1817
Published on আগস্ট 5, 2020কাজী নাবিল আহমেদঃ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে, পারিবারিকভাবে একজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব যেমন ছিলেন তেমন ছিলেন বোদ্ধাও। তারই উত্তরসূরি বড় ছেলে শেখ কামাল ছিলেন একজন অতুলনীয় ক্রীড়া সংগঠক। যার সুচিন্তিত পরামর্শ আর নির্দেশনার পথে হেঁটে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সদ্যোজাত একটি দেশের ক্রীড়াঙ্গন ক্রীড়া জগতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিল।
শেখ কামাল, দুর্দান্ত তরুণ, অসামান্য চৌকস আর বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে এই ক্রীড়াবিদ সোনার বাংলা গড়ে তোলার অন্যতম হাতিয়ার দেশের তরুণদের সংগঠিত করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর সতীর্থ ও বন্ধু হারুনুর রশীদ, ফারুক আহমেদ বাচ্চু, সালমান এফ রহমান, আনোয়ারুল হক তারেক, সাহাবুদ্দীন সেন্টু, কে এম মোজাম্মেল, জি এম ইকবাল ও জি এম ফারুকসহ আরও অনেককে নিয়ে ১৯৭২ সালে আবাহনী ক্রীড়া চক্র প্রতিষ্ঠা করেন। আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালে অন্যতম সদস্য ছিলেন তাঁর বড় বোন বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এখনও ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
স্বীকার করতেই হবে, ক্রীড়াঙ্গনে নতুন বার্তা আবাহন করে এই ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বিদেশি খেলোয়াড় এনে খেলার মানোন্নয়ন, মাঠের উন্নয়ন সাধনের মধ্য দিয়ে যিনি বদলে দেন বাংলাদেশে প্রচলিত ফুটবল খেলার ধরন; তিনি শেখ কামাল। যার পরিকল্পনায় খেলাটাও হয়ে ওঠে সংগঠিত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম। তারই হাত ধরে একের পর এক চাকচিক্য, কৌশলী এগিয়ে চলা খেলোয়াড়রা শিখছিল বলেই আবাহনীকে আজও বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়।
শুধু ফুটবল নয়, ক্রীড়াপাগল বঙ্গবন্ধুর সার্থক উত্তরসূরি ছিলেন ক্রীড়াব্যক্তিত্ব শেখ কামাল। একইসঙ্গে বাস্কেটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ও অ্যাথলেটে পারদর্শী ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্রিকেট লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী ক্রীড়া চক্র, একই সালে বাস্কেটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। মজার বিষয় হচ্ছে, উভয় দলেরই খেলোয়াড় ছিলেন শেখ কামাল। একই বছর সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হয়েছিলেন দ্রুততম মানব। শেখ কামাল আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হয়ে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেললেও বাস্কেটবল খেলেছেন বাবার প্রিয় ক্লাব ওয়ান্ডারার্সের হয়ে। তাঁর নেতৃত্বে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাস্কেটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়।
শেখ কামাল রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়ার পরও খেলাধুলাই তিনি তার কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নিতে পেরেছিলেন। দেশ গঠনে কিশোর আর তরুণদের বিপথে না যেতে দেওয়ার মতো গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিতে পেরেছিলেন তিনি। সদ্যোজাত দেশকে গড়ে তোলার সেই অবদান কখনোই কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে কম নয়। ফলে ক্রীড়াজগতকে সাজাতে পারলে বাংলাদেশকে উচ্চতায় আসীন হওয়া সহজ হবে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বলে তার কাছে এটিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। হয়তো জাতির সামনে আরও অনেক কিছুই প্রকাশ করার ছিল তার। কিন্তু, সে সুযোগ আর পাননি তিনি। ঘাতকদের নির্মম বুলেটে ওই বছরই বাবা আর পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নির্মমভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি।
শেখ কামালের ধ্যান-জ্ঞান যে ছিল ক্রীড়াজীবন, তা তার পথচলাকেন্দ্রিক আচরণে টের পাওয়া যায়। হয়তো এই কারণেই বঙ্গবন্ধুর পূত্রবধু শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকিও ছিলেন ক্রীড়াব্যক্তিত্ব। ১৯৭৩ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা। সে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সুলতানা কামাল খুকি। ওই আসরে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু সুলতানা কামালকে বললেন, ‘বাঙালির মান রাখতে পারবি তো?’ খুকির সাহসী উত্তর ছিল ‘পারবো’। খুকি ওই আসরে লং জাম্প ইভেন্টে দ্বিতীয় হন। এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে প্রথম কোনও পদক জয়। তিনি দেশে ফেরার পর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুকিকে বাহবা দিয়েছিলেন। খুকি তখনও বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হননি। মৃত্যুর কিছু দিন আগে ১৯৭৫ সালেও হার্ডলসে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন খুকি।
একটি পরিবার যেন একটি পুরো দেশের প্রতিচ্ছবি। রাজনীতি, ক্রীড়া, নারীর অংশগ্রহণ সবকিছু ঘর থেকেই প্রতিনিধিত্বশীলতার উদাহরণ হয়ে সামনে আসছে। শেখ কামালের স্ত্রী শুধু একজন ভালো অ্যাথলেটই ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ সংগঠকও। মেয়েরা যেন খেলাধুলায় মন ঢেলে দেয়, সে জন্য রীতিমতো কাউন্সেলিং করতেন। ১৯৬৬ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের লং জাম্পে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জেতেন স্কুলপড়ুয়া খুকি। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে লং জাম্পে নতুন রেকর্ড গড়ে চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৭০ সালে অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে মেয়েদের মধ্যে সেরা হন। ১৯৭৩ সালে ১০০ মিটার হার্ডলসেও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাথলেটিক্সে প্রথম নারী ‘ব্লু’ সুলতানা কামাল খুকি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তান প্রাদেশিক গেমসেও রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্লাবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন প্রণয়ন করেন। তাঁর উদ্যোগেই বাংলাদেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর স্বীকৃতি ও অনুমোদন লাভ করে। আর তাকে অনুসরণ করা তার জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ কামাল নেতা হতে না চেয়েও হয়ে ওঠেন একজন পথিকৃত।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। কিন্তু আবাহনী হারায় সেই রাতে শেখ কামালকে। তার মৃত্যুতে তখনই ক্লাবটির বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তৎকালীন অনেক কর্মকর্তার নেতৃত্বে ও খেলোয়াড়দের ঐকান্তিক চেষ্টায় ক্লাবটি টিকে যায়। শেখ কামালের হাতে তৈরি ক্লাবটি টিকে যায়। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন এই খেলোয়াড়দের মাধ্যমে বিশ্ব চিনুক বাংলাকে। আর টিকে যাওয়ার আরেকটা কারণ, খ্যাতিমান খেলোয়াড় নান্নু, সালাউদ্দীন, চুন্নু, অমলেশ, আশরাফ, টুটুল, আনোয়ার, হেলালসহ আরও অনেকে আদর্শিক কারণে আবাহনীতে খেলেন। আর সেই আদর্শের পথটি তৈরি করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল।
লেখক: সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন
সৌজন্যেঃ বাংলাট্রিবিউন