2599
Published on আগস্ট 23, 2020১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতার কথা শুনলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কুটনীতিকরা।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটি আয়োজিত এই অনলাইন আলোচনায় ঢাকায় নিযুক্ত ইন্ডিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানীসহ বিভিন্ন দেশের ৪০ এর বেশি রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং প্রতিনিধি অংশ নেন।
শনিবার (২২ আগস্ট) রাতে ’১৫ আগস্ট অ্যান্ড ইট’স আফটারম্যাথ’ শীর্ষক এ বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে ‘দ্য ডার্কেস্ট নাইট অ্যান্ড ইট্স আফটারম্যাথ’ শীর্ষক একটি বুকলেটের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এর হার্ড কপি পরিবর্তিতে বিভিন্ন মিশনে পাঠানো হবে।
আলোচনায় কি-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তব্য রাখেন শেখ ফজলে শামস পরশ। বক্তব্যে তিনি তার শৈশব, ১৫ আগস্টের ভয়াল স্মৃতি এবং পরবর্তী সময়ে রিফিউজি জীবনের কথা তুলে ধরেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মমতার কথা স্মরণ করে শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, খুব ভোরে বুলেটের শব্দে ঘুম জেগে উঠি। আমি যখন জেগে উঠি বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই ছিলাম। আশেপাশে বাবা-মা কেউ ছিলেন না। চারপাশে গন্ডগোলের শব্দ ছিল, বুলেটের শব্দ ছিল। সিঁড়ির রুমের দিক থেকে শব্দ আসছিল।
তিনি বলেন, আতঙ্কিত হয়ে আমরা এক ভাই আরেক ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছিলাম। সিড়ির রুমের দিকে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি বাবা-মা নিচে পড়ে আছেন। তারা মারা যাচ্ছিলেন।
পরশ বলেন, চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও চাচি আমার বাবা-মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। ততক্ষণে আমার বাবা সম্ভবত মারা যান। বাবা কোনো নড়াচড়া করছিলেন না। কোনো শব্দ করছিলেন না। কিন্তু আমার মা কথা বলতে পারছিলেন। মা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এবং পানি চেয়েছিলেন। আমার মা চাচা-চাচিকে বলেন আমার পরশ-তাপসের কী হবে? আমার বাচ্চাদের দেখে রেখো।
চারদিকে বুলেটের শব্দ আসছিল জানিয়ে শামস পরশ বলেন, এরপর চাচা-চাচি আমাকে আর তাপসকে ভেতরের রুমে নিয়ে নিচে ফ্লোরে শুইয়ে দেন। যাতে আমাদের গায়ে বুলেট না লাগে।
৭৫ এর ১৫ আগস্ট প্রাণে বেঁচে গেলেও পরবর্তী সময়ে পালিয়ে থাকা, রিফিউজি হিসেবে ভারতে পালিয়ে যাওয়াসহ কষ্টকর জীবনের কথা তুলে ধরেন শেখ ফজলে শামস পরশ।
পরবর্তী উদ্বাস্তু জীবনের কথা তুলে ধরে পরশ বলেন, এরপর থেকে আমাদের উদ্বাস্তু জীবন শুর হয়। একদিন এই বাড়িতে তো আরেক দিন অন্য বাড়িতে পালিয়ে থাকতাম। এভাবে বেশ কয়েক মাস থাকতে হয়। এই সময়টাতে সেনা সদস্যরা আমাদের খুঁজতে আসতো।
তিনি বলেন, আমরা যেসব বাড়িতে আশ্রয় নিতাম সেসব বাড়ির লোকজনকে হয়রানি করা হতো। হুমকী দেওয়া হতো।
৭৫ এর ১৫ পরবর্তী সময়ে প্রতিকূল পরিবেশে দেশ ছেড়ে পালানোর কথা স্মৃতিচারণ করে পরশ বলেন, আগরতলা দিয়ে প্রথম বার আমরা দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সফল হইনি। পরে মেহেরপুর দিয়ে দ্বিতীয় বার চেষ্টা করি এবং দেশ ছেড়ে যাই।
পালিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময়কার ভয়ংকর কষ্টকর পরিস্থিতির কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, কাদা-পানি, জঙ্গলে ভীতিকর পরিবেশে আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল। বিদেশে রিফিউজি হিসেবে থাকার কষ্টের কথাও তুলে ধরেন পরশ।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে শামস পরশ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগের আমার জন্ম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার ছোট ভাই তাপস (ঢাকা দক্ষিণ সিটির বর্তমান মেয়র) জন্মগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন। স্বাধীনতার অর্জনের পর ১৯৭২ সালে তিনি ফিরে এসে দেশ গড়ার কাজ শুরু করেন। এই সময়টাতে আমার বেড়ে ওঠা।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কথা স্মরণ করে পরশ বলেন, তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার সব আবদার থাকতো ওনার কাছে। আর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি ছিল আমার প্রিয় জায়গা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের তিনি স্নেহ করতেন। আমাকেও পছন্দ করতেন, আদর করতেন।
আলোচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, সংগ্রাম, ত্যাগ, কারাগারে বন্দী জীবন এবং বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে তার স্বপ্ন, দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার কথা কথা তুলে ধরেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে বন্ধুপ্রতিম কুটনীতিকদের প্রতি আহ্বানও জানান একে আব্দুল মোমেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা কুটনীতিকদের
বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বলেন, বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম যুক্তরাজ্য যান। সেখানে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাকে শুভেচ্ছা জানান। বৃটিশ হাইকমিশনার বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত চাইনিজ রাষ্ট্রদূত লি জিমিং (Li Jiming) ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের কথা স্মরণ করে বলেন, চীনের জনগণ তাকে উষ্ণ অভ্যার্থণা জানিয়েছিল। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভিশনারি নেতৃত্বকে বর্তমান বাংলাদেশের মূল্যবোধ নির্ধারণ করে। বঙ্গবন্ধুর লিগ্যাসিকে তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার ফারেনহোল্টজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, সমাজের সবার সমান অধিকার এবং বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে বাস্তব রূপ দিতে সংশ্লিষ্ট সকলের একযোগে কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশে নিযুক্ত শ্রীলংকান হাইকমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) ডিপিএসএন দয়াশেখর (D.P.S.N. Dayasekara) বলেন, স্বাধীনতার পর প্রথম দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী দেশ শ্রীলংকা। সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিতে সবার বঙ্গবন্ধুর মূল্যবোধকে অনুসরণ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো সবার জন্য মুক্তি, কাউকে পেছনে না পেলে সমতা নিশ্চিত ও টেকসই উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নীতির কথা উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে জাতিসংঘ সব সময় পাশে থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের (সুইস) রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনার বর্ণনা শুনে গভীরভাবে মর্মাহত বলে জানান। ‘বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর এই ভিশনের কথা শুনে তিনি আনন্দিত বলে উল্লেখ করেন। রাষ্ট্রদূত নাথালি আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের সম্পর্ক আরও গভীর ও শক্তিশালী হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জমির।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও উপ কমিটির সদস্য সচিব শাম্মী আহমেদ।
সৌজন্যেঃ www.banglanews24.com