1335
Published on আগস্ট 18, 2020পাভেল রহমানঃ
কি কষ্টের কি কঠিন এক জীবন নিয়ে বেঁচে থাকেন নিরাপত্তার দেয়াল ঘেরা ভবনে শেখ হাসিনা ‘ অতীত ‘ যেখানে করে আনাগোনা…।
হাসিনা আপা আর বেবি আপা ছিলেন ঘনিষ্ঠ দুই বান্ধবী। আশির দশকে দীর্ঘ আর দুঃসহ প্রবাস জীবন ছেড়ে হাসিনা আপা ফিরে এলেন স্বদেশে , প্রান প্রিয় বাংলাদেশে । দেশে ফিরলে কি হবে নিজ বাড়িতে ঢোকার পথ ছিল রুদ্ধ। নানা অজুহাতে তখনকার সরকার ৩২ নাম্বারের ঐতিহাসিক সেই বাড়ীটি ফেরত দিতে অস্বীকার করতে থাকে। শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নিজ দেশে জাতির পিতার সন্তান শেখ হাসিনাকে তাঁর ন্যূনতম নাগরিক অধিকারও দিতে চায় নাই তারা ।
ঐতিহাসিক ৩২ নাম্বারের বাড়ীটি স্বাধীনতা সময়ের সেইদিন গুলিতে ছিল বাঙ্গালীর ঠিকানা । কি দুর্ভাগ্য শেখ হাসিনার রাস্তায় চাদর বিছিয়ে দিনের পর দিন করেছেন কোরান পাঠ । এমন কি নিহত মা বাবা তিন ভাই আর নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল আর রোজী জামালের আত্মার মাগফেরাত কামনায় আল্লাহ্র কাছে দোয়া চাইতেও বাঁধা দিয়েছে শাসক গোস্টী। খোলা আকাশের নীচে রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রতীক্ষায় থেকেছেন দিনের পর দিন পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পাগল প্রায় এই মানুষটি । তারপরও বাড়ীতে ঢোকার অনুমতি পাননি। তবে পেয়েছিলেন নিঃস্ব স্বার্থ কিছু মানুষ । তাঁদের মাঝে অন্যতম ছিলেন এক বান্ধবী , বেবি মওদুদ। ছায়ার মতই ছিলেন বেবি আপা হাসিনা আপার সাথে। সামরিক জান্তার রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করেও অসীম দুঃখ ভরা তাঁর সেই জীবনের প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন তাঁর নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বেবি আপা ।
প্রতীক্ষার শেষ হলো এক সময় । হার মেনেছিল সরকার । বাড়িটি ফিরে পেয়ে যেদিন তিনি প্রবেশ করেছিলেন নিজ বাড়ী ৩২ নাম্বারে সেই দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়। চোখের পানি আর বুক ভরা হাহাকার শুধু শেখ হাসিনারই ছিলনা ছিল সেই দিন তাঁর সতীর্থদের সবার মাঝেও । কেউ ছিলেন না সেইদিন কষ্টের সাগরে ডুব দেয়া পাগল প্রায় হাসিনা আপাকে থামাতে পারে । প্রিয়জন হারানোর বেদনায় সান্ত্বনা দিতে পারে। প্রয়াত জোহরা তাজউদ্দীন , সাজেদা আপা , আইভি আপা , সাহার খাতুন সবাই হাসিনা আপার কান্না থামাবেন কি নিজেরাই ছিলেন শোঁকে মুহ্যমান।
ঐতিহাসিক বাড়িটির মানুষ গুলিকেই ঘাতকরা গুলি করে হত্যাই শুধু করেনি তাঁরা লুট করেছিল বাড়িতে রক্ষিত বাংলার মানুষের ভালোবাসা । ভালবাসার স্মৃতি স্বরূপ বাংলাদেশের অপমার জনগণের কাছে পাওয়া অজস্র স্বর্ণের আর রুপোর তৈরি নৌকা গুলিও । ঘাতকরা সর্বস্ব লুট করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা এতোটাই নির্মম আর হিংস্র ছিল যে রক্ত মাখা বেয়োনেট দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ এক শোবার খাঁটের তোষককে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করেছিল ক্ষত বিক্ষত। দেয়ালে সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর ছবিতে প্রিয় লাইব্রেরীতে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ আর জাতীয় কবি কাজী নজরুলের এর বইয়ে চালিয়েছিল বন্দুকের গুলি।
বঙ্গবন্ধুর শখের পাইপ গুলি পড়ে ছিল নির্বাকার। খালাম্মার (বেগম মুজিবের ) প্রিয় পানের বাটায় রাখা পান গুলি বেদনায় শুকিয়ে বিবর্ণ হয়েছে ফাগুণের ঝরা পাতার মত রুক্ষ। রাসেলের ছোট্ট প্রিয় সাইকেলটা কেমন একাকী দাঁড়িয়ে থাকে দেয়ালে দিব্যি হেলান দিয়ে । যেন প্রতীক্ষায় আজো মিষ্টি শিশু রাসেলের । টুংটাং শব্দ তুলে ছুটবে সে হেসে! জামালের ঘরটা তখনো মেহেদির রঙে বিভোর। মাত্র কদিন আগে নববধূর সাজে ঘরে তুলেছিল রোজ জামালকে ব্রিটিশ রাজকীয় আর্মির গর্বিত বাঙ্গালী ক্যাপ্টেন শেখ জামাল। জামালের ঘরের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধা নিঃসঙ্গ ছবিটিতে চোখ পড়তেই দুলে উঠে বুক, সারল্য ভরা টগবগে এক তরুণ শেখ জামালের মুখায়েব দেখে! সে যেন ' এখন যৌবন যার ' কবি হেলাল হাফিজের কবিতার শব্দে ভরা নায়কের প্রতিচ্ছবি।
তিন তালায় খোলা প্রশস্ত ছাদের সাথে লাগোয়া লম্বা ঘরটায় ছিল শেখ কামালের সাজানো সংসার। যে যুবক ছায়ানটের শাস্ত্রীয় সংগীতের ছাত্র সেতারে আঙ্গুল ছোঁয়ায় তুলেছিল সূরের মূর্ছনা , যে যুবক পায়ে বল নিয়ে দুরন্ত এক আধুনিক ফুটবলের আবগাহনে মেতেছিল আবাহনী গড়ে , যে যুবক হাজার যুবকের স্পন্দন জাগাতে সৃষ্টি করেছিল ' স্পন্ধন শিল্পী গোস্টী '। তুখোড় সংলাপে মাতিয়ে দর্শক নন্দিত হয়ে নাট্য চক্র আর ঢাকা থিয়েটারের মঞ্চে তুলেছিল তুমুল করতালি । বীর মুক্তিযুদ্ধা তাঁর অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞানে ৫ম স্থান অধিকারেই শুধু নয় ইউনিক ব্যবহারে মাতিয়ে রেখেছিল শিক্ষক বন্ধু আর কনিষ্ঠদের। অহংকারহীন শেখ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামালকে নিয়ে সদ্য বিবাহিত জীবন শুরু করেছিল যে ঘরটিতে সেই সংসার চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় ঘাতকের বুলেটে । পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্রের মতই সাহসী শেখ কামাল নিজের জীবন বিপন্ন করে সর্বপ্রথম বুক পেতে দেয় বুলেটের সামনে আর ছোট্ট রাসেল সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান হয়ে মায়ের কাছে চলে গেল সর্বশেষে।
কি কষ্টের কি কঠিন এক জীবন নিয়ে বেঁচে থাকেন নিরাপত্তার দেয়াল ঘেরা ভবনে শেখ হাসিনা ‘ অতীত ‘ যেখানে করে আনাগোনা…।
লেখকঃ আলোকচিত্রী, আবাহনী লিমিটেডের প্রথম অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার