2497
Published on আগস্ট 7, 2020আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট তাঁর জন্ম। আজ বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৭১ বছর। তাঁকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬ বছর। সদ্য বিবাহিত যুবক। মৃত্যুর মাত্র এক মাস আগে (১৪ জুলাই ১৯৭৫) ক্রীড়াবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফার্স্ট ফিমেল ব্লু’ সুলতানার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর হাতের বিয়ের মেহেদির রং তখনো মুছে যায়নি। এ অবস্থায় গোটা পরিবারের সঙ্গে এই নবদম্পতিকেও হত্যা করা হয়। তাঁর ছোট ভাই শেখ জামাল, সে-ও তখন নববিবাহিত। একেবারেই ছোট ভাই ১০ বছরের রাসেলকেও তাঁদের সঙ্গে নরপশুরা একই রাতে হত্যা করে।
বড় বোন, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে শেখ কামাল ছিলেন বছর দুই কি তিনেকের ছোট। পিঠাপিঠি ভাইবোন বলে দুজনের মধ্যে খুনসুটি ও অন্তরঙ্গতাও ছিল বেশি। এ সম্পর্কে একটি চমৎকার গল্প শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু প্রায়ই জেলে যেতেন। ফলে বড় মেয়ে শেখ হাসিনা তাঁকে ভালোভাবে চিনলে-জানলেও তাঁর ছোট ভাইবোনরা জেলে আটক বাবার দেখা-সাক্ষাৎ পেত খুব কমই।
একবার বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছেন। কামাল তখন খুব ছোট। বাড়িতে একজন অপরিচিত লোককে দেখে বিস্মিত হলেন। তিনি আরো বিস্মিত হলেন, যখন তিনি দেখলেন বড় বোন হাসিনা তাঁকে আব্বা ডাকেন। তিনি চুপি চুপি হাসিনাকে বললেন, ‘হাসু আপা, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা ডাকি!’ বঙ্গবন্ধুর নিজের কাছ থেকে গল্পটি আমার শোনা।
শেখ কামালের মৃত্যু হয়েছে ৪৫ বছর হলো। আমি অনেক সময় বিস্মিত হয়ে ভাবি, আজ বেঁচে থাকলে শেখ কামাল কী হতেন? একজন রাজনীতিবিদ, একজন ব্যবসায়ী, না একজন সেনানায়ক?
যে কোনো একটি হওয়ার যোগ্যতা তাঁর ছিল। তবে ব্যবসায়ী তিনি হতেন না। ব্যবসায় তার আগ্রহ ছিল না। সেনা অফিসার বা সেনানায়ক তিনি হতে পারতেন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ আর্মি থেকে ওয়ার টাইম কমিশন পেয়েছিলেন। তিনি গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আবার প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্বও পালন করেছেন।
আমার ধারণা, শেখ কামাল বেঁচে থাকলে রাজনীতিবিদ হতেন। রাজনীতিতে তাঁর ঝোঁক ছিল। অবশ্য ক্রীড়াবিদ ও সংগীতশিল্পী হিসেবেও তিনি ক্যারিয়ার গঠন করতে পারতেন। শুধু ক্রীড়াবিদ হিসেবে নয়, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও তাঁর নাম ছিল। আবাহনী তার নিজের হাতে গড়া সংগঠন। বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে আবাহনী এখনো একটি উজ্জ্বল নাম। ক্রীড়ার মতো সংগীতেও তাঁর সমান আগ্রহ ছিল। ঢাকার বিখ্যাত সংগীত বিদ্যালয় ছায়ানটে কামাল সেতার বাজানো শিখতেন এবং সেতারের শিল্পী হিসেবে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ কামাল সেনাবাহিনী ছেড়ে শিক্ষাজীবনে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোসিওলজিতে অনার্স গ্র্যাজুয়েট হন এবং মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে একই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি সমাপ্ত করেন। তাঁর সহপাঠী, সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব অনেকের মতে, শেখ কামাল পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডি এড়িয়ে বেঁচে থাকতে পারলে রাজনীতিকেই তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতেন এবং আজ বাংলাদেশের অবক্ষয়গ্রস্ত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি নতুন আশার আলো হয়ে ফুটে উঠতে পারতেন।
এই সম্ভাবনাটিই ধ্বংস করার জন্য ১৫ আগস্টের নরপিশাচরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, একে একে তাঁর পতœী, ৩ ছেলে, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, ২ নববিবাহিত ছেলের বউ ও অন্য আত্মীয়-পরিজনকেও হত্যা করেছে। তাদের ভয় ছিল, বঙ্গবন্ধুর বংশের কেউ বেঁচে থাকলে তাঁরা কেউ না কেউ আবার মাথা তুলবেন এবং বাংলার স্বাধীনতার শত্রæ ঘাতকচক্রকে নিশ্চিহ্ন করে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত রাজনৈতিক সাধনার সফল বাস্তবায়ন ঘটাবেনই।
তাই বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে তারা বাঁচতে দেয়নি। ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছেন ২ বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া ও তার দুই সন্তান শিশু জয় ও পুতুল। তারা তখন জার্মানিতে থাকায় ঘাতকের বুলেট থেকে বেঁচে যান। কিন্তু তাঁদের এ বেঁচে যাওয়াটা কি ভাগ্যের জোর, না ইতিহাস-বিধাতার ইচ্ছা? আমার তো মনে হয়, ইতিহাস-বিধাতার ইচ্ছা। বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সব পুরুষ সদস্যকে (শিশু রাসেলসহ) নির্মমভাবে হত্যা করার পর ঘাতকের দল ও তাদের নেপথ্যের দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকের দল ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুসহ বাংলার স্বাধীনতাকেও তারা সফলভাবে হত্যা করেছে। এই বংশের আর কোনো পুরুষ সদস্য রইলেন না, যারা এই স্বাধীনতাকে আবার উদ্ধার করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুর দুই বেঁচে যাওয়া কন্যার একজন গৃহবধূ এবং অন্যজন তখন অবিবাহিত, কুমারী। তাঁরা আর কী করতে পারবেন?
ইতিহাস-বিধাতা ঘাতকদের দম্ভ দেখে সেদিন নিশ্চয়ই মুচকি হেসেছেন। তারা সেদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেনি, ওই দুই বেঁচে যাওয়া বোনের মধ্যে এক শান্ত গৃহবধূ বোনটি বাবার রক্তমাখা রাজনৈতিক পতাকা হাত তুলে নেবেন এবং ঘাতকদের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝোলাবেন। শেখ হাসিনা যেন রূপকথার সেই অমোঘ নিয়তি! গল্পে আছে, এক ব্রাহ্মণ জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করে জেনেছিলেন, তার নিয়তি হচ্ছে একটি কুমির, কুমিরের হাতে তার মৃত্যু হবে। ব্রাহ্মণ ঠিক করলেন, তিনি ভুলেও কখনো জলে নামবেন না। সমুদ্রে, নদীতে তো নয়ই, এমনকি পুকুরেও নয়।
এদিকে যে রাজার ছেলের তিনি গৃহশিক্ষক ছিলেন, তার শখ হয়েছে সে নদীতে সাঁতার কাটতে যাবে। শিক্ষক ব্রাহ্মণকে তার সঙ্গী হতে হবে। শিক্ষক রাজি হলেন না। রাজাকে তার কারণ জানালেন। রাজা সব শুনে বললেন, আপনার ভয়ের কিছু নেই। আমি নদীতে স্নানের ঘাটের চারপাশে এমন শক্ত বাঁধ তৈরি করে দেব যে কুমির দূরের কথা, একটি পুঁটি মাছও সেই বাঁধঘেরা স্নানের ঘাটে ঢুকতে পারবে না। রাজার আশ্বাস পেয়ে ব্রাহ্মণ তার ছাত্রকে নিয়ে নদীতে সাঁতার কাঁটতে গেলেন। নদীতে নেমে হঠাৎ তিনি দেখেন, রাজার ছেলে ক্রমশ একটি কুমিরের চেহারা ধারণ করছে এবং বলছে, আমিই তোমার সেই নিয়তি, সেই কুমির। ব্রাহ্মণ কিছু বোঝার আগেই কুমিরটি তাকে নিয়ে নদীর অতলে তলিয়ে গেল।
এ যুগে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকেরা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা জাতির জনককে পরিবারের অধিকাংশ পুরুষ সদস্যসহ হত্যা করে ভেবেছিল, তারা নিষ্কণ্টক হয়েছে। কেউ আর তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। তারা শুধু ভাগ্যবিধাতাকে নয়, ইতিহাস-বিধাতাকেও ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে। তখন তারা জানত না এক গৃহবধূর ঘোমটার আড়ালের এক নারীসত্তা তাদের নিয়তির মতো তৈরি হচ্ছে। তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, এ নারী অমোঘ নিয়তির মতো বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝোলাবেন; একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন এবং তাদেরও চরম দণ্ডদানের ব্যবস্থা করবেন। এ রকম কাহিনী রূপকথায় পাওয়া যায়, বাস্তব জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে ইতিহাস-বিধাতা সেই অভাবনীয় ঘটনাটিই ঘটালেন।
শেখ কামালের কথায় আসি। বঙ্গবন্ধুর জীবনকালে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, তাঁর ভাগ্নে ও তাঁর আপন হাতে গড়া রাজনীতিক শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরাধিকার পাবেন। হয়তো তিনি পেতেন। শেখ কামাল বা শেখ জামাল তাঁর প্রতিদ্ব›দ্বী হতেন না। শেখ জামাল তো বিলাতের স্যান্ডহার্স্টে সামরিক ট্রেনিং নিয়ে সামরিক জীবনই বেছে নেবেন মনে হয়েছিল। শেখ রাসেল তো তখন খুবই ছোট। কেবল শেখ মনিকে হত্যা করা হলে শেখ কামাল তাঁর শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসতে পারতেন, তাঁর সেই সাংগঠনিক শক্তি ও মেধা ছিল, সুতরাং তাঁকে ও তাঁর ছোট দুই ভাইকেও হত্যা করে ঘাতকেরা নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল।
যদি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দুই বোন হাসিনা ও রেহানা ঢাকায় ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসায় থাকতেন, তাহলে তাঁদেরও যে হত্যা করা হতো, তাতে সন্দেহ নেই। বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়ায় তাঁরা হত্যা চক্রান্ত থেকে মুক্ত ছিলেন তা নয়। ঘাতকের বুলেট তাঁদেরও পিছু পিছু ঘুরেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মাতৃসমা হৃদয় নিয়ে দুই বোনকে দিল্লিতে আশ্রয় দিয়েছেন। নিরাপত্তা দিয়েছেন। বাবার কাছে যে রাজনীতির পাঠ হাসিনা নিতে পারেননি, সেই পাঠ তিনি নিয়েছেন জওহরলালকন্যা ইন্দিরার কাছ থেকে। কিন্তু ব্যক্তিত্ব ও সাহস পেয়েছেন বাবা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই।
এই ব্যক্তিত্ব ও সাহস আমি শেখ কামালের মধ্যেও দেখেছি। তাঁর মধ্যে এই সাহস ও ব্যক্তিত্ব দেখেই যুগোস্লাভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ টিটো বঙ্গবন্ধুকে বলে-কয়ে কামালকে নিজের কাছে নিয়ে কিছুকাল রেখেছিলেন। টিটো হয়তো চেয়েছিলেন কামালকে তাঁর মতো একজন যোদ্ধা-রাজনীতিক হিসেবে গড়ে তুলতে। জীবিত থাকলে শেখ কামাল হয়তো তাই হতেন। তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবেও রূপ নিতে পারত। টিটোর স্বল্পকালের সান্নিধ্যেই শেখ কামালের রাজনৈতিক বোধের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা দৃঢ় ভিত্তি লাভ করতে চলেছিল। তাঁর সঙ্গে কয়েকবার ব্যক্তিগত আলাপেও এটা আমি লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ কামাল যদি তাঁর নিজস্ব ভ‚মিকা রাখার সুযোগ পেতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আরো বেশি সহজ ও দ্রুততর হতো বলে আমার ধারণা।
চরিত্র হনন, তাতে ব্যর্থ হলে শারীরিক হত্যা। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে এটাই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রগুলোর একমাত্র লক্ষ্য। এই লক্ষ্য সাধনের জন্য শেখ হাসিনাকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল গ্রেনেড হামলা। শেখ কামাল ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরাধিকার গ্রহণ করতে পারেনÑএই সম্ভাবনা থেকে চক্রান্তকারীর দল রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়ার আগেই তাঁরও চরিত্র হননের অভিযান শুরু করে। ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িত হয়ে শেখ কামালের গুলিবিদ্ধ হওয়ার গল্প এই চরিত্র হনন অভিযানেরই একটি অংশ ছিল।
আসল ঘটনাটি ছিল, বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে জাসদের একটি হঠকারী অংশ এবং তখনকার চীনপন্থী কিছু স্প্লিন্টার্স সন্ত্রাসী গ্রুপ দেশের চারদিকে, এমনকি রাজধানী শহরেও সন্ত্রাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। সে রাতে গুজব রটেছিল, সন্ত্রাসীরা ঢাকার মতিঝিল এলাকায় তৎপরতা চালাবে। খবরটি জেনে শেখ কামাল তাঁর কয়েকজন সহকর্মীসহ মতিঝিল এলাকায় টহল দিতে গিয়েছিলেন। পুলিশও বেরিয়েছিল সন্ত্রাসীদের দমনের জন্য। রাতের অন্ধকারে কামালের গাড়িকেই সন্ত্রাসীদের গাড়ি ভেবে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে শেখ কামাল গুরুতর আহত হন। চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করে তাঁর জীবন রক্ষা করেন।
এই খবরটিকেই স্বাধীনতার শত্রুশিবির তাদের প্রোপাগান্ডার শক্তির জোরে ব্যাংক ডাকাতির গল্পে রূপ দেয় এবং সারাদেশে ছড়ায়। এ সময় লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের তৎকালীন সাংবাদিক পিটার হেজেল হার্স্ট ছিলেন ঢাকায়। তাঁকে এই খবরটি খাওয়ানোর চেষ্টা করলে (যাতে তিনি টেলিগ্রাফে খবরটি ছাপেন) তিনি বলেছিলেন, একজন প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ব্যাংক ডাকাতির দরকার কী? টাকা চাইলে তো ব্যাংক ম্যানেজাররাই তাঁকে টাকা এনে দেবেন। হেজেল হার্স্টের কথাটা কত যে সত্য, তা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার শাসনামলে তার পুত্র তারেক রহমান হাওয়া ভবনে যে টাকার পাহাড় তৈরি করেছিলেন, তার জন্য তাকে কি ব্যাংক ডাকাতি করতে হয়েছিল?
বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফার আন্দোলনে কারাবন্দি, তাঁর সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মনি, তখন শেখ কামালের সঙ্গে আমার সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল। শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো ছিল না। কিন্তু শেখ কামালের সঙ্গে আমার একটি সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে দেরি হয়নি। বঙ্গবন্ধু একসময় ঢাকার নিউ মার্কেটের সামনে ‘পূর্বাণী’ নামে একটি চা-বিস্কিট-চকোলেটের দোকান দিয়েছিলেন। দোকানটি চালাতেন বরিশালের হিজলার এক নজরুল অনুসারী কবি জুলফিকার। তিনি বঙ্গবন্ধুরও অন্ধ অনুসারী ছিলেন। এই ‘পূর্বাণী’তেও মাঝেমধ্যে বিকেলে কিশোর কামাল তাঁর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতেন। আমাকেও টেনে বসাতেন সেই আড্ডায়। তখনই তাঁর মধ্যে যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ দেখেছি, তা আমাকে বিস্মিত করত।
দেশে বর্তমানে যে অস্থির রাজনীতি, মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার আস্ফালন, সন্ত্রাসের হুংকার, এই পরিস্থিতিতে শেখ কামালের কথা মাঝেমধ্যে স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে। ভাবি, তাঁর সাহস-দীপ্ত তারুণ্যের আজ প্রয়োজন ছিল। মাঝেমধ্যে ভাবতে চেষ্টা করি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল রাতে যদি শেখ মনি বা শেখ কামালদের একজনও বেঁচে যেতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস আজ কী রূপ নিতে পারত? এত হনুমানের মুখভেংচি কি আমাদের সহ্য করতে হতো? না, শেখ হাসিনা, যদি তখন রাজনীতিতে আসতেনও, তাঁকেও একা দুর্গমগিরি দুস্তর মরু পার হওয়ার জন্য জীবন হাতে অবিরাম যুদ্ধ করতে হতো? আজ কামালের ৭১ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার জন্মদিনে তাঁকে আবার স্মরণ করছি। মনে মনে বলছি, তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ করো।
সৌজন্যেঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ