9778
Published on মার্চ 16, 2020আগামী ১৭ মার্চ ২০২০ মঙ্গলবার বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশতবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিব নামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। চার বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। শতবর্ষ পূর্বে পরাধীনতার নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে মুক্তির প্রভাকর রূপে জন্ম নেওয়া ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি শিক্ষা-দীক্ষা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী, মহত্তম জীবনবোধ সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার চিরায়ত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আবেগ-অনুভ‚তি শিশুকাল থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজ জীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা পীড়ন দেখে চরমভাবে ব্যথিত হতেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সম্প্রীতির সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িক চেতনার। কিশোর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। তিনি সারাজীবন এদেশের মাটি ও মানুষের অধিকার আদায় ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য জীবনের ১৪টি বছর পাকিস্তানি কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্টে বন্দি থেকেছেন, দুই বার ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু আত্মমর্যাদা ও বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কখনো মাথা নত করেননি, পরাভব মানেন নি।
দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গঠন করেন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪- এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২- এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬- এর ছয়-দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বঙ্গবন্ধুর সাহসী, দৃঢ়চেতা, আপোষহীন নেতৃত্ব ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে জেগে ওঠে শত বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি। মুক্তির অদম্য ¯পৃহায় উদ্বুদ্ধ করে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। অত:পর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন-
‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘোষণার পর দেশজুড়ে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদ্বয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।
বাংলা বাঙালি বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। মুক্তিকামী মানুষের স্লোগানের নাম শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির চেতনার ধমনীতে প্রবাহিত শুদ্ধতম নাম শেখ মুজিব। তিনি চিরন্তন- চিরঞ্জীব; বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে অবিনাশী চেতনার নাম শেখ মুজিব। তিনি বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহানায়ক, পরাধীনতার শৃক্সখল মুক্তির মহান পথপ্রদর্শক, আবহমান বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ। তিনি বাঙালির অসীম সাহসীকতার প্রতীক- সমগ্র বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর।
বাঙালি ও বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালজয়ী নাম। বিশ্ববাঙালির গর্ব, মৃত্যুঞ্জয়ী মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বাঙালি মানসে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির নির্মাতা। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বিশ্বাসঘাতকদের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। পরবর্তীতে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী বঙ্গবন্ধুর খুনি স্বৈরশাসক স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার বিকৃত ইতিহাস ও মূল্যবোধের বিস্তার ঘটানোর পাঁয়তারা চালায়। খুনিরা ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক-স্বৈরাচার তিন দশক ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শেখাবার অপচেষ্টা চালায়। খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির অনির্বাণ হয়ে প্রজ্বলিত থেকেছে প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতির অবিভাজ্য সম্পর্কের কোন পরিসমাপ্তি নেই। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু সাম্য, মৈত্রী, গণতন্ত্রসহ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন বিশে^র নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দূত- স্বাধীনতা ও শান্তির প্রতীক। বাংলা ও বাঙালি যত দিন থাকবে, এই পৃথিবী যত দিন থাকবে, পৃথিবীর ইতিহাস যত দিন থাকবে তিনি একইভাবে প্রজ্জ্বলিত হবেন প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে, প্রতিটি মুক্তিকামী, শান্তিকামী, মানবতাবাদী হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন চিরকাল বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে- পথ দেখাবে। বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের কালজয়ী এ মহাপুরুষকে চিরকাল স্মরণ করবে। কবির ভাষায়-
‘‘যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা
গৌরী-মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।’’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অনন্য মাইলফলক-স্পর্শকারী ও অভাবনীয় ঘটনা। বাঙালির আদর্শ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমান প্রজন্মের মন-মননে চিন্তা-চেতনে আদর্শ-অনুপ্রেরণে চেতনায়-জাগরণে প্রদীপ্ত শিখারূপে প্রবাহমান। ক্ষণজন্মা এই মহামানবের স্বপ্নের উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁরই নির্দেশিত পথ ধরেই এগিয়ে যাবার দৃপ্ত শপথে বাঙালি জাতি আজ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা, বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা প্রত্যয় ও প্রত্যাশার বিশ্বস্ত ঠিকানা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এমন একটি সময় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ’ বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে। বিশ্বজুড়ে বাঙালি জাতির কাছে এক নবজাগরণের বারতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু যেন ফিরে এসেছেন তার প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিশ্বব্যাপী বাঙালি জাতিকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।