কোভিড-১৯-এর বাস্তবতায় ৬৬-র ছয় দফা

1813

Published on জুন 8, 2020
  • Details Image

মামুন আল মাহতাবঃ

উইকিপিডিয়া বলছে ৬৬’র ছয় দফা ছিল বাঙালির ‘ম্যাগনা কার্টা’ – মুক্তির সনদ। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব রেখে দু’টি প্রায়-স্বাধীন অঞ্চলের সমন্বয়ে পাকিস্তান পুনর্গঠনের প্রস্তাব ছিল ছয় দফায়। দু’টি অঞ্চলের মধ্যে অবাধে বিনিময়যোগ্য কিন্তু পৃথক মুদ্রার প্রচলন, আলাদা সেনাবাহিনী গঠন, বৈদেশিক বাণিজ্যের স্বাধীনতা, রাজস্ব আদায় আর শুল্ক ধার্যের মত ক্ষমতাগুলো পুনর্গঠিত পাকিস্তানের দু’টি অঞ্চলের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু তার ছয় দফায়। আধুনিকতা আর উন্নয়নের দাবিদার আজকের বৃটিশরাই যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কনসেপ্ট গিলতে না পেরে ব্রেক্সিট নামক বিবমিশাকে আপন করছে, তখন সেই আমলে আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে উকিঝুকি মারতে থাকা পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর অমন স্পেস-এজ ধ্যান-ধারণাকে গ্রহণ করবে এমনটা কখনোই প্রত্যাশিত ছিল না। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। কিন্তু যা অপ্রত্যাশিত তা ছিল ছয় দফাকে আপন করে নেয়ায় বাঙালির দূরদর্শীতা। ছয় দফা বাঙালিকে এতটাই ছুয়ে গিয়েছিল যে সত্তরের নির্বাচনে সব ব্যালট নৌকার বাক্সে ঢেলে দিতে তাদের এতটুকুও কার্পণ্য ছিল না। একাত্তরের নয়টি মাসে এত রক্ত-আগুন আর অত্যাচারেও ছয় দফার প্রতি বাঙালির আসক্তিতে এতটুকুও ছয়-নয় হয়নি।

‘আম্পান ঐ এলো বলে’ এই এক খবরেই যখন চব্বিশ লাখ মানুষ কয়েক ঘন্টার নোটিসে আশ্রয়কেন্দ্রে যেয়ে উপস্থিত হয় আর আম্পান চলে গেলে আবার দলে-দলে কোমর পানিতে ভাঙ্গা বাধ মেরামতে কোমর বাধে, সঙ্গত কারণেই তখন তা আর অবাক করে না। কোভিডের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে মানুষের সংশয় ছিল একটাই, সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকবে কিনা? মাত্র তিন দিনের নোটিসে সাড়ে চার হাজারের কিছু বেশি আশ্রয়কেন্দ্রের সাথে আরো প্রায় সাড়ে দশ হাজার অতিরিক্ত আশ্রয়কেন্দ্র যোগ করে সরকার মানুষের সেই সংশয়টুকুও দূর করেছে। এমনকি আইসোলেশন আর কোয়ারেনটাইনে থাকা মানুষগুলোর জন্যও আলাদা আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল। তাও কি, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে হাত ধোয়ার জন্য ছিল এমনকি পানি আর সাবানের ব্যবস্থাও। কোথাও কোনো খুন-ধর্ষণ কিংবা রাহাজানির কথা শোনা যায়নি। পাশ্চাত্যের নামজাদা দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখায় এমনি সব বর্ণনা পড়তে গিয়ে একটুও অবাক হইনি। ৬৬-তে যে জাতি ছয় দফার মর্ম বুঝেছে তাদের কাছে তো এমনটাই প্রত্যাশিত। এমনটাই তো প্রত্যাশিত সেই নেতার হাতে গড়া দলের সরকারের কাছ থেকে যিনি সেই কবে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করতে পেরেছিলেন।

বরং অবাক হই ছুটির দিনে সাতসকালে অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন স্যারের ফোন পেয়ে। একটাই প্রশ্ন তার, কেন আমাদের এই অস্থিরতা? দুর্গা পূজার মন্ডপেও হাসপাতাল না হয়ে কখনো যান না যিনি, বলছিলেন সেই তিনিই এই প্রথম কোনো স্বাস্থ্য সংকটে হাসপাতালে না গিয়ে নিজেকে ঘরে আটকে রেখেছেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি তার প্রিয় বন্ধু অধ্যাপক কিবরিয়া স্যারের। ঘরে থেকেও কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন এবং হয়েছেন পরাজিতও। বদ্ধঘরে না থেকে জগতটাকে এই দফায় দেখেই নেয়ার অস্থিরতায় ভুগছি আমরা অনেকে। মাস্কটাকে থুতনির নিচে ঝুলিয়ে কারণে-অকারণে ছুটছি দিগবিদিক আমরা অনেকেই। আর আরেক দল ঘরে বসে ভয়ে সিধিয়ে দোষী খোঁজায় ব্যস্ত। আমাদের চালান দেয়া বাটি কখনো বলছে দোষ সরকারের। কেন সরকার লকডাউন না বলে বলল ছুটি? কেন দিল না কারফিউ? কখনো আবার সব দোষ শিল্পমালিকদের। তারাই তো কারখানা খুলে সবকিছু উল্টেপাল্টে দিলেন। কখনো কখনো দোষ দিচ্ছি মিডিয়াকেও। কখনো র‌্যামডেজিভির আর কখনো অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের গল্প শুনিয়ে মানুষকে তারা অহেতুক আশাবাদী আর কখনো শপিংমল তো কখনো পাটুরিয়ামুখী করে তুলছেন।

আমার মাথায় অতশত ঢোকে কম। মোটাদাগে আমি বুঝি সরকারের যা করার করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি। আগেভাগে ছুটি দেয়া থেকে শুরু করে লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা কোনটি করেনি সরকার। দায়িত্ব পালনেও কারো বড় কোনো ত্রুটি আমার ছোট চোখে ধরা পড়ে না। লাইন দিয়ে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে আর আক্রান্তদের মধ্যে বেশ অনেকজনকে খুইয়ে এদেশের স্বাস্থ্যকর্মী-সশস্ত্র বাহিনী-পুলিশ-আমলা আর সাংবাদিক প্রমাণ করে ছেড়েছে কাদম্বিনীরা মরে নাই।

টিভিতে এক চ্যানেলে মিনিয়াপোলিস আর নিউ ইয়র্কে লাখো সাদা-কালোর মিছিল দেখি তো অন্য চ্যানেলে দেখি সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে মাস্ক না পরার ছুতা ব্যাখ্যায় ব্যস্ত কাচুমাচু প্রিয় স্বদেশবাসী। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকি আর ভাবতে থাকি। আর তারপর যখন ডাক পড়ে, তখন এক টকশোতে গিয়ে দেই এই যুক্তি, তো অন্য আরেক ফেসবুক লাইভে যুক্তি দেই আরেকটা। যুক্তি দেই আর মুক্তি খুঁজি। খুঁজি শুধু-শুধুই। শুধু মনে হয় বঙ্গবন্ধু ‘আবার আসিতে যদি’! ৬৬-তে যখন বাঙালিকে ছয় দফার শানে নুযুল বুঝিয়ে ছেড়েছেন, তখন আজকে এই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আমলে চোখ-নাক-কান খোলা এ জাতিকে বোঝানো তো আপনার জন্য সামান্যই। অথচ আপনার সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে ছুটতে থাকা এ জাতির জন্য এটাই হতে পারত অসামান্য।

লেখকঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত