করোনা যুদ্ধ: সর্বাধিনায়ক শেখ হাসিনা ও তার হৃদয়বান সৈন্য ডাক্তার

4179

Published on এপ্রিল 4, 2020
  • Details Image

খাজা খায়ের সুজনঃ

‘আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি কোমল বিদ্রোহী, প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে। অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্মক একটি আগ্নেয়াস্ত্র, আমি জমা দেয়নি।’

এ কথাগুলো নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। আর গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। আমি এখানে আরও বিশেষভাবে স্মরণ করছি বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগমকে। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন ত্রিপুরায় বাংলাদেশীদের জন্য স্থাপিত হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। যিনি আসলেই হৃদয় দিয়ে তখন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন। তিনি পাকিস্তান আর্মি থেকে পালিয়ে ত্রিপুরায় গিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন।

যে কথাটি বলতে চাচ্ছিলাম, করোনাভাইরাসে সারাবিশ্ব এক মারাত্মক সংকটের মুখে। থমকে গেছে সব ধরনের স্বাভাবিক কার্যক্রম। কিন্তু মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয়। এই মানবকি বিপর্যয়ের মুখে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের সচেতনতার বিকল্প আর কিছু নেই। করোনা আতঙ্কে আমরা সবাই আতঙ্কিত । সারাবিশ্ব আজ এই কোভিড-১৯ বা করোনার কারণে থমকে আছে। যতদিন যাচ্ছে সারাবিশ্ব ততই যেন মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। সর্বশেষ আইইডিসিআর এর হিসেবে দেখা যাচ্ছে দেশে আজ পর্যন্ত ৫৪ জন শনাক্ত হয়েছে। আর সুস্থ হয়েছে ২৬ জন। তবে ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে তিনজনকে শনাক্ত করা হয়। তখন বলা হয়, এই তিনজনের মধ্যে দু’জন ইতালি থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। তাঁদের কাছ থেকে একজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত দেশে ছয়জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গত ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

এছাড়াও সারাবিশ্বে ইতোমধ্যে ৮,৫৮,৭৮৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন। যেখানে মৃত্যু হয়েছে ৪২,১৫১ জনের। এর মধ্যে প্রায় ১৮০ টি দেশ রয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত ভয়ংকর চিত্র। প্রতিদিন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে ইতিমধ্যে এপিডেমিক বা মহামারী ঘোষণা করেছে। এছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস করোনা ভাইরাসকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ‘সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট’ বলে অভিহিত করেছেন। আচমকা উদ্ভব হওয়া এই মহামারী সামাল দিতে বিশ্বের বহু দেশ মারাত্মকভাবে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশও এটিকে প্রতিরোধে কিছু অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। কোভিড-১৯ কে মহামারী ঘোষণার পরে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করতে আসেন ৩৭ জন সঙ্গে নিয়ে। আমাদের সরকারি উচ্চপদস্থ কারও দ্বারা এই সকল আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়।

এতো কিছুর মধ্যেও আমাদের সকল হতাশার মধ্যেও যিনি বীরের মতো লড়ে যান তিনি আমাদের আশার একমাত্র বাতিঘর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিবিড়ভাবে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন এবং সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন। আমরা এটা খুব ভালো করে জানি শেখ হাসিনা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং করবেন । এটাই বাঙ্গালির ভরসার একমাত্র জায়গা। তিনি ইতোমধ্যে আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “ভোটের সময় যেভাবে দরজায় দরজায় গিয়ে ভোট চেয়েছিলেন, সেভাবে দরজায় দরজায় গিয়ে যারা না খেয়ে আছে গরীব দুঃখীদের খাবার পোঁছে দিবেন”।

মানুষের বিপদের মুহূর্তে তাদের পাশে দাঁড়ানো এটা তাঁর ঐতিহ্যগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করেন তখন তিনি সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদের ধারা ১-এ সন্নিবেশিত করেন সেখানে বলা আছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে’।

বঙ্গবন্ধু তখন থেকেই এই রাষ্ট্রের মানুষের জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন এবং স্বাস্থ্য সেবার অধিকার সংবিধানে সন্নিবেশিত করে গেছেন। তিনি রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি মানুষের কথা বিবেচনা করে কাজ করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায় আসার পর স্বাস্থ্য খাতকে আরও বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি এ রাষ্ট্রে প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। যেটি আমাদের চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে এক অনন্য মাইলফলক হিসেবে রয়েছে। এছাড়াও ইতোমধ্যে তিনি আরও ৩টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরও কিছু যুগান্তকারী কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১১ প্রণয়ন, জাতীয় ঔষধনীতি-২০১৬ প্রণয়ন, মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সহযোজন আইন-২০১৮ প্রণয়ন ইত্যাদি। তিনি এ চিকিৎসা সেবাকে মানুষের দৌরঘোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে প্রায় ৫,০০০ ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেন। কিন্তু আমাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর এ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আমরা দেখতে পাচ্ছি শেখ হাসিনা দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের উন্নয়নে। যেটি আসলে শুধু দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে করে যাচ্ছেন। এই দেশ ও দেশের মানুষকে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর হৃদয় থেকে উজাড় করে সকল ভালোবাসা।

এতসব বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা দাঁড় করিয়েছেন এ বাংলাদেশকে। শক্ত মেরুদণ্ড দিয়েছেন এ বাংলাদেশকে। তেমনি নিশ্চিত করেছেন এ দেশের জনস্বাস্থ্য, আরও মজবুত করেছেন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। তাঁর এ সফলতার পেছনে যারা নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন তারা এ বাংলাদেশের চিকিৎসকগণ ও চিকিৎসা কর্মীরা । তারা তাঁদের নিজেদের জীবন বাজি রেখে অতীতের ন্যায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যেমনটি আমরা লক্ষ্য করেছিলাম ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী বর্তমান আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯ বা করোনা। যতদিন যাচ্ছে মৃত্যুর মিছিল আরও লম্বা হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর আতঙ্কের খবর হচ্ছে চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীরাও ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যেটি আমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর সংবাদও বটে। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় ইতালিতে আট শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় সংক্রমিত। আর স্পেনে এই সংখ্যা ১৬.৫ শতাংশ। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ৫৪ জনের মধ্যে ১২ জনের বেশি হচ্ছে চিকিৎসক ও চিকিৎসকরই । যেটি আমাদের মারাত্মকভাবে ভাবিয়ে তুলছে। আমি বলবো আমাদের এই মুহূর্তে আক্রান্ত হলে একমাত্র ভরসা শুধু হাসপাতাল নয় বরং হাসপাতাল ও চিকিৎসক। কিন্তু আমাদের এই চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীরা আছেন মারাত্মক ঝুঁকিতে। তাঁদের জন্য নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নেই পিপিই।

অন্যদিকে এই পিপিই নিয়ে রীতিমতো চলছে তামাশা। আসলে এটিকে তামাশা বলব নাকি মশকরা করা বলবো বুঝতে পারছি না। সম্প্রতি আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন ডাক্তারদের পিপিই’র দরকার নাই।এইরকম ভয়ংকর কথা যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন তাহলে আমাদের ডাক্তারগণ যাবেন কোথায়? এইরকম আরো দেখলাম রাজধানী ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মহোদয় সরাসরি নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছেন। স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, হাসপাতাল কোন পিপিই সরবরাহ করবে না এবং ডাক্তারদের নিজ নিজ দায়িত্বে সেটি সংগ্রহ করতে হবে। তিনি ভুলে গিয়েছেন এ দেশে এখনও একজন শেখ হাসিনা আছেন। আরও দেখলাম একটি গ্রুপ ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে সেটি হলো সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কর্মকর্তারা পিপিই পরিধান করে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছেন। দেখে মনে হলো তারা এখনই চন্দ্রাভিযানে যাবেন। যাইহোক এই পিপিই নিয়েও তামাশার সমাপ্তি টানলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী । তিনি সরাসরি বলে দিয়েছেন “পিপিই শুধু ডাক্তারদের জন্য। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ব্যতীত অন্য কেউ পড়লে তাকে এখন থেকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব রোগীর সেবা করতে’।

আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের চিকিৎসকরা পিপিই’র তোয়াক্কা না করে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর এক কথায়। আসলেই তাঁরা হৃদয়ের মতো আগ্নেয়াস্ত্রটা দেশের সেবার জন্যই রেখে দিয়েছেন বলেই সম্ভব হচ্ছে। তাঁদের হৃদয়টাই আজ বাংলাদেশ। তাঁরাই বাংলাদেশের শক্তি। আমরা আরও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম আমরা কিছু লোক হাসপাতালে ডাক্তারদের কাছে তথ্য গোপন করছি। সিলেটে একজন মারা গেলেন সম্পূর্ণ করোনার উপসর্গ নিয়েই। তিনি দুই তিনবার হাসপাতালে গিয়েছিলেন, কিন্তু একবারের জন্যও ডাক্তারের কাছে বলেননি তার ছেলে দশদিন আগে যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে। আরেকজনের খবর পেলাম যিনি করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন কিন্তু স্বীকার করেননি তিনি সপ্তাহ খানেক আগে ওমরা করে এসেছেন।

আমরা নিজেরা অসুস্থ হচ্ছি পাশাপাশি আমরা আমাদের ডাক্তারদের ঠেলে দিচ্ছি মহা-বিপর্যয়ের দিকে। আমাদের মনে রাখা দরকার ডাক্তারদেরও পরিবার আছে। তাঁরাও কারো সন্তান, কারো স্ত্রী, কারো মা, কারো বাবা। একজন ডাক্তারকে হাসপাতালে পাঠিয়ে তাঁর পরিবার কতটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে তা কেবল একজন ডাক্তারের পরিবারই উপলব্ধি করতে পারে। তাই ডাক্তারের ভাষায় বলতে হয় ‘প্রিয় রোগীরা, দয়া করে ডাক্তারের কাছে আপনার তথ্য গোপন করবেন না। আমাদেরও পরিবার আছে”।

আমি বলবো এই মুহূর্তে যে মানুষগুলো সারা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, প্রতিদিন হাজার হাজার সন্দেহভাজন রোগীর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন তারা আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হৃদয়ের অধিকারী।

আমরা এখনো অত্যন্ত সাহস নিয়ে বলতে পারি আমাদের একজন শেখ হাসিনা জেগে আছেন আর তাঁর সাথে আছেন শ্রেষ্ঠ হৃদয়ের অধিকারী ডাক্তাররা। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ও সালাম সে সকল চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী তথাপি তাঁদের নেতৃত্বদানকারী আমাদের মাননীয় প্রধনামন্ত্রীর প্রতি। আমরা ঘরে থাকি, নিজে সুস্থ থাকি, আমার কারণে যেন অন্য কেউ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখি।

লেখক: ছাত্রনেতা ও সাবেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক (৩ এপ্রিল ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত