সুগভীরে ছয় দফার ব্যাপ্তি

2099

Published on জুন 8, 2020
  • Details Image

তৌহিদ রেজা নুরঃ

১৯৬৬ সাল। সামরিক রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জাকে হটিয়ে আরেক সামরিক রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান তাঁর ‘উন্নয়নের দশক’-এর অষ্টম বছরে সবে পদার্পন করেছেন। এর কয়েকমাস আগে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ‘জম্মু-কাশ্মীরে আধিপত্য কার’ প্রশ্নে ভারত আর পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে বিশ্ব মোড়লেরা আঞ্চলিক (এবং বৈশ্বিক) নিরাপত্তার স্বার্থে যুদ্ধরত দুই পড়শি দেশের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দেবার উদ্যোগ নেন। এই প্রচেষ্টায় সাড়া দিয়ে ১৯৬৬ সালে জানুয়ারীর প্রথম ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নের উজবেকস্তানে সপারিষদ গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান। উজবেকস্তানের তাসখন্দে সোভিয়েত প্রিমিয়ার আলেক্সান্দর কোসিগিন-এর উপস্থিতিতে স্বাক্ষর করলেন এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে– যা ‘তাসখন্দ চুক্তি’ নামে সুপরিচিত।

চুক্তির ফলে দুই দেশ যুদ্ধের ময়দান খালি করে যে যার সৈন্য ফিরিয়ে নিল ঠিক – কিন্তু এই চুক্তিকে ঘিরে সারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র অনুভূতি বিরাজ করতে লাগলো। এক মাসও যায়নি তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে; এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনের আগের দিন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি এবং নিজ রাজনৈতিক দলের সভাপতিও নন) অভাবিত এক প্রস্তাব করে বসলেন। দাবি করলেন- ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেল ফর্ম অব গভর্নমেন্ট গঠনের। শুধু কি তাই? আরেকটু শক্ত করে বললেন – শুধু সরকার গঠন নয়, সাথে সাথে সার্বিক বিবেচনায় দুই প্রদেশের জন্য পৃথক মুদ্রার ব্যবস্থা থাকা দরকার। তা যদি না থাকে, তবে থাকতে হবে পৃথক কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা। বললেন, কর-খাজনা, বৈদেশিক বাণিজ্যসহ নানাভাবে নিজেদের আয়-উপার্জন যা হবে তার হিসেব-নিকেশ করার পৃথক দায়িত্বও পূর্ব পাকিস্তানকে খুশি মনে কেন্দ্রের ছেড়ে দেয়া সমীচীন। আর একদম শেষে বললেন আরো জোরালোভাবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের হাতে নিজস্ব (আঞ্চলিক) সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা থাকা দরকার যেন বাইরের শত্রু হঠাত আক্রমণ করলে আত্নরক্ষার জন্য চাতক পাখির মত হাজার মাইল দূর থেকে রক্ষাকর্তাদের আসার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে না হয় পূর্বাঞ্চলের মানুষদের।

কিছু একটা চমকপ্রদ ঘটনা যে ঘটতে যাচ্ছে লাহোরের এই সম্মেলনে তার ইঙ্গিত দিয়ে ৩ ফেব্রুয়ারিতেই দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় এক খবর ছাপা হলো “লাহোর সম্মেলন কেবল দেশবাসীকেই নয়, ক্ষমতাসীন সরকারকেও নুতন চিন্তার খোরাক যোগাইবে: বিরোধী শিবিরের আসন্ন প্র্রতিনিধি সম্মেলনের কি ও কেন?” শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন ৬ দফা পেশ করার ক্ষেত্র প্রস্তুতমূলক এমন প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার কথা। কারণ তিনি লাহোরে রওনা হবার আগে তাঁর বন্ধু দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে নিভৃতে বলে গিয়েছিলেন এবং ইত্তেফাকে এই প্রস্তাবের প্রচারণার বিষয়ে সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। সেখানে সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। সিরাজ তাঁর বন্ধু মুজিবকে দেয়া কথা রেখেছিলেন।

ওই সম্মেলনের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে চমক দেয়া সেই প্রস্তাব করলেন শেখ মুজিব কিন্তু তরুণ নেতার এহেন দাবি হজম করতে পারেননি পশ্চিম, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের তাবড় তাবড় রাজনৈতিক নেতারা। ৬ দফা দাবিকে মূলধারা রাজনীতির প্রায় সকল সিনিয়র নেতা সেদিন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ৬ দফা প্রস্তাব সম্মেলনের কার্যসূচির অন্তর্ভুক্ত না করায় শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলসহ ৬ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সম্মেলন বর্জন করেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলিফিকার আলী ভুট্টো ঢাকার পল্টন ময়দানে ৬ দফা নিয়ে উন্মুক্ত বিতর্ক করার চ্যালেঞ্জ দেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুজিবের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ গ্রহণ করেন এই চ্যালেঞ্জ, কিন্তু ভুট্টো নিজেই আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে আসেননি। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নসরুল্লাহ খানও এর বিরোধিতা করেন। যেমন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও প্রথমে এতে সায় দেননি। আর অন্যান্য দলের নেতারা কেউ একে ‘কনফেডারেশন’-এর চক্রান্ত, ‘দেশ ভাগ’-এর ষড়যন্ত্র ইত্যাদি নানা কিছু বলে শেখ মুজিবকে দোষারোপ করতে থাকেন।

কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান দমবার পাত্র নন। লাহোর ছাড়ার আগে বঙ্গবন্ধু যে সংবাদ সম্মেলন করেন, তার খবর ১০ ফেব্রুয়ারি বার্তা সংস্থা ইউপিপি পরিবেশন করে। প্রেস কনফারেন্স করে মুজিব জোরকণ্ঠে বলেন যে, ছয় দফা আমাদের বাঁচার সনদ। তিনি যুক্তি দেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে প্রাদেশিক সায়ত্ত্বশাসনের প্রশ্ন পুর্ব পাকিস্তানের জন্য আরো জোরদার হয়েছে। পাকিস্তানকে স্বনির্ভর করতে হলে সর্বোচ্চ-সম্ভব সায়ত্ত্বশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। বহিরাক্রমন ঠেকাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জরুরি। তিনি যতই এসব বলেন, ততই ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান কন্সেপ্টের গোড়ায় যেয়ে আঘাত লাগে। উর্দিধারী রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ভয়ানক ক্ষিপ্ত হ’ন। মুজিবের এসব যুক্তি ও ৬ দফা দাবিকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ষড়যন্ত্র আখ্যা দেন। কিভাবে তা দমন করতে হয় তা বুঝিয়ে দেবেন বলে হুমকি দিয়ে ক্ষান্ত হননি– নানাভাবে দমন, পীড়ণের উদ্যোগও নেন। সময়ান্তে এই ছয় দফা দাবিকে ঘিরে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হতে থাকে। পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তারা পাকিস্তান রাষ্ট্র নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তি বৃদ্ধি করতে অনেক বেশি আগ্রহী।

তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কেন্দ্রিক আপসহীন রাজনীতি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। লাহোর থেকে ফেরার দুমাসের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয় – যেখানে তিনি সভাপতি, এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা গৃহীত হয়। ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে’তে ছয় দফার দাবিকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে পুর্ব পাকিস্তানে। এই সময়ে শাসকবর্গ নানা মিথ্যা মামলায় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে একদিকে গ্রেপ্তার করতে থাকে, অন্যদিকে আদালত থেকে জামিন নিয়ে তিনি দেশময় সফর করে মানুষকে এই দাবির পক্ষে যুক্ত হবার আহ্বান জানাতে থাকেন। এই কাজকে বেগবান করার জন্য, সকল জনপদে- সকল মানুষের কাছে এই আহ্বান পৌঁছে দেবার জন্য দৈনিক ইত্তেফাক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ৮ মে নারায়ণগঞ্জে বক্তৃতা করে ফিরে আসার পর ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গভীর রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। ৯ মে থেকে শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে দেশব্যপী প্রবল আন্দোলন শুরু হয়।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার সমর্থনে এবং সকল শোষণ, বঞ্চনা, দমন, পীড়ণের বিরুদ্ধে সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করা হয়। পুলিশের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন শহীদ হন। মনু মিয়ার রক্তমাখা গেঞ্জিসহ তেজগাঁও থেকে সে সময়ের তরুণ ছাত্র নেতা নুরে আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বের হওয়া মিছিলে ছয় দফার পক্ষের মানুষে মানুষে সয়লাব হয়ে ওঠে রাজপথ। আর এই গণ-জাগরণ রুদ্ধ করতে পুলিশ বাহিনী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ায় জেলের বাইরে থাকা মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং আমেনা বেগম ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে যান। ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার এবং ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকে ইত্তেফাকের প্রকাশনা।

শেখ মুজিবুর রহমানকে, তার রাজনীতিকে নিঃশেষ করে দেবার দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করতে আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁদ পাতে, কিন্তু উনসত্তরে জনতার রুদ্র রোষে আইয়ুব খানেরই বিদায় ঘণ্টা বাজে। গণ জাগরণের মুখে সরকার বঞ্চিত দেশবাসীর প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এসময়েই দেশবাসী অকুন্ঠ ভালোবাসায় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে আখ্যায়িত করে। একই সময়ে ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে জাতির কাণ্ডারির সপক্ষে এই পত্রিকা আবার দুর্বার প্রচারণা চালাতে থাকে।

সব শেষে, এ কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, ৬ দফার মাধ্যমেই এই অঞ্চলের পূর্ণ সায়ত্ত্বশাসনের দাবি, স্বাধিকারের দাবি ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছে। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সত্তরের নির্বাচন অভিমুখে যাত্রার কালে আওয়ামীলীগের মুল পাথেয় ছিল ছয় দফা – যা কিনা আমাদের বাঁচা-মরার দাবি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। নির্বাচনের বৈতরণী পার হতেও ছয় দফা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই অঞ্চলের মানুষ একাট্টা হয়েছে ছয় দফাকে ঘিরে। তাই অনেক সুগভীরে ছয় দফার ব্যাপ্তি। ছয় দফা এবং আমাদের সুদীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম বিষয়ে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া জরুরি। কেননা, এই সোপান বেয়েই সারা জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, অনেক ত্যাগ ও আত্নদানের মাধ্যমে স্বাধীন, সার্বভৌম একটি দেশে পদার্পন করেছে।

৭ জুন– ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস। এই দিনে বঙ্গবন্ধুকে এবং যারা এ জাতির মুক্তির জন্য আত্নদান করেছিলেন তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি।

সৌজন্যেঃ বিডিনিউজ২৪

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত