এক অগ্রদূতের কণ্ঠস্বর

2103

Published on মার্চ 16, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):

মার্চ মাসটা বোধ করি বাংলাদেশের জন্য ইংরেজি ক্যালেন্ডারের বারোটি মাসের মধ্যে সবচাইতে বেশি তাত্পর্য বহন করে। যে কোনো জাতির ক্যালেন্ডারেই একাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা থাকে, যা উদযাপিত হয় জাতীয়ভাবে, অন্তর্ভুক্ত হয় রাষ্ট্রীয় ক্যালেন্ডারে। এই মার্চ মাসে আমাদেরও রয়েছে এরকম বেশ কিছু জাতীয় দিবস। যেমন ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিন, জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস আর ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস, যেদিন জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আবার এই মার্চেই এমন কিছু দিন আছে, যা রাষ্ট্রীয় ক্যালেন্ডারের সেই সংক্ষিপ্ত তালিকায় নেই। এসব দিনে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে না, রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপিতও হয় না দিনগুলো। সাধারণের গাড়িতে-বাড়িতে ওড়ে না রাষ্ট্রের পতাকাও। এই দিনগুলো বাঙালি স্মরণ করে প্রাণের তাগিদে। যেমন ৭ই মার্চ, যেদিন ’৭১-এ তখনকার রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে ইউনেস্কো ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ৭ই মার্চের ভাষণ আমার বিবেচনায় যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটি এখনো পায়নি, তা বোধ করি ‘বিশ্বের সর্বাধিক শ্রুত ভাষণ’ হিসেবে গিনেস বুকে অন্তর্ভুক্তি। আরো আছে ২৫ মার্চ, যে কালো রাতে পাকিস্তান সূচনা করেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার, আমাদের কাছে যা গণহত্যা দিবস।

এই মার্চে বাংলাদেশ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার দ্বারপ্রান্তে। এ বছর আমরা উদ্যাপন করতে যাচ্ছি মুজিববর্ষ—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। তার পরের বছরই বাংলাদেশের ৫০ বছর, সূর্বণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু একে অপরের সমার্থক বলাটা বোধ করি বাড়াবাড়ি কোনো বিষয় নয়। আর সে কারণেই বোধ হয় বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু—এই দুটি মাইলফলক বাঙালির কাছে একসঙ্গে এসে হাজির হয়েছে। আগামী দুটি বছর বাঙালি যখন প্রস্তুত হচ্ছে পিতা আর মাতৃভূমির জন্মবার্ষিকীর উত্সব উদ্যাপনে, সেই প্রেক্ষাপটে এবারের মার্চ বহন করছে অন্যরকম তাত্পর্য।

বাঙালি আর বাংলাদেশ ছাড়িয়ে ৭ই মার্চের ভাষণ এখন সবার, সমগ্র মানব জাতির। কী প্রেক্ষাপটে ৭ই মার্চের ভাষণের এই কালজয়ী আবেদন, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। আমাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, গত হাজার বছরে কখনোই এই ভূখণ্ড বাঙালির শাসনে ছিল না। দফায় দফায় এদেশের শাসনক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। এখানকার ঔপনিবেশিক শাসকদের দীর্ঘ তালিকায় নাম লিখিয়েছেন ইউরোপীয়, আরবি, পারস্য, এমনকি আফ্রিকার দাস বংশের শাসকেরাও। ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে আমাদের যে অর্জিত জ্ঞান, তা আমাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে চিনতে শিখিয়েছে। অথচ এই সিরাজ বাঙালি বংশোদ্ভূত ছিলেন না। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের বিশাল বাহিনীর মুষ্টিমেয় ইংরেজ সেনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আশপাশের গ্রামগুলোর হাজারো বাসিন্দা। তারা সেদিন সিরাজের সমর্থনে এগিয়ে এলে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস অন্যভাবে লেখার প্রয়োজন পড়ত। আবার এই কদিন আগেও জোট সরকারের অন্ধকার সময়ে আমাদের শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, বখতিয়ার খিলজি নামে জনৈক আরব সেনাপতি দেড় ডজন অশ্বারোহী নিয়ে নাকি বঙ্গদেশ বিজয় করেছিলেন।

হাজার বছরের ঔপনিবেশিক শাসন, অনেক অপপ্রচার আর সবচেয়ে বড়ো কথা, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৯ পর্যন্ত, মাঝে ৭২ থেকে ৭৫ আর ৯৬ থেকে ২০০১—এই কটি বছর বাদ দিয়ে ক্রমাগত যে ইতিহাস বিকৃতি আর বিকৃত ইতিহাসের চর্চা, তাতে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে অনেক। তার পরও এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে বঙ্গবন্ধু শুধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিই নন, বরং হাজার বছরের মধ্যে তিনিই এই ভূখণ্ডের প্রথম বাঙালি শাসক। আর এই ভূখণ্ডকে আবারও স্বাধীন করে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি আর ১০টি দেশের স্বাধীনতার চেয়ে একেবারেই আলাদা, একদম স্বতন্ত্র। একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেট নিয়ে, একটি সাংবিধানিকভাবে বৈধ, কিন্তু সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আধুনা পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দেওয়ায় বঙ্গবন্ধুর যে কৃতিত্ব, তা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এক এবং অদ্বিতীয়। কথায়-আলোচনায় নাম আসতে পারে আব্রাহাম লিংকন থেকে শুরু করে রুজভেল্ট, চার্চিল, দ্যা গল, মহাত্মা গান্ধী, ফিদেল কাস্ত্রো আর নেলসন ম্যান্ডেলারও। কিন্তু তাদের কারো ঝুলিতেই নেই এমন অসামান্য কৃতিত্ব।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নয় মাসের ফ্রেমে বাঁধা যাদের স্বপ্ন, তাদের বসবাস আসলে বোকার স্বর্গে। ‘হাত মে বিড়ি মুখে মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’--এই স্লোগান মুখেই এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা একদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অবিভক্ত ভারত ভেঙে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের পর বাঙালির মোহভঙ্গ হতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। এর প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, যেদিন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর মুখের ওপর নো-নো বলে প্রতিবাদী হয়েছিলেন বাঙালি তরুণ ছাত্ররা।

তারপর দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় একাত্তর। মাঝে ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, অসহযোগ আন্দোলন—আরো কত কী! এরই প্রেক্ষাপটে ৭ই মার্চ। একটি জাতি যখন একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, ঠিক তখনই সেদিনের রেসকোর্স ময়দানে লাখো বাঙালির সামনে পরাধীন বাংলাদেশে তার শেষ জনসভায় উপস্থিত হন বঙ্গবন্ধু, রচিত হয় ৭ই মার্চের মহাকাব্য।

এই ভাষণের আগে-আগে বঙ্গবন্ধু নানামুখী চাপের মধ্যে ছিলেন। চাপ যেমন ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার, তেমনি উলটো চাপও ছিল প্রচণ্ড রকমের পাকিস্তানি জান্তার দিক থেকে। সেদিন বঙ্গবন্ধু অসুস্থ ছিলেন। তিনি যখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে রেসকোর্সের উদ্দেশে রওনা হন, জ্বরে তখন তার গা পুড়ে যাচ্ছিল। গাড়িতে ওঠার আগে আগে বঙ্গমাতা তাকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি নিজে যা ঠিক বলে বিশ্বাস করেন তা-ই যেন বক্তৃতায় তুলে ধরেন।

এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছিলেন। ব্যাখ্যা করেছিলেন ছাড় দিয়ে হলেও সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে তার কতটা প্রয়াস ছিল। একই ভাষণে তিনি প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছিলেন। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীনতা আর মুক্তি সংগ্রামের সূচনার। নির্দেশ দিয়েছিলেন আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আর যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে।

এই ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক এই যে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে শুধু একটি স্বাধীন পতাকা আর নতুন মানচিত্রের নির্দেশনাই দেননি, বরং তার নির্দেশ ছিল এমন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার, যে বাংলাদেশ বাঙালির রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতাও নিশ্চিত করবে। তাই তার ঘোষণা ছিল, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ স্বাধীন বাংলাদেশে তার ক্ষণস্থায়ী শাসনকালে বঙ্গবন্ধু সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। আর এখন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছেন তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।

আরো বৃহত্তর পরিসরে ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের শোষিত, পরাধীন মানুষের পূর্ণাঙ্গ মুক্তির নির্দেশনাও বটে। যে কারণে ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ইউনেস্কো বলেছে যে এই ভাষণের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা আর মানবিকতা। যে কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণ সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী। ঠিক একই কারণে নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করেছে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আর ৭ই মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে জ্যাকব ফিল্ডের বিশ্বসেরা ভাষণগুলোর সংকলনগ্রন্থ ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস :দ্য স্পিচ দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি’তে। আর ঠিক সেই একই কারণে নির্মলেন্দু গুণ যখন লেখেন, ‘...গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখন তিনি অমরত্বের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হন।

লেখকঃ চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

প্রকাশঃ দৈনিক ইত্তেফাক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত