আমার কমান্ডার!

1620

Published on আগস্ট 4, 2020
  • Details Image

এম. নজরুল ইসলামঃ

দীর্ঘ দেহ, ঋজু। পুরু গোঁফ। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা কাচের চশমা। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। ঠোঁটে প্রশ্রয়ের স্মিত হাসি। এ এক উচ্ছল তরুণের প্রোফাইল। সেই প্রাণময় তরুণকে আজ আর কোথাও দেখি না। শেষ কবে দেখিছি তাঁকে? না, সে হিসেব তো করা নেই। হিসেব রাখারও তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। রোজ যাঁর সঙ্গে দেখা হচ্ছে, যাঁর স্মিত হাসি আর পিঠের ওপর হাত রেখে কাজ করার সাহস যোগাচ্ছেন যিনিÑতাঁর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে, এমন হিসেব কষার তো কোনো প্রয়োজন নেই। কোথায় দেখিনি তাঁকে। সদ্য স্বাধীন দেশে তখন আমরা ডানা মেলে উড়ছি যেন। চারদিকে আনন্দের জোয়ার। সেই জোয়ারে তিনি দক্ষ এক সংগঠকের ভূমিকায়। গানের আসরে তাঁকে পাই। নাটকের মঞ্চে তাঁর সপ্রাণ উপস্থিতি। খেলার মাঠে তিনি তো আছেনই। রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয়েও তিনি উপস্থিত। সকালে দেখছি তাঁকে। বিকেলেও সেই হাসিমুখে টেনে নিচ্ছেন কাছে। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী এই তরুণ যেকোনো মানুষকে অনায়াসে কাছে টানার শক্তি রাখতেন। জানতেন কী করে সংগঠনকে প্রাণবন্ত রাখতে হয়।

বলছি শেখ কামালের কথা। না, শেখ কামালের কথা বলব কেন? বলছি আমাদের কমান্ডারের কথা। হ্যাঁ তাইতো। আমাদের কাছে তো তিনি শেখ কামাল নন। তিনি ছিলেন আমাদের কমান্ডার। এই নামেই তো আমরা চিনতাম, ডাকতাম তাঁকে। খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়। এই তো সেদিনও শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের ঠিক উল্টো দিকে ৩০ মিরপুর রোডে ছিল ছাত্রলীগের অফিস। দোতলা বাড়ির নিচ তলায় মহানগর ছাত্রলীগের, দোতলায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অফিস। সেই অফিসে আমারও তো নিত্য যাতায়াত ছিল। বয়সে কনিষ্ঠ হলেও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি তখন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের প্রতিনিধি হিসেবে আমার ওপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয়। আজো মনে পড়ে, তখন মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন সৈয়দ নূরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শফিকুর রহমান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভিপি ছিলেন আমিনুল ইসলাম জিন্নাহ, জিএস ছিলেন ফজলে এলাহী মোহন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যরকম একটা জোয়ার আনার চেষ্টা করেছিলেন শেখ কামাল। বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির গুণগত মানের পরিবর্তনের চেষ্টা ছিল তাঁর। সরকারের প্রধান নির্বাহী ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির ছেলে হয়েও দলের উঁচু পদের দিকে তাঁর কোনো মোহ ছিল না। সাধারণ কর্মী হিসেবেই কাজ করতেন তিনি। ছিলেন উদ্যমী পুরুষ। সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে খেলার মাঠ সর্বত্র সমান দাপট।

এই প্রাণবন্ত তরুণ প্রতিভাকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। মূল্যায়ন দূরের কথা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় কজনের জানা আছে? অনেকেই হয়তো জানেন না, শেখ কামাল চমৎকার সেতার বাজাতেন। ছায়ানটের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশের সঙ্গীত জগতে পপ সঙ্গীতের যে উত্থান, তার নেপথ্যেও শেখ কামালের অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে সেই সময়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন’ শিল্পী গোষ্ঠী যে দলটি দেশের সঙ্গীত জগতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিল সেই সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে। দেশের নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ কামাল ছিলেন প্রথম সারির সংগঠক। ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও। অভিনেতা হিসেবেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় উৎসাহী শেখ কামাল স্বাধীনতার পর আবির্ভূত হন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠন ও আধুনিক ফুটবলের অগ্রদূত আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা। রাজনীতিতে তাঁর অবদান কম নয়। ছাত্রলীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী তিনি। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন এবং শাহাদাত বরণের সময় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কমিশন লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণের সময় তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।  

জন্মেছিলেন আজকের বঙ্গতীর্থ টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৯ সালের এই দিনে। মাত্র ২৬ বছরের জীবন। ঘাতকের বুলেটে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিহত হন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তাঁর মৃত্যু দেশের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে তো বটেই, রাজনীতিতেও এক অসামান্য ক্ষতি। আজ জš§দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই প্রাণময় তরুণকে, যাঁর প্রেরণা একদিন আমাদের উজ্জীবীত করেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে। তিনিও তো আমাদের দীক্ষা দিয়েছিলেন দেশপ্রেমের মন্ত্রে। প্রাণময় তরুণকে আজ কোথাও দেখি না। প্রবাস থেকে যখনই দেশে যাই, খুঁজি তাঁকে মানুষের ভীড়ে। মিরপুর রোডের চেহারা পাল্টে গেছে। ধানমন্ডি লেকও আজ অনেক আধুনিক। সেই আবাহনী মাঠ আছে, নেই সেই প্রাণপুরুষ। খুঁজি তাঁকে হাসিমুখ হাজার মানুষের ভিড়ে। আমাদের সেই চিরচেনা কমান্ডার একবার যদি চমকে দিয়ে হাসিমুখে পিঠে হাত রাখতেন!

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত