বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি

3994

Published on মার্চ 26, 2020
  • Details Image

জয়ন্তী রায়ঃ

আমি নরসিংদীর রায়পুরায় জন্মগ্রহণ করলেও আমার জীবনের বিরাট এক অংশ অতিবাহিত হয় ময়মনসিংহ শহরে। এখানে শুরু হয় লেখাপড়া এবং রাজনীতি ও কর্মজীবন। আমি ময়মনসিংহ মহাকালী উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে সেখান থেকে এসএসসি পাশ করি। এরপর মমিনুন্নেছা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করি। পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ আনন্দমোহন কলেজে। এ কলেজ থেকেই আমি এমএ ডিগ্রি অর্জন করি।

ছাত্রজীবনেই সাম্যবাদী আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথম দিকে। সেই শুরু থেকে প্রায় ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছি। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্পর্কে কিছু বলতে হয়।

আমাদের পরিবার ছিল রক্ষণশীল। একটা সাংস্কৃতিক আবহ ছিল, যার জন্য পরিবারে রক্ষণশীলতার পাশাপাশি কিছুটা সংস্কারমুক্তও ছিল। তবু মা-বাবা, দাদু-দিদিমা কেউ জানতেও পারলেন না, কখন আমি রাজনীতির উঠোনে পা রাখলাম। কখন এবং কেমন করে যুক্ত হই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আমার কাছেও নেই। তবে এখনো আমার মনে পড়ে, প্রথম রাজপথে স্লোগান দিই এবং মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়া শুরু করি সেই ১৯৬২ সালের শরীফ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে। এরপর থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে বা দলীয় কাজে বেশি বেশি যুক্ত হতে থাকি। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে আইয়ুব সরকারের প্ররোচনায় দেশে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। এই দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ সর্বদলীয় জোট আন্দোলনে নামে। এই জোটে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নও যুক্ত ছিল। ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মী হিসেবে আমিও সহকর্মীদের নিয়ে রাজপথে থেকে কাজ করেছি। এর পরই ১৯৬৫ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী ছিলেন আইয়ুব খান। অন্যদিকে বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছোটো বোন ফাতেমা জিন্নাহ। আওয়ামী লীগসহ কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করে। এই নির্বাচনেও প্রচার-প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছি, যার জন্য সংগঠনে আমার গুরুত্ব বাড়ে। ১৯৬৭ সালে মমিনুন্নেসা কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা নির্বাচিত হই। গণ-আন্দোলনের মাত্র দুই বছর আগে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সময়টি ছিল উত্তাল, অনিশ্চিত, স্পর্শকাতর এবং সংগত কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

সংগঠনের প্রত্যেক সদস্য নিজ পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতেন। ঐ সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এরকমই ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলত বিচিত্র এবং গোপন রাজনৈতিক কলাকৌশলে। বলে রাখা ভালো, রক্ষণশীল পরিবার থেকে এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তি ঘটেছিল আমার বড়ো ভাই বিকাশ পালের হাত ধরে। আমার বড়ো ভাই ছাত্ররাজনীতি করতেন। গোপন বৈঠক, হারিকেনের ম্লান আলোয় চিঠি লেখালেখি, পার্টির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-সংবলিত কাগজপত্র চালাচালি, বই পড়ে পরিপক্ব হওয়া ছিল এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড।

প্রায়শই গোপন বৈঠক বসত আমাদের বাড়িতে, অজয় রায় ময়মনসিংহ জেলার পার্টি সেক্রেটারি তখন। অজয় রায়ের গোপন আবাস হলো আমাদের বাড়ি। পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে এ সময়েই। রাজনীতি অপছন্দ করা বাবা সমাজসচেতন, মননশীল, সংস্কৃতিমনস্ক ভালো মানুষ অজয় রায়কে পছন্দ করলেন। একটি রক্ষণশীল পরিবারে এভাবেই সম্ভাব্য বিয়ের বিঘ্ন এড়ানো গেল। তা-ও সম্ভব হলো অজয় রায়ের ব্যক্তিত্বের কারণে।

তারপর ১৯৬৯। গণজোয়ারে কেঁপে কেঁপে উঠছে দেশ। আন্দোলনে গতি সঞ্চার করতে অজয় রায় দৃশ্যতই প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে আসেন এবং গ্রেফতার হন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে গ্রেফতার হন। অজয় রায়ের ব্যবহারে জেলার পর্যন্ত তাকে সম্মান করতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা জেলখানায় তাকে দেখতে যেতাম।

আমি ছাত্রজীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতির সংস্পর্শে আসি। শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি উদার, গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই ছাত্র আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা অজয় রায়ের সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয় আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করেছিল।

বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরব ও অহংকারের বিষয় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কোনো জাতির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে শরিক থাকা, সমান্যতম অবদান রাখতে পারা যেকোনো ব্যক্তির জন্য গর্বের ব্যাপার। আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি এ জন্য যে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করার লড়াইয়ে আমার অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কোথাও কোনো দিন বাঙালির কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। ঐতিহাসিক সত্য যে বাঙালিকে শাসন করেছে বাঙালি ছাড়া সবাই। যে সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার স্বাধীন নবাব বলে চালানো হয়, তিনিও না কথা বলতেন বাংলায়, না পড়তে পারতেন বাংলা। আর সম্প্রতিক কালে জামায়াত-বিএনপির শাসনামলে যে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিকে বাংলার জাতির পিতা হিসেবে আবিষ্কারের অপপ্রচেষ্টা চালানো হয়, তিনিও ছিলেন একজন আরব শাসকমাত্র।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন বাঙালির প্রথম স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও শাসক। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এর বাইরে কোনো ঐতিহাসিক বাস্তবতা নেই। এজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতির পিতা এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।

আমাদের স্বাধীন, সার্বভৌম এই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় সুদীর্ঘ চব্বিশ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাকে অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। তাকে বারবার কারাগারে যেতে হয়েছে। জীবনের বিরাট এক অংশ কারাগারে বন্দী থাকতে হয়েছে। তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, শ্রম-মেধা এবং প্রজ্ঞা ও যোগ্য নেতৃত্বের ফসলই আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৯৬৩ সালে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন এবং ছাত্র আন্দোলনে পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তা উপলক্ষ্যে শেখ মুজিবুরের কাছে একাধিকবার যান তার ৩২ নম্বর বাসভবনে। কখনো রেজা আলী, মানিক বা মুর্তজা ভাইয়ের সঙ্গে। আন্তরিকতায় সিক্ত তার পরামর্শ ও সহযোগিতা সব সময় পান, নিজের কর্মীদের জন্য সংগৃহীত সীমিত সঞ্চয় থেকে তিনি পঙ্কজদাদের বড়ো অনুষ্ঠানের জন্য হাজার টাকাও দিয়েছেন, এমনকি তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর কাছে তিনি তাদের পাঠাতেন অধিক অর্থের প্রয়োজনে। একাধিকবার দেখেছেন মফস্সল থেকে আসা আওয়ামী লীগের গরিব ও নিম্নবিত্ত কর্মীরা নেতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, তাদের তিনি মধুর ব্যবহারে তুষ্ট করে সংগঠন ও আন্দোলনের কাজে জোরদারভাবে নামতে উত্সাহিত করতেন। বিদায় পর্বে কর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে তার পকেটে পুরে দিতেন একটি হোমিওপ্যাথিক পুরিয়ার মতো জিনিস। পরে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রশ্ন করে জেনেছেন, গরিব কর্মীরা কষ্ট করে ঢাকা আসে, তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে তিনি ৫০, ১০০ ও ২০০ টাকার পুরিয়া করে রাখেন।

১৭ অক্টোবর ১৯৬৭ সাল। চার দিন গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের পর পঙ্কজদাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত করে পাঠানো হয়। কারাগারে ঢুকেই দেখেন কারাগার হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন শেখ মুজিবুর রহমান। জিজ্ঞাসাবাদের পর বিস্তারিত বিষয় তাকে জানান। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা অতর্কিতে বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্রভাবে হামলে পড়ার মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আমরা তখন ময়মনসিংহে ছিলাম। ১ মার্চ থেকেই আমরা আসলে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পথেই হাঁটতে শুরু করেছিলাম। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল এক রকম। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও দোদুল্যমানতা ছিল, শেষ পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে, শান্তিপূর্ণভাবে সংকট নিরসন হওয়ার একটি ক্ষীণ আশা অনেকের মনে জেগেছিল। কিন্তু ২৫ মার্চের রাত এবং তার পরের সময় আমাদের নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশঃ দৈনিক ইত্তেফাক (২৬ মার্চ ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত