4761
Published on জুন 23, 2020রায়হান কবিরঃ
বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় অবস্থিত ও তেরোশত নদী-জল পরিবেষ্টিত বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এদেশের একটি পরিচিত দৃশ্যপট। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, পাহাড় ধস ও নদী ভাঙনের বিরূপ প্রভাব এদেশের মানুষের নিত্যসহচর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে পৃথিবীর অন্যতম উর্বর ভূমির এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বারবার চরম দুর্ভিক্ষ, দুর্দশা, খাদ্যাভাব, নানা রোগ-ব্যাধি ও মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতির করালগ্রাসে নিপতিত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাতে শস্য-শ্যামলা উর্বর ভূমির এই ভূখ-কে অভাব ও দুর্ভিক্ষগ্রস্ত করতে না পারে সে-জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সভায় গৃহীত সংগঠনটির খসড়া ম্যানিফেস্টোতে ‘জমির পুনর্ব্যবহার পরিকল্পনা’র দাবি উত্থাপন করা হয়। মেনিফোস্টেতে বলা হয়, “বন্যা মড়ক জাতীয় দুর্দ্দৈব রোধ করিবার ব্যাপক ও স্থায়ী পরিকল্পনা অতি সত্বর কার্য্যকরী করিতে হইবে। তৎসহ সেচ-ব্যবস্থার সুবিধা ও সার প্রস্তুত ও ব্যবহারের বন্দোবস্ত করিতে হইবে। উন্নত ধরনের বীজ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহের বন্দোবস্ত করিতে হইবে।”
আওয়ামী লীগ যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন একদিকে মুসলিম লীগের দুঃশাসন ও অব্যবস্থাপনা অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশভাগের মারাত্মক প্রভাব এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দেশব্যাপী চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সে-সময় আওয়ামী লীগ সাধ্যমতো মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। তখন চরম খাদ্যাভাবে সহায়তার হাত না বাড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি অবহেলা প্রদর্র্শন করে মুসলিম লীগ সরকার। যার প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর খাদ্য মিছিল করে আওয়ামী লীগ। খাদ্য মিছিলের ওপর হামলা করে সরকার এবং এ ঘটনায় মামলা দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান-সহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করে রাখে সরকার।
সাম্প্রদায়িক অপশক্তির চক্রান্তে ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। অসংখ্য মানুষ নিহত এবং বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। সে-সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ছিলেন জেলে বন্দী। তারপরও দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা আর বৈষম্যমূলক আচরণে পূর্ব বাংলার খাদ্য সংকট আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকে। প্রতিদিনই খাদ্যের অভাবে মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। ছিন্নমূল মানুষ এবং ভিক্ষুকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের আগস্টে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় মানুষ। ফলে খাদ্যাভাব আরও চরম আকার ধারণ করে। আওয়ামী লীগ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে যথাসম্ভব মানুষকে সহায়তা করে এবং সরকারের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার বিরুদ্ধে খাদ্য আন্দোলন গড়ে তোলে।
১৯৫৩ সালের ৩, ৪ ও ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পঠিত সাংগঠনিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, “রংপুর, মোমেনশাহী, খুলনা, বরিশাল ও অন্যান্য জায়গায় খাদ্য আন্দোলনও গড়িয়া তুলিতেছে ভুখ-মিছিল ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির মধ্য দিয়া। মরার পূর্বে বাঁচিবার জন্য মানুষের এই সংগ্রামকে শুধু আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ করিয়াই ক্ষান্ত হইতে পারে না, উহাকে মানুষের বাঁচিবার রূপান্তরিত করাও আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্তব্য।” কাউন্সিল অধিবেশন থেকে সারাদেশ থেকে আগত নেতা-কর্মীদের চরম খাদ্য সংকটে সাধারণ মানুষের পাশে থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ১৯৫৩ সালের ১৪ ও ১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে খাদ্য সংকট নিয়ে আলোচনা হয় এবং নেতা-কর্মীদের মানুষের পাশে থেকে দেশরক্ষায় নিয়োজিত থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগের জন্য ‘আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
১৯৫৪ সালে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিরলস সহযোগিতা করে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। ১৯৫৫ সালের বন্যায় খাদ্যাভাব নতুন সংকট সৃষ্টি করে। এ সময় দুর্গতের পাশে থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।
১৯৫৬ সালের মে মাসে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারের অবহেলার বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী অনশন পালন করেন। দুর্গত মানুষের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দেশের বিভিন্ন এলাকা সফর করেন।
১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, “খাদ্য সমস্যাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হইবে।” খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কর্মীদের গ্রামে গ্রামে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেন। কাউন্সিল অধিবেশনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৫৬ সালের জুন মাসে দুর্গত মানুষকে সহযোগিতা করতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান খুলনা, বরিশাল, যশোর, ফরিদপুর ও বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকায় সফর করেন। একই সময় আতাউর রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ রংপুর, রাজশাহী, সিলেট-সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা সফর করেন এবং দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান। ১৩ জুন খুলনা মিউনিসিপ্যাল পার্কে অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “আমরা জনসাধারণকে ১৯৪৩ সালের ন্যায় অনাহারে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হইতে দিব না।” এ সময় ৩০ জুন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৮ জুলাই ‘খাদ্য দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে।
১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান রাজশাহী সফর করেন। ১০ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে খাদ্য পরিস্থিতির একটি চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি গত এক সপ্তাহব্যাপী রাজশাহী সদর মহকুমার গোদাগাড়ী, তানোর ও মোহনপুর প্রভৃতি এলাকায় ঘুরিয়া খাদ্যাভাবে মানুষের যে অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, তাহা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। মাসাধিককাল হইতে মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিনযাপন করিতেছে। চাউলের মূল্য ক্রয়-ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।… কিছুদিন পূর্বে কৃষিলোন হিসাবে কিছু টাকা দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু বিবরণ নীতির ত্রুটির জন্য উহাও সকলের ভাগ্যে জোটে নাই। ইহা ছাড়া প্রায়ই অনাহারে আত্মহত্যার খবরও পাওয়া যাইতেছে। অবিলম্বে এই জেলার প্রতি গ্রামে সংশোধিত রেশনিং প্রথা প্রবর্তন করা হউক।”
শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলা সফরে আসেন। ২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগের আহ্বানে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। সরকারের অব্যবস্থাপনার ফলে ১৯৫৬ সালের জুলাই-আগস্ট মাস থেকেই খাদ্য সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বহু গুণ বৃদ্ধি পায় চালের মূল্য। বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় খাদ্য-মিছিল আসতে থাকে। ঢাকার জিঞ্জিরা থেকে আগত এক ভুখ-মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। অবস্থা যখন একেবারেই আয়ত্তের বাইরে চলে যায় এবং গণবিদ্রোহ প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, ঠিক সে-সময় ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে প্রদেশে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
পূর্ব বাংলায় প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬, যখন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয় তখন চরম খাদ্যাভাব ছিল। পূর্ববর্তী সরকারের ব্যর্থতার ফলে সরকারি গুদামে খাদ্য নেই, জাহাজ প্রাপ্তির অসুবিধায় বিদেশ থেকে শস্য আনাও সহজসাধ্য নয়। অন্যদিকে দেশের লাখ লাখ মানুষ খাদ্যের অভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কার সম্মুখীন। মারাত্মক সেই খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা ছিল আওয়ামী লীগের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। তারপরও সেই দুর্ভিক্ষাবস্থা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রায় ২ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২০ লাখ ১০ হাজার ৭৯ মণ, অক্টোবর মাসে ২৮ লাখ ৬১ হাজার ৫৩৯ মণ এবং নভেম্বর মাসে ১৯ লাখ ৮২ হাজার ২৯০ মণ খাদ্যশস্য প্রেরণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬ লাখ মণ চাল বিনামূল্যে এবং ৬ লাখ মণ চাল স্বল্পমূল্যে বিতরণ করা হয়। এ সময় টেস্ট রিলিফের জন্য প্রায় ২ কোটি টাকা ও কৃষি ঋণ বাবদ আরও প্রায় ১ কোটি টাকা বিলি করে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
এছাড়াও দেশে হাজার হাজার লঙ্গরখানা ও রিলিফ ক্যাম্প খুলে অভুক্ত মানুষের সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ এবং কোটি কোটি নিরন্ন মানুষকে অনাহার থেকে রক্ষা করে আওয়ামী লীগ। এক একটি লঙ্গরখানায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১ হাজার অভুক্ত মানুষকে খাওয়ানো হতো। সরকার প্রত্যেকটি লঙ্গরখানায় বিনামূল্যে ২ মণ হতে চাহিদা অনুযায়ী চাল সরবরাহ করত। এর বাইরেও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী স্থানীয় স্বেচ্ছাপ্রদত্ত চাঁদায় খাদ্য সরবরাহ করত। সে-সময়ে প্রায় ২০ মাসের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়া আওয়ামী লীগ সরকার বিদেশ থেকে প্রায় ৮০ কোটি টাকার চাল আমদানি করে দেশবাসীকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা এবং দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যাওয়া সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশঙ্কাকে জয় করে। আওয়ামী লীগ সরকার তখন বার্মা (মিয়ানমার), থাইল্যান্ড, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি করে।
প্রদেশের আর্থ-সামাজিক সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়িত হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্রুগ মিশন গঠন এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উচ্চফলনশীল ধান উদ্ভাবন, পাওয়ার পাম্পে সেচ ব্যবস্থা চালুসহ এ সময় একটি স্থায়ী আমদানি-রপ্তানি কন্ট্রোলারের অফিস স্থাপিত হয়। কৃষি ও সমবায়সহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে দেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করে সরকার।
পাকিস্তানি শাসনামলে ত্রাণ তৎপরতা
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর শাসনতন্ত্র নাকচ করে সামরিক শাসন শুরু হয়। অক্টোবর মাসের শেষ দিকে নোয়াখালী ও পটুয়াখালী এলাকায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, ১৯৬০ সালে সুন্দরবন এলাকায় প্রবাহিত এক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী অঞ্চলে আঘাতহানা আরেকটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৬১ সালে প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসে বহু সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারায় ও মানুষের জীবনমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১৯৬২ সালে দুটি বন্যায় দেশের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয় এবং মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে থেকে ত্রাণ তৎপরতা চালায় আওয়ামী লীগ। স্বৈরশাসন, জেল-জুলুম, মামলা-হামলা মাথায় নিয়েই দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে জনগণের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখে আওয়ামী লীগ।
১৯৬৪ সালে আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের চক্রান্তে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হয় এবং বহু মানুষ হতাহতের শিকার হয়। ১১ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং কমিউনিস্ট পার্টির আলী আকসাদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানরা উগ্রসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সংবাদ ও ইত্তেফাক এ দুটি দৈনিকে ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ একই শিরোনামে সম্পাদকীয় লেখা হয়।
১৯৬৬ সালে বন্যা প্লাবিত হয় ঢাকা অঞ্চল, ১৯৬৮ সালে সিলেটে ও ১৯৬৯ সালে বন্যা প্লাবিত হয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এরই মধ্যে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা পেশ করেন এবং বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলেন।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়োত্তর ও মুক্তিযুদ্ধকালে ত্রাণ তৎপরতা
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় মানুষ। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করে বাংলার দুর্যোগকবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ২৬ নভেম্বর বেতার ভাষণ দেন তিনি। ভাষণে ছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি তার নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তুলে আনা দুর্যোগাক্রান্ত জনগণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন। এ সময় নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা জেলা সফর করেন বঙ্গবন্ধু। এছাড়াও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে যে ভাষণ দেন, সেখানেও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ লোক নিহত ও ৩০ লাখ বেঁচে যাওয়া মানুষের জীবন-সংগ্রামে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবকে তিনি নিজেদের জন্য পাহাড়সম কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণের পরদিনই দ্বিতীয়বারের মতো উপকূলীয় অঞ্চলে ছুটে যান এবং দুর্গত মানুষের সঙ্গে ত্রাণ তৎপরতায় নেতৃত্ব দেন। নৌকায় চড়ে ও পায়ে হেঁটে দুর্গম এলাকার প্রান্ত থেকে প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়ে তিনি জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
’৭০-এর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলার দুর্দশাপীড়িত মানুষের মাঝে ত্রাণ তৎপরতার জন্য তিনি ঢাকা থেকে কলকাতার বড় বড় নেতার কাছে গেছেন একটি কনফারেন্সের আয়োজনের মাধ্যমে অনাহারী জনগণের মুখে হাসি ফোটাতে আর তাদের উজ্জীবিত করতে। সে-সময় প্রচ- পরিশ্রমে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তথাপি জনগণের পাশে থাকার সংকল্পে ছিলেন অবিচল। [সূত্র : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, ড. মাহবুবা নাসরিন, দৈনিক সমকাল, ১০ মার্চ ২০২০]
১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রশাসন হাতে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রশাসনের প্রতি যে ৩৫-দফা আদেশ ও বিধি জারি করেন, সেখানেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর সংরক্ষণের কাজ, উন্নয়ন ও নির্মাণকাজ, ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় বাঁধ নির্মাণসহ সব উন্নয়নমূলক কাজ, সাহায্য-সহযোগিতা, পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ও বন্যাকবলিত হয় দেশ। একদিকে যুদ্ধ পরিচালনা অন্যদিকে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া কোটি কোটি মানুষের আহার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ছিল তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। তারপরও শরণার্থীদের ত্রাণ তৎপরতায়ও মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত তৎপরতার পরিচয় দেয়।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ৩ কোটি ছিন্নমূল মানুষ, দেড় কোটি অগ্নিদগ্ধ ঘরবাড়ি, ১ কোটি শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন সমস্যা, শূন্য খাদ্য গুদাম, অনাবাদি জমি, বিপর্যস্ত জনজীবন এমন চরম ও সংকটাকুল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার যে সফলতা দেখিয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তখন বিভিন্ন দেশ ও সাহায্য সংস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা জরিপ করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্যাভাবে ২ কোটি লোক মৃত্যুবরণ করবে। বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ৪ কোটি ৭৫ লাখ মণ খাদ্যসামগ্রী বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে বিতরণ করে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু ঠেকাতে সমর্থ হয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধুর সময়োচিত পদক্ষেপে এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলা বিশ্ববাসীকে অভিভূত করেছিল।
১৯৭২ থেকে ৭৫ মাত্র তিন বছর সময়কালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যাপক কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)’ পরিকল্পনা করেন এবং সিপিপি’কে সরকারি তহবিল সরবরাহ করেন। ১৯৭৩ সালে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন তিনি। সিপিপি ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্ক সংকেত প্রচারের মাধ্যমে মানুষের জানমাল রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করায় বাংলার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে আগাম তথ্য পেতে শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু সরকার সিপিপি’কে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সরকারের যৌথ কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে। যা বাংলাদেশের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে একটি অনন্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। আজকের বাংলাদেশে এই কর্মসূচির মাধ্যমে লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবক সেবা দিয়ে যাচ্ছে দুর্গত এলাকার জনগণকে। এ সময় ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বাস্তবায়নের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ ও তার সম্পদ রক্ষায় উঁচু ঢিবি তথা শক্তিশালী মাটির কেল্লা নির্মাণের নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। স্থানীয় জনগণ ভালোবেসে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেই আশ্রয়স্থলের নাম দেন ‘মুজিব কিল্লা’। বঙ্গবন্ধু সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নেও বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করে। দেশে ৩৭ হাজার পাওয়ার পাম্প, ১৪ হাজার গভীর ও অগভীর-টিউবওয়েল সরবরাহ করে সেচ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা হয়। যার ফলে এক ফসলি জমি দুই ফসলি এবং অনাবাদি জমিও ফসলি জমিতে পরিণত হয়।
জাতির পিতার নেতৃত্বে ১৯৭২-৭৫ সময়কালে সরকারের পাশাপাশি সংগঠন আওয়ামী লীগও দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাপক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে। সে-সময় সংগঠনের লাখ লাখ নেতাকর্মী ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ৫০ হাজার সদস্য সারাদেশে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৪ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে পঠিত সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, সে-সময় ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১২ লাখ ৭৮ টাকা সাহায্য প্রদান করা হয়।
আওয়ামী লীগ বিরোধিরা অনেকেই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা হিসেবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালায়। প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ ২৪ বছরে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত জনজীবন এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরম অবহেলা, অপশাসনে বিদ্যমান চরম খাদ্যাভাব, একাত্তরে পাকিস্তানের পোড়ামাটি নীতি, শূন্য খাদ্য গুদাম ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭৪-এর আকস্মিক বন্যায় ব্যাপক শস্যহানির কারণে খাদ্য সংকট ছিল একটি অনিবার্য সমস্যা। কিন্তু এই খাদ্য সংকটকে পুঁজি করে মার্কিন খাদ্য কূটনীতি এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি করে। ফলে বাংলাদেশের জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যেই এ সমস্যার সমাধান করা ছিল প্রায় অসম্ভব।
তারপরও মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর সরকার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শূন্য হাতে একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে সফলতা অর্জন করে তা বিস্ময়কর ব্যাপার। ফলে আওয়ামী লীগ আমলের প্রবৃদ্ধির হার ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি ৭.০৬ শতাংশ। ১৯৭৫ সালে খাদ্য গ্রহণের গড়পড়তা পরিমাণ ছিল ৮০৭ গ্রাম, যা ১৯৮১ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৭৬৪ গ্রাম এবং ১৯৯১ সালে তা আরও কমে গিয়ে গড়পড়তা ৬৯২ গ্রামে দাঁড়ায়। ভোগের হিসাবে ১৯৭৫ সালে ক্যালরি গ্রহণের গড়পড়তা পরিমাণ ছিল ২০৯৪, যা ১৯৮১ সালে ১৯৪৩ এবং ১৯৯১ সালে হ্রাসকৃত পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪০ ক্যালরিতে।
১৯৭৫-পরবর্তী সময়কাল (১৯৭৫-৯৬)
১৯৭৫ সালের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা হত্যা এবং খুনি চক্রের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত অত্যাচার-নির্যাতনে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখিন হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে দলীয় সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। শুরু হয় স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন। দলের দুঃসময়েও ১৯৮৭ সালে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা চালায় আওয়ামী লীগ। ১৯৮৭ সালে সমগ্র উত্তরবঙ্গে প্রবল শীতের প্রকোপে মানুষ যখন দিশেহারা তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সহযোগিতায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। জিয়া-এরশাদ স্বৈরশাসনামলে বাতিল করা জমির খাজনা পুনঃপ্রবর্তন, কীটনাশক ঔষধ, সার, বীজ ও পাওয়ার পাম্পের ভর্তুকি প্রত্যাহার করায় কৃষকের সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের দাবিতে ১৯৮৭ সালের ১২ এপ্রিল দেশব্যাপী ‘কৃষক দিবস’ পালন করে আওয়ামী লীগ।
১৯৮৮ সালে রাজধানী ঢাকা, সমগ্র উত্তরবঙ্গসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয় এবং বন্যাকবলিত এলাকায় জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে ত্রাণসামগ্রীসহ উপদ্রুত এলাকায় ছুটে যান এবং সরকারের ত্রাণ তৎপরতায় অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বহু মানুষ নিহত হয় এবং লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা উপদ্রুত এলাকায় ছুটে যান এবং ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে ভয়াবহ একটি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হন এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালীসহ দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা ও দ্বীপসমূহে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়। তৎকালীন বিএনপি সরকার দুর্যোগ মোকাবিলা এবং উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। চরম খাদ্যের অভাবে গৃহহীন মানুষের আহাজারিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে উপকূলীয় এলাকা। উদ্ধার তৎপরতা এতটাই নাজুক ছিল যে, যেখানে-সেখানে বেওয়ারিশ লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। অথচ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সংসদে বলেছিলেন, “যত মানুষ মরার কথা ছিল তত মানুষ মরেনি।”
এ সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা দুর্গত এলাকায় ছুটে যান। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করেন। ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগ গৃহীত নয়া অর্থনৈতিক নীতিমালায় ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদের ব্যবহার’ শীর্ষক নীতি গ্রহণ করা হয়।
১৯৯৬-২০০১ শেখ হাসিনা সরকারের আমলে
বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এ সময়কালে ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৮ সালের শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী বন্যা এবং ২০০০ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১১টি জেলায় আকস্মিক বন্যা মোকাবিলায় সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য দেশবাসী ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিপুল প্রশংসা অর্জন করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলেই দেশ সর্বপ্রথম খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ আমলেই প্রথম বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, প্রতি বছর ফসল ওঠার আগে এবং প্রতি ঈদ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের সময় লাখ লাখ দরিদ্র পরিবারকে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে খাদ্য সাহায্য দেওয়া হয়।
১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগও সাংঠনিকভাবে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা শুরু করে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কবলিত কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চট্টগ্রাম, সীতাকুণ্ড, মীরশ্বরাই, সন্দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, পটুয়াখালী, দশমিনা, ভোলা, লালমোহন, চরফ্যাশন, রামগতি, হাতিয়া, নোয়াখালী, ফেনী, কোম্পানীগঞ্জ এলাকার জন্য গঠিত ৮টি ত্রাণ টিম ও চিকিৎসক দল ম্যাসব্যাপী ত্রাণকার্য ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করে।
১৯৯৮ সালে দেশের ৫৩টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিধ্বংসী বন্যায় ২ কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে বলে বিরোধী দল যে প্রচার করেছিল, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। একজন মানুষও খাদ্যের অভাবে মারা যায়নি। সরকার সাফল্যের সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। ১০ লাখ মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে দু-মাসের বেশি সময় ধরে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৮ সালের জুলাই মাস থেকে ৯ মাসব্যাপী ৪২ লাখ ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে ২ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য সাহায্য দেওয়া হয়। ১৯৯৯ এবং ২০০০ সালেও লাখ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে খাদ্য সাহায্য দেওয়া হয়। ১৯৯৮-৯৯ এবং ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে সরকার বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশেষ বন্যা পুনর্বাসন কর্মসূচি রূপায়ণ করে। সরকারের পাশাপাশি সংগঠন আওয়ামী লীগও দেশব্যাপী ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালায়। একইভাবে ২০০০ সালে আকস্মিক বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল প্লাবিত হলে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালায়। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যাদুর্গত এলাকায় যান এবং ত্রাণ বিতরণ করেন। ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগের ৪টি মেডিকেল টিম বন্যাদুর্গত এলাকার সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে সপ্তাহব্যাপী বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে।
২০০১-০৯ সময়ে চরম প্রতিকূল পরিবেশে আওয়ামী লীগের ত্রাণ তৎপরতা
২০০১-পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে জর্জরিত ও শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আওয়ামী লীগের ত্রাণ তৎপরতা ও মানববিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি উত্তরবঙ্গের শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করে আওয়ামী লীগের ৪টি কেন্দ্রীয় টিম। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকার বন্যাকবলিতদের মাঝেও ত্রাণ বিতরণ করে আওয়ামী লীগ। ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ মঙ্গা দেখা দিলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মঙ্গাকবলিত মানুষের কাছে ছুটে যান এবং ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালান। ৩ নভেম্বর রংপুর ও দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ত্রাণ বিতরণের জন্য আওয়ামী লীগের ত্রাণ টিম উত্তরবঙ্গ সফর করে।
২০০৪ সালের ১৭ এপ্রিল নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহের টর্নেডো উপদ্রুত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন বিরোধীদলীয় নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ৪ জুন পুরনো ঢাকার শাঁখারীবাজারে আকস্মিকভাবে ধসেপড়া ছয়তলা ভবনের নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের কাছে ছুটে যান বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হলে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে আওয়ামী লীগ। ২০০৪ সালের উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ এবং ৪ নভেম্বর রংপুর জেলা, ৫ নভেম্বর নীলফামারী জেলা, ৬ নভেম্বর লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলা এবং ৭ নভেম্বর গাইবান্ধায় মঙ্গাপীড়িত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে।
২০০৫ সালের মার্চে দেশের উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ টর্নেডোতে অসংখ্য মানুষ নিহত এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে আওয়ামী লীগের ত্রাণ টিম দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের একটি টিম আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করে। ২০০৫ সালের অক্টোবরে বন্যাকবলিত উত্তরবঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগের ত্রাণ টিম উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করে।
ঘূর্ণিঝড় সিডর বিধ্বস্ত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর। সরকারি হিসাবে সিডরে ৬ হাজার মানুষ মারা যায়। সিডরে দুর্গত মানুষের পাশে ছুটে যায় আওয়ামী লীগ। এ সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ত্রাণ তহবিল গঠন করা হয় এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমন্বয়ে গঠিত কয়েকটি ত্রাণ টিম দুর্গত এলাকায় গমন করে। কেন্দ্রীয় ত্রাণ টিমের পক্ষ থেকে বরগুনা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, যশোর অঞ্চলে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালানো হয়। একই সাথে আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিভাগের উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়।
২০০৯-২০ রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সরকারের সময়কাল
২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করার কিছুদিন পরই ২০০৯ সালের মে মাসে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার আঘাতে হাজার হাজার একর জমির ফসল ও মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ায় এই দুর্যোগ থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়। আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ত্রাণ হিসেবে ২৭ হাজার ৯৫১ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য, ১৩ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা নগদ অর্থ সাহায্য, ২০ কোটি ২ লাখ ৯২ হাজার টাকা গৃহনির্মাণ বাবদ এবং বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ১১৬ কোটি টাকা মঞ্জুরী দেওয়া হয়।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য নিজস্ব তহবিল ঘোষণা করেন। উপকূলীয় বাঁধ সংরক্ষণ, মজবুতকরণ ও সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গ্রহণ করা হয়েছে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা-২০০৯। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে। একইসাথে পরিবেশের ভারসাম্য ও বনাঞ্চল রক্ষা, পানি সম্পদের উন্নয়ন, নৌপথের নাব্য রক্ষা এবং সেচ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয় বহুমুখী পদক্ষেপ। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মধুমতি, গড়াই, যমুনা, বুড়িগঙ্গা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীর দীর্ঘ নৌপথসমূহের নাব্য পুনরুদ্ধার করা হয়। মধুমতি ও গড়াই নদী খননের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় লবণাক্ততা হ্রাস, সুন্দরবন এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব হচ্ছে।
২০০৯ থেকে ২০১৯ সময়কালে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যে দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি-১৯৯৭ প্রণয়ন করা হয়েছিল, ২০১০ সালে তা হালনাগাদ করা হয়। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল গঠন করা হয়। ২০১২ সালে সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর গঠন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা মানুষের দুর্দশার বিষয়গুলো আমলে নিয়ে ২০১৫ সালে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ সরকার এবং জাতীয় রিজিলিয়েন্স পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যা সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ও এসডিজি’র সাথে সংগতিপূর্ণ। ২০১৫ সালে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনইওসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য পূর্বাচলে একটি স্টেজিং এরিয়া নির্মাণ করা হচ্ছে। মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে সিভিল মিলিটারি সমন্বয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিজিওনাল কন্সালটেটিভ গ্রুপের (আরসিজি) মাধ্যমে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ১ মার্চ আইএফআরসি’র মহাসচিব আলহাজ আস সাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অসামান্য সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে আইএফআরসি’র বিশেষ সম্মাননা সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট তুলে দেন।
ইতোমধ্যে ভূমিকম্পে উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজে ব্যবহারের জন্য ৩ হাজার ৩৫টি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। ২০১৯ সালের মধ্যে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার অভিযানের জন্য ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরিসহ সারাদেশে ৩২ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জলোচ্ছ্বাস বা বন্যায় জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য ১৮ হাজার ২৫৪টি ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ১৩ হাজার ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণাধীন রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প শুরু করেন, যা ‘মুজিব কিল্লা’ নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশে ‘মুজিব কিল্লা’ নির্মাণ প্রকল্পসহ উপকূলীয় জনগণের জন্য পরিকল্পিত আশ্রয়স্থল নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ৫৫০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়নের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে সারাদেশে ৪ হাজার ৩৪৩টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং ৬৪৩টির নির্মাণকাজ চলমান। পাশাপাশি বন্যাদুর্গত এলাকায় ২৩০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪৬৮টি এবং গ্রামীণ রাস্তায় ৫ হাজার ৬৪৬টি ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ৬৬টি জেলা ত্রাণ গুদাম ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্যকেন্দ্র নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। গৃহহীনদের জন্য ‘দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ’ কার্যক্রম চলমান। দেশের ১৩টি উপকূলীয় জেলায় স্যাটেলাইট টেলিফোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্যোগের আগাম সতর্কতা ও দৈনন্দিন আবহাওয়া বার্তা জানতে মোবাইলে ১০৯০ নম্বরে টোল ফ্রি কল সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এছাড়াও দেশে কমিউনিটি রেডিও সার্ভিস চালু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। ১৮টি কমিউনিটি রেডিও সার্ভিস চালু হয়েছে এবং সম্প্রচারিত হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের লক্ষ্যে ৩৩০টি নতুন ফায়ার সার্ভিস চালু করা হয়েছে। বজ্রপাত প্রশমনের লক্ষ্যে দেশে ৩১ লক্ষাধিক তালগাছ বীজ বপন করা হয়েছে। জাতীয় বিল্ডিং কোডে বজ্রপাত নিরোধক দ- স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় ১২টি ইর্মাজেন্সি পিকআপ ভ্যান, ৬টি মোবাইল অ্যাম্বুলেন্স বোট, ৪টি সী সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ বোট, ১২টি স্মল মেরিন রেসকিউ বোট ও ৩০টি ট্রাক মাউন্টেড স্যালাইন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। দুর্যোগকে অন্তর্ভুক্ত করে শতবর্ষমেয়াদি ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ গ্রহণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি অনেকাংশে কমে এসেছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় দুর্যোগে-দুর্বিপাকে কোনো মানুষ অনাহারে মারা যায় না। উত্তরবঙ্গ থেকে মঙ্গা দূরীভূত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার কর্মকৌশলের ফলে এক সময়ের বন্যা, খরা, মঙ্গা, দুর্ভিক্ষকবলিত বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দেড় কোটি মানুষ মধ্যবিত্তের স্তরে উঠে এসেছে।
বর্তমানে মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বৈশ্বিক মহামারি প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর ১৯টি প্যাকেজে জননেত্রী শেখ হাসিনা ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। সারাদেশে মোট ৩৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে এই রোগ পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসা প্রদানের আওতায় আনা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ২ হাজার ডাক্তার ও ৫ হাজার ৫৪ জন নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়। সংক্রমণ রোধে দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস সাধারণ ছুটি রাখা হয়েছে। কর্মহীন খেটে খাওয়া মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এমন কী পবিত্র ঈদ উপলক্ষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৫০ লাখ মানুষের কাছে নগদ অর্থ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যে কোনো জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ পরিবারকে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি ১০ কোটি টাকা নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দেওয়া, মৃত্যের দাফন সম্পন্ন করা, ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম ও টেলিমেডিসিন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং বিভিন্ন এলাকায় ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করা হয়েছে।
লেখক : গবেষণাকর্মী
সৌজন্যেঃ উত্তরণ