে ছবি দেখতাম। আনন্দ করাটাই ছিল মুখ্য।
মনে হয়, ১৯৬৭ সালে ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনার ড. ওয়াজেদ সাহেবের সঙ্গে শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। হাসিনার বিয়ের পরদিন জেলগেটে বাবার সাথে দেখ হয়। বিয়ের পরও হাসিনার সাজপোশাকে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরাবরের মতো সাদাসিধাই ছিল। তবে দু-হাতে স্বর্ণের চুড়ি পরত ও মাঝে মাঝে খুব হালকা রঙের শাড়ি।
একবার আমাকে নিয়ে নিউমার্কেটে গিয়ে টুকিটাকি সেরে বলাকা সিনেমা হলের পিছন দিকটায় (বর্তমানে গাউছিয়া) গিয়ে ব্যাংকে কাজ সেরে সম্ভবত ধানমন্ডির ২ নম্বর রোডে তার নিজের বাসায় নিয়ে গেল। সেখানে ওয়াজেদ সাহেব ছিলেন। আমরা একসাথে বসে ভাত খেলাম। ইলিশ মাঝের মাথা দিয়ে পুঁইশাক ছিল মেন্যুতে, মনে আছে।
১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর আমাদের বন্ধু বেবী মওদুদের সঙ্গে হাসিনার ওখানে গিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে মিলাদেও যেতাম বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। আমার স্বভাব একটু মুখচোরা গোছের। ছাত্র-জীবনে তার সঙ্গে প্রথমে তুই তুকারি সম্বোধন করলেও পরে তুমির দূরত্বে সরে যাই। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ওটাই রয়ে গিয়েছে।
সত্তরের মে মাসে আমার বিয়ের কার্ড দিতে গিয়েছিলাম বন্ধুদের। কার্ড হাতে নিয়ে বলল ‘যদি ভিপি আর জিএস’-এর ভোটটা দিয়ে যাস, তাহলে বিয়েতে যাব।’ সেদিন রোকেয়া হলে ছাত্র সংসদের ইলেকশন চলছিল। তুমুল হৈচৈ-ব্যস্ততা।
হাসিনা প্রকৃতিপ্রেমী। ওর কাছে গাছপালা খুব প্রিয়। খবরের কাগজে পড়েছিলাম একবার অনেকটা পায়ে হেঁটে একটা তমাল গাছ দেখতে গিয়েছিল টাঙ্গাইল অথবা মধুপুরের দিকে, ঠিক মনে নেই।
প্রথম গণভবনে যাওয়ার পর বেবী বলল, হাসিনা বনসাই খুব পছন্দ করে। খুব সুন্দর একটা বনসাই তাকে গিফট করলাম, যা পরে আমাকে দেখিয়েছে, ওটা ব্যালকনিতে লেখার টেবিলের সামনে রেখেছে। ওর ইচ্ছানুসারে রাজশাহী থেকে এক দক্ষ বনসাইবিদের সাহায্যে কুড়িটা বনসাই আনিয়ে দিলাম। আমার নিজের থেকেও দিলাম দুটি। ডালপালা বড় হয়ে গেলে মাঝে মাঝে গিয়ে ওগুলোর ডালপালা ছেঁটে দিতাম, অয়্যারিং করে দিতাম। বনসাই বিষয়ক একটি বই তাকে দিয়েছিলাম।
সেই সময় হাসিনার সঙ্গে বসে গল্প করতাম, চা-নাস্তা খেতাম। আমাকে গণভবনের চারপাশ ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। গাছপালা, মাশরুম ঘর, পীচ ফল প্রভৃতির গাছ, কুর্চি ফুলের গাছ। আমার কুর্চি গাছটা মরে গিয়েছে শুনে টবসহ একটা গাছ আমাকে দিল। আমি খুব খুশি। দেখলাম মালি তমাল গাছের দু-পাশে বিস্তৃত সুন্দর ডালগুলো ছেঁটে ফেলেছে। ডালই তো এ গাছের সৌন্দর্য। এ-কথা শুনে মালিকে ডেকে বলে দিল। অ্যাসপারা গাছের বেডের কাছে নিয়ে গিয়ে কচি ডগা ভেঙে দিয়েছে। বলেছেÑ ‘খেয়ে দেখ ভালো লাগবে।’
আসলেই খেতে বেশ। আগে কখনও এই সবজিটা এভাবে খেয়ে দেখিনি। যখনই গিয়েছি, দিয়েছে। বর্তমানে সম্ভবত এই গাছের বেড এবং রক গার্ডেন সামনের বাগানে নেই।
তার ছেলে বউ নিয়ে দেশে এলে সুধাসদনে আমরা কয়েকজন বউ দেখতে গেলাম। বেবী মওদুদ, জাহানারা নিশি, হীরাফুলরা ছিল। হাসিনার জন্য বেশ কিছু অর্কিড প্ল্যান্ট নিয়ে গিয়েছিলাম।
লিখতে ভুলে গিয়েছি, ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গণভবনে আমাদের বাংলা বিভাগের সতীর্থদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। প্রায় সবাই গিয়েছি। আনন্দ করেছি।
প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ ও ঈদের সময় নিয়মিত প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা কার্ড পেয়ে থাকি। রমজানের সময় ইফতারির নিমন্ত্রণ থাকে। গণভবনে গেলে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হয়। হাসিনা ঘুরে ঘুরে হাসিমুখে কুশলবিনিময় করে সবার সঙ্গে।
একসময় কিছুটা ঘনিষ্ঠতা থাকলেও দিনে দিনে ওর ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে অনেক বেশি। আমাদের যোগাযোগ সেতু বেবী মওদুদও আর বেঁচে নেই। কিন্তু পুরনো দিনগুলোকে মিস করি খুব।
লেখক : শেখ হাসিনার সতীর্থ
সূত্রঃ উত্তরণ