করোনা-পরবর্তী বিশ্বে সমৃদ্ধির সুবাতাস বইবে বাংলাদেশে

2785

Published on এপ্রিল 5, 2020
  • Details Image

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনঃ

সংক্ষিপ্ত বিশ্ব পরিস্থিতি

কভিড-১৯ সারা পৃথিবীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে। সমগ্র মানবকুল অসহায় অবস্থায় এক কাতারে কোণঠাসা। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও ওইসিডি সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিশাল নেতিবাচক ধস নামার হিসাব প্রকাশ করছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেসের মতে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বড় সংকট ও মন্দার মুখোমুখি আমরা। এ পর্যন্ত ১৯০টি দেশে প্রায় ১০ লাখ লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। প্রাণ হারিয়েছে ৪৮ হাজার মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতের যেকোনো মহামারীর তুলনায় করোনার মরণশীলতা কম, ১ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত ৫৬ জন, মৃতের সংখ্যা ছয়। বলতে দ্বিধা নেই, গত ১২ দিনের সাধারণ ছুটিকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে সরকার। তবে ওই সংখ্যায় পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্যতা আসেনি। করোনা আক্রান্ত লক্ষণসহ অনেকেই মারা যাচ্ছেন; অত্যন্ত দ্রুতগতিতে, ২ ঘণ্টার মধ্যে মরহুমদের নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাব পরীক্ষার ফলাফল প্রচার করা জরুরি। তাছাড়া মার্চে দেশে ফেরা কয়েক লাখ প্রবাসীকে ‘স্ক্রিনিং করা হয়েছে’ বলে যে গল্প প্রচার করা হচ্ছে, তার কি কোনো প্রয়োজন আছে! গত বৃহস্পতিবার থেকে সশস্ত্র বাহিনী দৃঢ়ভাবে ‘ঘরে থাকুন’ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছে বলে দেশবাসী নিশ্চিত করোনা দুশমনের বিস্তার থেমে যাবে বাংলাদেশে। তবে প্রতিদিন ১০০-১৫০ নয়, কয়েক হাজার নমুনা সংগ্রহ ও নিরীক্ষা করা জরুরি। অন্তত দুজন প্রতিদিন প্রতি ইউনিয়নে। দুটো শিক্ষামূলক প্রচারণা, একটিতে অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ এবং অন্যটিতে যৌথভাবে অধ্যাপক ডা. মোস্তফা জামান ও অধ্যাপক ডা. উত্তম বড়ুয়া খুবই চমত্কারভাবে করোনার শুরু ও বিস্তার এবং প্রতিরোধের কার্যকর পন্থাগুলো ব্যাখ্যা করছেন। সব টিভি চ্যানেল এ দুটো প্রোগ্রাম বিটিভি থেকে ধার করে প্রচার করলে দেশবাসী উপকৃত হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় উষ্ণ তাপের দেশগুলোয় করোনার ছোবল বেশ দুর্বল, আমরা যেন এ উপকার পেতেই থাকি।

অর্থনীতিতে সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি

প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন, সর্বপ্রথমেই করোনার কারণে ঘরবন্দি দিনমজুর, ছোট দোকানি, ঠেলাওয়ালা, রিকশাচালকসহ যারা নতুন করে কর্মহীন, তাদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চালসহ ন্যূনতম চাল, ভোজ্যতেল, আলু ও ডালের খাদ্য প্যাকেট ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া খুবই জরুরি। বেসামরিক প্রশাসন ও এর সহায়তায় সশস্ত্র বাহিনীই পারবে এ ধরনের অতিরিক্ত বরাদ্দ-সংবলিত সাহায্য ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা বিধান করতে। আর ১৯৯৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার পরে সোয়া কোটি মানুষকে নয় মাস ধরে খাওয়ানোর জন্য হাসিনা সরকার যে ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিতরণের ব্যবস্থা করেছিল, তার অনুকরণ নিশ্চয়ই সম্ভব হবে। তালিকাকৃতদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাগুলোর নিয়মিত বিতরণ সেভাবেই হোক। যেকোনো কারচুপির জন্য নিশ্চিত শাস্তির যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী দিলেন, নিশ্চয়ই তা কার্যকর করবে প্রশাসন। উপকারভোগীর তালিকাটা সঠিকভাবে করা দরকার। বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন, বরাবরের মতোই এবারো অমানিশার অন্ধকারের পরেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে বিশ্ব অর্থনীতি। অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে প্রচণ্ড শক্তিমত্তা যুক্ত হবে। কখন থেকে, তা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু সংকটের মধ্যেই বাংলাদেশের সামনে বিশাল বিশাল সুযোগ অপেক্ষা করছে। ভেন্টিলেটর, সার্জিক্যাল মাস্ক এমনকি পিপিই রফতানি করে সংকটাপন্ন ইউরোপ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তাদান এবং রফতানি আয় বৃদ্ধির সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। তাছাড়া আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে চিকিৎসাসেবা দানকারী স্বাস্থ্যকর্মীর চাহিদা বাড়বে ১৫ থেকে ২০ লাখ। সরকারি, বেসরকারি, এনজিও এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক সপ্তাহের মধ্যে ৩০ থেকে ৫০ হাজার স্বাস্থ্যসেবাকর্মী চিহ্নিত করে নিবিড় প্রশিক্ষণে বাইরে যেতে প্রস্তুত করা যেতে পারে। চিকিৎসকেরও খুবই সংকট রয়েছে বলে জানা যায়।

তৈরি পোশাক শ্রমিকদের জন্য ২ শতাংশ সাশ্রয়ী সুদে প্রধানমন্ত্রী যে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ ঘোষণা করেছেন, তার সঙ্গে লাভজনক এ খাতের মালিকরা তাদের নিজস্ব সম্পদ যোগ করে কর্মীদের বেতনাদি যেন অব্যাহত রাখেন। মালিকরা ক্রেতাদের কাছ থেকেও সহায়তা চাইতে পারেন। যাদের হাতে অর্ডার আছে তারা কারখানা খোলা রাখবেন। যাদের পাঠানো রফতানি চালান বিভিন্ন বন্দরে আটকে আছে, সেগুলো খালাসের জন্য সরকার সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোকে নির্দেশ দিতে পারে।

মনে রাখা ভালো, এক মাস পরেই বাম্পার বোরো ধান কাটতে হবে। প্রশাসন যদি আরো তৎপর হয়ে কিষান-কিষানির পাশে থেকে ধান কাটা এবং বিশেষ করে সংগ্রহ কাজে নিশ্ছিদ্র সততা-সফলতা আনে তাহলে খুবই উপকারে হবে। তবে খাদ্য মজুদে গুদামে সম্ভবত স্থানাভাব হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে গুদাম ভাড়া করতে হবে। তাছাড়া করোনা বেকারদের মধ্যে চালের সঙ্গে বেশি বেশি আলু যোগ করে দিলেও গুদামের স্থান মুক্ত হবে। মিল মালিকরা এবার অন্তত মানবিকতা সম্পৃক্ত ব্যবসা করলেই ভালো হয়।

অর্থনীতির বহুমুখীকরণও জোরেশোরে শুরু করা যায়। যদি এরই মধ্যে শুরু করা ১০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০-৩০টি বড় বস্ত্রকল স্থাপনে বিপুল প্রণোদনা দেয়া যায় (যন্ত্র আমদানিতে অত্যন্ত কম বা শূন্য শুল্ক, ৪-৫ শতাংশ হার সুদে মূলধন, ২২০ ভল্টের নিশ্চিত বিদ্যুৎ) তাহলে দুই বছরের মধ্যে তৈরি পোশাকের জন্য বস্ত্র আমদানি বিপুলভাবে কমবে, সাশ্রয় হবে ৬০০ কোটি ডলারের বস্ত্র আমদানির খরচ। উচ্চমূল্যের ডিজাইন আর নতুন নতুন বাজারে বৈচিত্র্যকরণে মনোযোগী হোন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীরা।

বাংলাদেশের সামষ্টিক আয়ে কর্মসংস্থান অতিক্ষুদ্র (মাইক্রো), ক্ষুদ্র (স্মল) ও মধ্যম (মিডিয়াম) উদ্যোগ (এন্টারপ্রাইজ) এমএসএমই কর্মসংস্থান শতকরা ২০ ভাগ (এডিবি) বা শতকরা ৩০ ভাগ (প্ল্যানিং কমিশন)। অথচ জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি শতকরা ৬৩ ভাগ বা তার চেয়ে বেশি। এসডিজি বাস্তবায়নে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাকাপোক্ত করতে এবং কর্মসংস্থান তথা দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনের খাতিরে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এসএমই ফাউন্ডেশনকে শক্তিশালী করা জরুরি। এর মাধ্যমেই দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণে স্বকর্মসহ কর্মসংস্থান করা সম্ভব। একটি ভেঞ্চার ক্যাপিট্যাল ফান্ড করা দরকার। একটি বা দুটি তফসিলি ব্যাংক যদি এমএসএমইতে বিশেষ নজর দেয় তাহলে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই দৃশ্যমান ইতিবাচক ফল পাওয়া শুরু হবে। হাঁস-মুরগির খামার এবং ফলফলাদির উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ এ খাতেরই অংশ। নারীর কর্মসংস্থানে এসএমই খাত খুবই সম্ভাবনাময়।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অথরিটি, ন্স্যুরেন্স রেগুলেটরি অথরিটিসহ আর্থিক খাতের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আর্থসামাজিক পুনরুত্থানে আরো বেশি অবদান রাখতে পারে। এগুলোর সংস্কার ও ক্ষমতায়ন ইতিবাচক ফল আনতে সহায়ক হবে।

১৯৯৬-২০০১ সময়কালে সরকার যেভাবে সঠিক বিনিময় হার নির্ধারণ করে, একইভাবে বর্তমানে অতিমূল্যায়িত টাকাকে আমাদের রফতানি প্রতিযোগীদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে অবমূল্যায়ন করা গেলে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে। আমদানি কমবে এবং মুদ্রা পাচারে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং অলাভজনক হয়ে পড়বে। তবে দেশবাসী ব্যাংক ও মূলধন বাজার লুটেরা, যারা বিদেশে সম্পদের পাহাড় (দৃশ্যমান) গড়েছে, তাদের বিচার দেখার অপেক্ষায়। ১৯৯৬ সাল থেকে যারা শীর্ষ ঋণখেলাপি, তারা সাদা হয় কীভাবে!

লেখক: ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজকর্মী

সৌজন্যেঃ বণিকবার্তা (০৪ এপ্রিল ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত