৭ জুন ১৯৬৬- ৭ জুন ২০২০

2528

Published on জুন 7, 2020
  • Details Image

সুভাষ সিংহ রায়ঃ

প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ষাটের দশকের কোনো এক সময়ে লন্ডনে বিবিসি’তে কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সে-সময় লন্ডনে গিয়েছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক দু-একজন বন্ধুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সামনে পেয়েই সৈয়দ হক জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘৬-দফা কি একটু সহজ বুঝিয়ে দেবেন?’ বঙ্গবন্ধু তিনটে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার আসলে তিন-দফা। কত নিছো? কবে দিবা? কবে যাবা?’

১৯৪০ সালে লাহোর গিয়েছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। উত্থাপন করেছিলেন লাহোর প্রস্তাব। তা গৃহীত হয়েছিল। তৃপ্তমনে ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু জিন্নাহ ১৯৪৬ সালে দিল্লির কনভেনশনে ‘স্টেটস’কে ‘স্টেট’ করে দেন। এই ‘এস’-এর মাহাত্ম্য বুঝতে সময় লেগেছে বাঙালির। এর ২৫ বছর পর লাহোর যাত্রা করলেন আরেক বাঙালি, শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ‘এস’-এর কথা মনে রেখেই করেছিলেন প্রস্তাব। তা প্রত্যাখ্যাত তো হলোই; বরং বিচ্ছিন্নতাবাদী উপাধি নিয়ে ব্যর্থ মনে ফিরলেন ঢাকায়।

 অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা একটি বই ‘দুই বাঙ্গালির লাহোর যাত্রা’ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরা যেতে পারে :

“বাংলার নেতা এ কে ফজলুল হকের জীবনে সবচেয়ে বড় কাজ কোনটি? ঋণসালিসী বোর্ড প্রতিষ্ঠা, না-কি পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন? দুটি দুই মাত্রার কাজ এবং উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ। গোটা পাকিস্তান আমলজুড়ে শুনেছি আমরা যে, হক সাহেব বিখ্যাত এই জন্য যে তিনি লাহোর গিয়ে সেই বিখ্যাত প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন, যার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হ্যাঁ, ঋণসালিসী বোর্ডের ব্যাপারটাও শোনা গেছে। বাংলার কৃষককে মহাজনী শোষণের জোয়াল থেকে মুক্ত করবার জন্য ওই সালিসী বোর্ডের প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। ভালো কাজ, সন্দেহ কী। কিন্তু কোন্টা কত ভালো? বাংলাদেশে আজ আমরা কাজ দুটিকে নতুন করে মূল্যায়ন করবো নিশ্চয়ই। আমরা যে কৃষকপ্রিয় হয়েছি হঠাৎ করে তা নয়, তবে পাকিস্তানকে সেই দৃষ্টিতে এখন আর দেখি না, যে দৃষ্টিতে দেখার শিক্ষা পাকিস্তান আমলে আমরা খুব করে পেয়েছিলাম। এখন পরিপ্রেক্ষিত বদলেছে, মূল্যায়নও রূপ নিয়েছে ভিন্নতর। কিন্তু সত্য এটা যে, ১৯৪০-এর সেই প্রস্তাবটি বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকই উত্থাপন করেছিলেন। প্রস্তাবটি তাঁর নয়, মুসলিম লীগের। ভারতীয় মুসলিম লীগের সুপ্রিম কাউন্সিলে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয় ওই বছর মার্চ মাসের ২১ তারিখে। পরের দিন অর্থাৎ ২২ তারিখে কাউন্সিল অধিবেশনে ওটি উত্থাপন করার কথা; উত্থাপন মানে ঘোষণা দেওয়া আসলে। কিন্তু ২২ তারিখে তা করা হয়নি; করা হয়েছে ২৩ তারিখে। কারণ আর কিছুই নয়, হক সাহেবের অনুপস্থিতি। ফজলুল হক তখনও এসে পৌঁছান নি, এলেন তিনি ২৩ তারিখে; তাই ২৩ তারিখেই প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো। তিনিই করলেন। সেই দিনই তিনি ‘শেরে বাংলা’ উপাধি পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেলেন। জিন্নাহ সাহেবই দিলেন, হক সাহেবের জনপ্রিয়তা দেখে নয়, সেটা দেখা গিয়েছিল অবশ্যই, উপস্থিত সদস্যরা সকলে উঠে দাঁড়িয়েছিল একসঙ্গে, বাংলার প্রধানমন্ত্রী প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে, ধ্বনি উঠেছিল তাৎক্ষণিকভাবে। জিন্নাহ সাহেব বললেন, ‘টাইগার অব বেঙ্গল’ এসে গেছেন, খুশি করবার জন্যই বললেন মনে হয়, খুশি করা প্রয়োজন ছিল। স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ওই প্রস্তাবের তখনো নামকরণ হয়নি, পরে সেটা নাম পেলো পাকিস্তান প্রস্তাবের এবং মোটামুটি তার ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠা ঘটলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের, সাত বছর পরে, ১৯৪৭ সালে।

ওই লাহোরেই আরেক প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন বাংলার আরেক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ বছর পরে, ওই মার্চ মাসের কাছাকাছি সময়েই, ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলীয় নেতাদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো এবং সেখানে প্রস্তাব এলো সম্পূর্ণ উল্টো ধরনের; ৬-দফার; স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে পাকিস্তান ভাঙার। এক বাঙালী প্রস্তাব করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার, আরেক বাঙালী প্রস্তাব করলেন পাকিস্তান ভাঙার। একই শহরে সময়ের কিছুটা ব্যবধানে। দুজনের প্রস্তাবই করলেন পাকিস্তান ভাঙার। দুজনের প্রস্তাবই কার্যকর হয়েছে। লাহোরে উত্থাপিত এক প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; আরেক প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ভেঙে চুরমার হয়েছে।

অস্বাভাবিক ছিল কি ওই দুটি কাজ- ওই দুই উত্থাপন; প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এক বাঙালীর, ভাঙার প্রস্তাব আরেকজনের? না, হক সাহেবের কাজটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। তিনি ছিলেন স্রোতের সঙ্গে। ওই প্রস্তাব উত্থাপন তাঁর জন্য কোনো বিপদ ডেকে আনেনি। কিন্তু শেখ মুজিবের কাজটা ছিল বিপজ্জনক। লাহোর শহর তাঁর ৬-দফার কথা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। আইয়ুব তো সঙ্গে সঙ্গেই গর্জন করে উঠেছিলেন। শেখ মুজিবকে জেলে যেতে হয়েছে, ঝুঁকি নিতে হয়েছে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়বার। তবে হ্যাঁ, ওই প্রস্তাব তাঁকে জনপ্রিয় করেছিল বাঙালীদের মধ্যে। যেমন হক সাহেবের প্রস্তাব জনপ্রিয় করেছিল তাঁকে মুসলমানদের মধ্যে।”

দুই

ষাটের দশকের শুরু থেকেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ বিশেষ করে অর্থনীতি বিভাগের, এই বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা শুরু করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ২৬ বছরের তরুণ অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রেহমান সাবহান ১৯৬১ সালে লাহোরে ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনট্রাকশন-এর এক সেমিনারে দু-প্রদেশের বৈষম্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়েন। যার শিরোনাম ছিলÑ “Indivisibility of the national economy of Pakistan”। প্রবন্ধটি পরে ঢাকার পাকিস্তান অবজারভারে ছাপা হয়। ড. রেহমান সোবহানের দুই অর্থনীতি বিষয়ক প্রবন্ধ ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল এবং সারা পাকিস্তানজুড়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

এরপর এ বিষয়ে তিনি আরও কিছু প্রবন্ধ লেখেন। বাঙালি অর্থনীতিবিদদের এসব প্রবন্ধ সেই সময়কার রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রভাব ফেলে। এবং এই অর্থনৈতিক তত্ত্ব বঙ্গবন্ধু ৬-দফা নির্মাণে সহায়তা করেছিল। ৬-দফার তাৎক্ষণিক পটভ‚মি হিসেবে ১৯৬৫ সাল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। একই বছর মৌলিক গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনী প্রহসন বাঙালিদের ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। পরের বছর ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের জাতীয় কনভেনশন লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬-দফা কর্মসূচি উত্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। লাহোরে বাধা পেয়ে তিনি ঢাকার তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে গণমাধ্যমে ৬-দফার বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেন।

বঙ্গবন্ধু ’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সংবলিত বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ খ্যাত ঐতিহাসিক ৬-দফা উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এ দাবি নিয়ে আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৬-দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। দলীয় কর্মী বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’

১৯৬৬ সালে ১৮ থেকে ২০ মার্চ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এই কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা দলীয় ফোরামে পাস হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ১০ মে’র মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু এটি আঁচ করে সংগঠনকে যতটা পারেন গুছিয়েছেন। কয়েকটি স্তর করা হয়েছিল। এক স্তর গ্রেফতার হলে আরেক স্তর আন্দোলন সংগঠন করবে এই ছিল কৌশল। এ-সময় ছাত্রলীগ বিশেষ ভুমিকা পালন করে। যেসব ছাত্রনেতা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেছিলেন বলে সাঈদ উল্লেখ করেছিলেন, তারা হলেন ছাত্রলীগের সভাপতি মযহারুল ইসলাম বাকী, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন; যা ’৬৯-এর মহান গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভুমি তৈরি করেছিল। স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলবো। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’

কাউন্সিল অধিবেশনের পর বঙ্গবন্ধু সারাদেশ চষে বেড়ান। ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। ৬-দফার পক্ষে ৭ জুনের সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচির পক্ষে জনমত তৈরিতে ইত্তেফাকের ভুমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে ’৬৬-এর ১৬ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষাবিধির ৩২(১) ধারার আওতায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার এবং দ্য নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক এবং বাজেয়াপ্তকৃত নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসটি ফেরত প্রদানে স্বৈরশাসক বাধ্য হয়েছিল।

রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস হচ্ছে, শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন ব্যতিরেকেই ৬-দফা উপস্থাপন করেছিলেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হলেও শেখ মুজিব ৬-দফা পেশ করেন তার ব্যক্তিগত সুপারিশ হিসেবে। কয়েক সপ্তাহ পরেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ৬-দফাকে অনুমোদন করিয়ে নেন। এখনকার মতো এত পত্র-পত্রিকা তখন ছিল না। ফলে প্রচারপত্র, পুস্তিকা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করতে হতো। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের আগে তাজউদ্দীন আহমদের নোট দেওয়া ৬-দফার একটি পুস্তিকা বের হয়। তার কিছুদিন পর দফাগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ মুজিব আর একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।

প্রথম-দফার হাহাকারের জবাবে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন : “ইহাতে আপত্তির কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আজমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর-প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি।... কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি করিয়া আমি কোনো নতুন দাবি তুলি নাই; পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরান দাবিরই পুনরুল্লেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁরা আঁতকাইয়া উঠেন, তাঁরা হয় পাকিস্তান-সংগ্রামে শরিক ছিলেন না, অথবা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি-দাওয়ার বিরোধিতা ও কায়েমী স্বার্থীদের দালালী করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।”

দুই নম্বর দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : “এই প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশী চটিয়াছেন। আমি না-কি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি।... আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে ‘প্রদেশ’ না বলিয়া ‘স্টেট’ বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থী শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝিয়াছি। কিন্তু তা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র সব বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস’ বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ফেডারেশন অথবা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মেনী, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাদের প্রদেশসমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে।”

এই ব্যাখ্যাসংবলিত পুস্তিকাটি বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লিখেছিলেন, কাউকে ডিকটেশন দিয়ে লেখান নি, সে-কথা বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিন তার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছিলেন : “পুস্তিকাটি সেকালে ব্যাপক প্রচারিত হয়েছে। আমিও আওয়ামী লীগ অফিস থেকেই সংগ্রহ করি। ৬-দফার জনপ্রিয়তার কারণে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। তাঁর জনসভাগুলোতে রাতারাতি জনসমাগম বাড়ে।”

মানিক মিয়া তার ইত্তেফাকের ‘রাজনৈতিক মঞ্চে’ লিখেছিলেন : “৬-দফা প্রস্তাবের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ অবশ্য কোন ব্যক্তি এমনকি কোন দলবিশেষ নয়। আজ দেশবাসীর সম্মুখে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে, ৬-দফার সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রামের মধ্যেই সেই বাঁচা-মরার সমস্যার সমাধানের পথ নিহিত রহিয়াছে, ইহাই সর্বশ্রেণীর জনগণের বিশ^াস।” [ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ১৯৬৬]

৬-দফা আন্দোলন দুর্বল করতে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে বাদ দিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। আট-দলীয় এই জোটে ছিল নুরুল আমীন, আতাউর রহমান খানদের জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, খাজা খয়েরউদ্দিনদের কাউন্সিল মুসলিম লীগ, গোলাম আযমের জামায়াতে ইসলামী, নসরুল্লাহ খান, সালাম খানের পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং মৌলবী ফরিদ আহমদের নেজামে ইসলাম পার্টি। ৬-দফার পাল্টা তারা একটি ৮-দফা দেয়। সেই দুর্দিনে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগমের ভুমিকা স্মরণীয়।

৬-দফা না দিলে বঙ্গবন্ধু ও তার দলের নেতাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসত না। সরকার আগরতলা মামলাও হয়তো ফেঁদে বসতো না। ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেটও ও-রকম হতো না। তার পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। পূর্ববঙ্গে যারা ৬-দফার সমালোচনা করেছিলেন, তাদের একটা বড় সংখ্যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন। যেমন- সবুর খান। তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণ এ ধরনের অনেক আন্দোলন পর্যদস্ত করেছে।’ ৬-দফা দেশে অনৈক্য সৃষ্টি করছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে ধরনের বিবৃতি দিচ্ছিল তার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানি সবুর খানদের বিবৃতির তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না।

তিন

১৯৬৬ সালে ৬ জুন বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে যা লিখেছিলেন তা আমরা ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে পাই, “আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ৬-দফা সমর্থন করবে। তবে মোনায়েম খান সাহেব যেভাবে উসকানি দিতেছেন তাতে গোলমাল বাধাবার চেষ্টা যে তিনি করছেন। এটা বুঝতে পারছি। জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও বোঝেন না। ঘরে এসে বই পড়তে শুরু করে আবার মনটা চঞ্চল হয়ে যায়, আবার বাইরে যাইÑ কেবল একই চিন্তা! এইভাবে সারা সকালটা কেটে গেল। খাওয়া-দাওয়া কোনোদিকেই আমার নজর নাই। ভালও লাগছে না কিছুই। যা হোক দুপুর বেলা খাওয়ার পূর্বেই কাগজগুলি এল। ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মীদের গ্রেফতার করছে। যশোর আওয়ামী লীগ অফিস তল্লাশি করেছে। ভ‚তপূর্ব মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মশিয়ুব রহমান প্রতিবাদ করেছেন। জনাব নুরুল আমীন সাহেব আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের গ্রেফতারের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং মুক্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শত্রæবিনাশের জন্য রচিত আইনে দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার দেশবাসীকে স্তম্ভিত করিয়াছে।’ ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আমাকে সহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দাবি করিয়াছে, আর ৬-দফার দাবিকে সমর্থন করিয়াছে এবং জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাইয়াছে।”

মুক্তিকামী বাঙালির আন্দোলনের খবরে তিনি খুশি হচ্ছেন, তাদের ওপর নির্যাতনের খবরে বিচলিত হচ্ছেন। কিন্তু কখনও তার আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেনি। ১৯৬৬-এর ৬ জুন তিনি লিখেছেন: “ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনো দিন। নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আজাদী ভোগ করবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লাখ লাখ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের ওপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমে আদর্শের জয় হয়।”

আবার বঙ্গবন্ধু ৮ জুন তার খাতায় লিখেছিলেন এভাবে, “৬-দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি, পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক-শ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সে-কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামেগঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষুরাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসক-শ্রেণীর ৬-দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত। যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কালো রাস্তা লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশের ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। রক্ত বৃথা যায় না। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেফতার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভুতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি দিতে পারি! আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ তাদের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।”

আমরা লক্ষ করে থাকব, ৭ জুন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। ৮ তারিখের পত্রিকা পাওয়া যায়নি। ৯ জুন দৈনিক সংবাদে সরকারি একটি প্রেস নোট ছাপা হয়েছে, সেটি বিশ্লেষণ করলে রক্ষণশীল একটি হিসাব পাওয়া যাবে। ৭ জুন সম্পর্কে পরবর্তীকালেও বিস্তারিত কেউ লেখেন নি। ৮ জুন ইত্তেফাক ও সংবাদ বন্ধ থাকে। দৈনিক সংবাদ ৯ জুন তারিখে নাটকীয়ভাবে শিরোনাম দেয় ‘আমাদের নীরব প্রতিবাদ’, “যে মর্মান্তিক বেদনাকে ভাষা দেওয়া যায় না, সেখানে নীরবতাই একমাত্র ভাষা। তাই গতকল্য সংবাদ প্রকাশিত হইতে পারে নাই। আমাদের এই নীরব প্রতিবাদ একক হইলেও আমাদের পাঠকরাও শরীক হইলেন, ইহা আমরা ধরিয়া লইতেছি।”

৭ জুন পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন ১১ জন। দুজনের কথা সবাই বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। একজন মনু মিয়া, অন্যজন আজাদ এনামেল অ্যান্ড অ্যালমুনিয়ামের শ্রমিক আবুল হোসেন। নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে বিক্ষোভের সময় পুলিশের গুলিতে মারা যান আরও ছয়জন। গ্রেফতারের সংখ্যা ছিল ১,৫০০-এর বেশি। শ্রমিক এলাকাগুলোতে সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ৭ জুন জেলে ভোরবেলায় উঠেই খবর পেয়েছিলেন যে হরতাল চলছে এবং এও বুঝে ফেলেছিলেন ‘এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে।’ সারাদিন টেনশনে কেটেছে তার। লিখেছেন, “হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে-কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল না-কি কোনোদিন হয় নাই, এমনকি ২৯শে সেপ্টেম্বরও না। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতোই হয়েছে হরতাল। গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি, যে একটি তামাক বাইরে আমি ছয় দিনে খাইতাম, সেইটি এখন চার দিনে খেয়ে ফেলি। কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে।...”

চার

নতুন প্রজন্মের সামনে আমরা কি বঙ্গবন্ধুর ৬-দফাসহ তার সংগ্রামের ইতিহাসগুলো উন্মোচন করতে পেরেছি? জানবার চেষ্টা করেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি? ১৯৯২ সালে প্রোব বার্তা সংস্থা নামে একটি প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু, মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাত্র ২০টি প্রশ্ন ঢাকা মহানগরের ২০০টি স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জরিপ করেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। কেননা আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর টানা ২১ বছর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির দখলে ছিল। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের টানা ১১ বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে উন্মোচিত হয়েছে।

২৬ মার্চ ১৯৭২ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তাই তিনি উচ্চারণ করেন ‘আমি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নতর জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’ নতুন করে সোনার বাংলা গড়ে তোলার সেই প্রতিশ্রুতি তিনি আমৃত্যু অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেছেন। একটি মুহূর্তও তিনি নিজের বা পরিবারকে দিতে পারেন নি। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ, মূল্যস্ফীতি, অবকাঠামো অভাব, নিরাপত্তাহীনতার মতো সংকট ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ‘শ্মশান বাংলা থেকে সোনার বাংলায়’ রূপান্তরের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। ঠিক যখন বাম্পার আমন ফলনের সোনালি হাতছানি তিনি দেখতে যাচ্ছিলেন, সেই সময়ে আচমকা আঘাত হানে একদল খুনি। এটা এখন নতুন প্রজন্মের জানা হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পিছনে ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী।

বিশেষ করে গত ১১ বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমে আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমেছে, ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। বিনিয়োগ, ভোগ ও মাথাপিছু বেড়েছে ৩ গুণেরও বেশি। গড় আয়ু বেড়েছে প্রায় ৯ বছর। এখন তা ৭৩ বছর। ভারত ও উন্নতিশীল বিশ্ব থেকে চার বছর বেশি। খাদ্যে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। রপ্তানি ৩৭ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স ১৫ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা ৫ গুণ বেড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের ঘরে (১০ বছর আগে ছিল ১২ শতাংশ)।

জেন্ডার সমতার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৪৭তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। আইএমএফের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানও ৩৪তম (ভারত ৬২তম)। এইচএসবিসি বলছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। তখন আমাদের অর্থনীতির আকার হবে ৭০০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির আকার প্রায় ৩২২ বিলিয়ন ডলার। ’৭২-এ তা ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার। গত ১০ বছর আগেও তা ছিল মাত্র ৯১ বিলিয়ন ডলার।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণে কারা উপযুক্ত নেতৃত্ব দিতে পারবে, সে-সিদ্ধান্ত তরুণ প্রজন্মকে ভেবেচিন্তে নিতে হবে। গত ১১ বছর ধরে নানা প্রতিক‚লতা পায়ে দলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৩ গুণ করেছেন, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করেছেন, তাকেই নতুন প্রজন্ম সমর্থন দেবে। ড. আনিসুজ্জামান বলেন, “১৯৭১ সালে সবাই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। আগামী দিনেও তার কর্মময় জীবন ও আদর্শ থেকে মানুষ প্রেরণা লাভ করবে। আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুকে জানার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বঙ্গবন্ধুকে জানা খুব বেশি প্রয়োজন। কেননা এত বেশি ইতিহাস বিকৃত হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু কী অর্জন করেছিলেন, তিনি কী ছিলেন, এটি অনেক সময় আড়ালে চলে গেছে।”

দু-বছর আগে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, “দেশে এখন যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুকে জানার, উপলব্ধি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে এই আহ্বান থাকবে, তারা যেন বঙ্গবন্ধুকে জানার চেষ্টা করে। নতুন প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর নাম এদেশ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। পারা যায়নি। বঙ্গবন্ধু এমনই এক মানুষ, যিনি আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছিলেন।” ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আর ২০২০ সালের ৭ জুনের ৫৪ বছরের ব্যবধান। আজ আমরা সমৃদ্ধ অগ্রগতির যে জায়গায় এসে পৌঁছেছি, তা বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার আন্দোলন থেকে উৎসরিত। এই মর্মকথা মর্মে ধারণ করতে হবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত