আমার বড় ভাই শেখ কামাল

1299

Published on আগস্ট 7, 2020
  • Details Image

ডলি জহুরঃ

আমি আর শেখ কামাল ভাই একই নাট্যদলে কাজ করতাম, নাটকের রিহার্সাল প্রতিদিন বিকাল থেকে শুরু হয়ে একটানা রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত চলতো। রিহার্সাল শেষে আমি বাসায় ফিরতাম কামাল ভাইর সাথে, কামাল ভাই আমাকে আমাদের হাতিরপুলের বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাসায় যেতেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে ঢাকা শহরে রাত ১০টা মানেই অনেক রাত, একেবারেই ফাঁকা। সেখানে প্রতিদিন কামাল ভাই আমাকে ১১টা-১২টার দিকে আমার বাসায় পৌঁছে দিতেন।

প্রেসিডেন্টের ছেলে হয়েও তাঁর কাছে সবসময় টাকা থাকতো না, এটা নিয়ে অনেক ক্ষ্যাপাতাম আমরা। শুধু আমি একাই না ক্যাম্পাসেও তাঁর বন্ধুরা তাঁকে এই জন্য ক্ষ্যাপাতো। কামাল ভাইয়ের কাছে টাকা না থাকলে আমরা হেঁটে বাসায় যেতাম, আর টাকা থাকলে যেতাম রিকশায়।

কতো রাতের পরে রাত উনার সাথে আমি একা একা বাসায় ফিরেছি, অথচ একবারের জন্যও আমি তাঁকে আমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকাতে দেখিনি। আমি শেখ রেহানার বান্ধবী ছিলাম, ছেলেরা ছোট বোনের বান্ধবীদের সাথে কতো রকম দুষ্টামী করে, কিন্তু কামাল ভাই কোনদিন তা করেননি। ভুল করেও কোনদিন বলেননি, ‘ডলি তোর হাতটা দে তো ধরি।’ এক কথায় কামাল ভাই ছিলেন আমার আপন বড় ভাইয়ের মতো, শুধু আমি কেনো যেসব মেয়েরাই কামাল ভাইয়ের সাথে মিশতো সবাই এই কথা স্বীকার করবেন। আর এই দেশের নষ্ট মস্তিষ্কের কিছু মানুষ তাঁকে নিয়ে কতো রকমের অপপ্রচার চালালো। কামাল ভাই নাকি কার বৌকে তুলে নিয়ে গেছেন, হ্যান ত্যান। মানুষ এতো মিথ্যাবাদী হয় কি করে! আমি ভেবে পাই না।

কামাল ভাই ছিলেন প্রেসিডেন্টের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য শত শত মেয়ে পাগল। কখনও কোনদিন আমরা তাঁকে সেসব মেয়েদের পাল্লায় পরতে দেখিনি। তিনি কি পারতেন না সেসব মেয়েদের সাথে নোংরামী করতে?

এখানেই শেষ নয়, সুলতানা কামালকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন কামাল ভাই। সুলতানা আপা ছিলেন নামকরা একজন খেলোয়াড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলা-ধুলার জন্য তিনি একনামে পরিচিত ছিলেন। অনেক লম্বা আর শক্তপেটা শরীর। আমরা ওনাকে ভয় পেতাম। সহজে কেউ সুলতানা আপার কাছে যেতাম না। ছেলেরাও ভয় পেত তাঁকে। এড়িয়ে চলতো। সেই সুলতানা আপাকে পছন্দ করে বসলেন কামাল ভাই, আর তাঁর হয়ে সুলতানা আপার কাছে এই কথাটা বলার দ্বায়িত্ব দেন আমাকে, আমি তো ভয়েই শেষ, না করে দিলাম, কিন্তু কামাল ভাইয়ের কথা ভেবে রাজী হলাম শেষ পর্যন্ত। কথা দিলাম সুলতানা আপাকে জানাবো যে, কামাল ভাই তাঁকে পছন্দ করে। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, জানানো আর হয় না। কি করে হবে? আমি যতবার সুলতানা আপার কাছে এই কথা বলতে গিয়েছি ততবারই ভয়ে আমার গলা শুকিয়েছে। ‘তুই ভীতু, তেলাপকা দেখে মরে যা’Ñএসব কতো রকমের কথা শুনালো কামাল ভাই। অবশেষে আড়াই বছর অপেক্ষা করার পর কামাল ভাই নিজেই একদিন সুলতানা আপাকে জানালেন তাঁর মনের কথা, তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে সুলতানা আপা বলে দিলেন, প্রেম ট্রেম করতে পারবেন না, এতই যদি ভালো লাগে তবে যেন বাসায় লোক পাঠায়। তাই করেছিলেন কামাল ভাই। এবার ভেবে দেখুন, যে মানুষ একটা মেয়েকে ভয় পেয়ে তার সামনে দাঁড়াতে পারে না, যে মানুষ তাঁর ভালোবাসার কথা জানাতে আড়াই বছর সময় নেয়, সে মানুষ কি করে অন্যের বউ তুলে নেয়!

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশের মানুষকে শান্ত রাখতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতি ঘৃণার জন্ম দিতে সবরকমের চেষ্টা চালিয়েছে ঘাতকচক্র, কামাল ভাইও সেই অপচেষ্টার শিকার। ৫ টাকার বাদাম কিনে যে ছেলে তাঁর ছোট বোন আর তাঁর বান্ধবীদের খুশি করতে পারতো না, তাঁর নামেই ছড়ানো হয়েছে ব্যাংক লুটের কিচ্ছা-কাহিনী। আমার কথা হলো, কামাল ভাই যদি এত বড় লুটেরা হবে, তাহলে সেসব টাকা গেলো কই? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর বাসায় কিছুই পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো ব্যাংক একাউন্ট। তাহলে ব্যাংক লুটের টাকা কোথায় গেলো? বিশাল এই মিথ্যাটি ইতিহাসে কখনো স্থান পায়নি, আর কখনো পাবেও না, কামাল ভাই সবসময় আমাদের মাঝেই আছেন, আছেন আমাদের মনে।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত