2455
Published on মার্চ 26, 2020অজয় দাশগুপ্তঃ
এতগুলো বছর যেমন কম সময় নয় তেমনি একটি দেশ বা জাতির বিচারে বেশি কিছুও না। বাংলাদেশ আজ সে বয়সে পা দিয়েছে। একাত্তর ছিল অবিতর্কিত এক গৌরবময় অধ্যায়। আমি তখন বালক বেলায়। সে বালকের মুগ্ধ বিস্ময় শুদ্ধ ভাবনা পঁচাত্তর পর্যন্ত টাল খেলেও ভেঙে পড়েনি। কিন্তু বাংলা মায়ের দুর্ভাগ্য পঁচাত্তরের আগস্ট আর নভেম্বরে একে একে হারিয়ে গেলেন জাতির জনকসহ জাতির যত অভিভাবক।
রাজনীতির সেই দুর্বিপাকে আমরা কেবল নেতাদের হারাইনি হারিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের পরিচয়। এ বড় বেদনার । যে দেশ একজন মানুষের তর্জনী শাসনে স্বাধীন হয়েছিল সে দেশের বুকে চেপে বসল সামরিক জান্তা। জিয়াউর রহমানকে যারা যত বড় আর মহান করে দেখেন না কেন মানতে হবে তার হাত দিয়েই ইতিহাস বিকৃতির শুরু। নীরবতার ভেতর দিয়ে তিনি যেসব বিষয়ের অনুমোদন দিয়ে গেছেন তার পথ বেয়ে এরশাদের জš§। পরে বিএনপি জাতীয় পার্টি সবাই মিলে প্রায় শেষ করে এনেছিল আমাদের সবকিছু। বিশেষত ইতিহাস আর মুক্তিযুদ্ধ।
অনেকে মনে করেন এগুলো বায়বীয় বিষয়। এ দিয়ে কিছু হয় না। চেতনা জয় বাংলা বাংলাদেশ এগুলো ধারণা মাত্র। আসলে কি তাই? সময়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন তো। কি উত্তর দিয়েছে বাংলাদেশ? কত বছর পর সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিভাবে তার চরিত্র আর সম্মান বজায় রেখেছে আমাদের দেশ। এটা কি সহজ না সম্ভব ছিল আসলে? এমন একটা সময় এসেছিল যখন এদেশে জয় বাংলা বলা যেত না।
মুক্তিযুদ্ধের মূল স্লোগান মূল ধারণা নেতা ইতিহাস সবই হয়ে উঠেছিল অচ্ছ্যুৎ। নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও নানাভাবে তা চাপিয়ে দিয়েছিল আমাদের ওপর। সমাজে এমন এক ভ্রান্ত ধারণা এমন এক পরিবেশ যেন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ মানে গোপন কিছু। সে রাখ রাখ ঢাক ঢাকের অন্তরালে বেড়ে উঠছিল গোপন অদৃশ্য যত শত্রæ।
আজকের বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে। শেখ হাসিনা অনেক জরুরি সমস্যার সমাধান করেছেন। রাজাকার দালালদের বিচার করেছেন। কিন্তু এটাও সত্য তাঁর সরকারে এমন সব মন্ত্রী আছেন যারা তরী ডোবাতে যথেষ্ট। এই যে ধরুন সারা বিশ্বে এখন করোনা ভাইরাস তা নিয়েও তারা মশকরা করেছে। যার যা খুশি বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার পাশাপাশি বিপদে ফেলেছেন।
একটা কথা মানতে হবে স্বাধীনতা মানে কিন্তু সবার মুক্তি। সবার কথা বলার অধিকার। দেশে কি এখন এটা মানা হয়? মূলত কোনো বিরোধী দল ছাড়া রাজনীতি চলছে একমুখী। এই একমুখিনতা মারাত্মক। যতদিন শেখ হাসিনার সরকার ততদিন হয়তো সব ঠিক আছে, তারপর?
এই বিষয়টা স্বাধীনতার সাথে জড়িত। বঙ্গবন্ধু যদি কথা বলতে না পারতেন তাহলে কি একটি দেশ পেতাম আমরা? একমাত্র স্বাধীনতাবিরোধী ও দেশবিরোধী ব্যতীত সবার মুখ মন চিন্তা খোলা না রাখলে মুক্তি কথাটাই তার গুরুত্ব হারাবে। যার অনেকটা ঘটে গেছে।
৭১ ও আজকের বাস্তবতাও এক না। এখন যে নতুন প্রজন্ম তারা অনেক জানে। তাদের হাতের মুঠোয় দুনিয়া। তাদেরকে খালি চেতনার কথা বলে বশে রাখা যাবে না। তারা অনেক স্মার্ট। তাদের মন মনন ও মেধার সাথে যাবার মতো নেতা কম। কোনো রাজনৈতিক দলের আছে বলেও মনে হয় না।
রাজনীতিহীন বাংলাদেশ যেমন অবাস্তব তেমনি গড়পড়তা ও বয়সী নেতারাও আজ অবাস্তব। স্বাধীনতার এই দিনে মনে করব সদ্য স্বাধীন থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত যে প্রজন্ম তাদের কথা। এরা সবাই ত্যাগ করেছে। কেউ স্বপ্ন কেউ দেশ কেউ জীবন ত্যাগ করে দেশও জাতিকে পুষ্ট করে গেছেন। আমরা এক বেলা আধপেটা খাওয়া বাঙালি। হাজার কোটি শত কোটি? এক লাখ টাকাই ছিল ধনীর সম্বল। সে দেশে এখন টাকার বন্যা।
সব মিলিয়ে বলব অর্থনৈতিকভাবে এগুলোর দারিদ্র্য যায়নি। গরিবের সরকার হয়নি এখনো। বড়লোকদের লোভের সীমা টাকা পাচার ঘুষ দুর্নীতি এখন গল্পকেও হার মানায়। প্রকৃত স্বাধীনতা এগুলো চায় না। তার দরকার গণতন্ত্র। যেখানে সবাই বলতে পারে শুনতে চায়। এটাও ঠিক যারা বলে যারা বিরোধিতা করে তাদেরও থাকতে হবে দেশপ্রেম। এই মিলন ব্যতিরেকে কোনো স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না হতে পারে না। এটাও বিস্ময়ের ব্যাপার দেশ স্বাধীন হবার পর তলাবিহীন ঝুড়ি বলা মুরব্বি আজ মাথায় হাত বুলায়। তারপরও রাজনীতির দৈন্য যায়নি।
আমার ধারণা স্বাধীনতার সুফল যে সংস্কৃতি বা আমাদের রুচি ও নিজস্বতা সেটা এখন ঘোর বিপদে। মুক্তিযুদ্ধ যে আদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে লড়াই করেছিল তা প্রায় শেষ। এককালে সংস্কৃতি পথ দেখাত এখন দেখায় অন্ধ বিশ্বাস। এখন সব ধর্ম প্রচারকারী বা বক্তারা সেলিব্রিটি। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই কমবেশি দায়ী। তবে সংখ্যাগুরুরাই এগিয়ে। একটি সত্যিকারের স্বাধীন সমাজে এত বাড়াবাড়ি বা একতরফা বিষয় থাকে না। বাউল ফকির থেকে ইন্টারনেট অপপ্রচারের শিকার যে কোনো মানুষকে দেখলেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন।
বাংলাদেশ কেন কিজন্য স্বাধীন হয়েছিল ইতিহাস জানে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সে কথা লেখা আছে। তরুণ তরুণীরা জানে না। জানে না নতুন প্রজন্ম। এত বছর পরও ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক যায়নি। যায়নি পাক প্রেম। তলে তলে যারা বাংলাদেশকে শেষ করে দিতে চায় তারাও আছে বহাল-তবিয়তে।
তারপরও কি দারুণ ঝলক। পাকিস্তানি মেধা ও মিডিয়া বলে আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও। এই গৌরব ও অর্জনের বলে বলীয়ান দেশ কেন নানা বিষয়ে এত সঙ্কীর্ণ? কেন তার রাষ্ট্রযন্ত্রে এত ভয় এত দ্বিধা? এখনো কি সময় হয়নি তার অবমুক্তির? এখন তো তার উড়ালের সময়। বাংলাদেশের বহুবিধ উন্নতির পাশাপাশি এখন সবদিক থেকে মুক্তি প্রত্যাশী। এর নামই স্বাধীনতা। জয়তু বাংলাদেশ।
সৌজন্যেঃ মানবকণ্ঠ (২৬ মার্চ ২০২০)