বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞান ভাবনা ও ডিজিটাল বাংলাদেশ

5023

Published on মার্চ 2, 2020
  • Details Image

ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদঃ

মুক্তিযুদ্ধের পর বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে দেশকে উত্তরণের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রথমেই প্রজাতন্ত্রের জন্য রচনা করেন সংবিধান। রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত এই দলিলেও তার দেশ গঠনে প্রগতিশীল চিন্তার ছাপ ও দর্শন প্রতিফলিত হয়। স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবায়ন করেন। ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কোনো রিজার্ভ ছিল না। চারদিকে শুধু রোগশোক ও হাহাকার। আন্তর্জাতিকভাবেও চলছিল নানা সংকট। এরপরও বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বের কল্যাণে দেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। সীমিত সম্পদ নিয়েই তার শক্তিশালী এবং অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বের গুণে এ দেশের মানুষও আস্থাশীল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য জাতির পিতা বেশিদিন সময় পাননি। তবে এই অল্প সময়েই তিনি সরকার ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক কিছু শুরু করেছিলেন এবং সেসবের ভিত্তিও রচনা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনে উচ্চশিক্ষাকে গুরুত্ব দেন। প্রাথমিক থেকে শুরু করে কারিগরি শিক্ষার প্রতিও সমভাবেই গুরুত্ব দেন তিনি। ১৭৬০ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিস্কারের মাধ্যমে বিশ্বে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটে। পানি আর বাষ্পের ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি; এর মধ্য দিয়ে এক নতুন যুগে প্রবেশ করে বিশ্বসভ্যতা।

দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাব হয় বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের মাধ্যমে। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গণউৎপাদন শুরু হয়। ইলেকট্রনিক্স আর তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ট্রানজিস্টর আবিস্কারের পর শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ১৯৬০ সালে ইন্টারনেটের আবিস্কারের ফলে বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হয় নতুন উন্মাদনা। তৈরি হয় নিত্যনতুন কর্মকাণ্ডের, নতুন গতি পায় বৈশ্বিক অর্থনীতি। স্বাধীনতার পর পাট ও চিনিকল এবং টেক্সটাইল কারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটি ছিল ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত। এর প্রাথমিক ফলাফলও ছিল সত্যিই চমকপ্রদ। স্বাধীনতার প্রথম বছরের মধ্যেই দেশের পাটকলগুলো তাদের সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করতে শুরু করেছিল। মানবসভ্যতার তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে প্রবেশের এক দশক পরই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম। এ সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রধান শক্তি বা হাতিয়ার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্যোগী হন বঙ্গবন্ধু। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে, সে উদ্যোগও নেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তাঁর দুটি উদ্যোগ ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয়। এর একটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে (আইটিইউ) বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ এবং অন্যটি হচ্ছে, বেতবুনিয়ায় ভূউপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন। তার প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আইটিইউর সদস্যপদ পায়। আইটিইউ স্যাটেলাইট অরবিট বা ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিমালা তৈরি এবং এর বরাদ্দে সহযোগিতা দেওয়া ও সমন্বয়ের কাজ করে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এই কেন্দ্রের মাধ্যমে সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, হংকং, ওমান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছে।

পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। এটি কালক্রমে হয়ে উঠেছে মানবসভ্যতায় অনন্য এক হাতিয়ার; যা উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করায় দারুণভাবে শক্তি জোগায়। শিল্প কারখানার পরিসর বাড়ায় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এটা উপলব্ধি করেই এসব উদো্যাগ নেন, যা খুবই বাস্তবসম্মত ও যুগোপযোগী। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ভিত্তি রচিত হয়। সর্বোপরি ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়ার পথ সুগম হয়। বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এই বিপ্লবটি হবে মূলত ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটির মতো বিষয়গুলোর মাধ্যমে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, নিজে চলা গাড়ি, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, শক্তি সঞ্চয় কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশের যে বীজ বপন করেছিলেন, তার কন্যার নেতৃত্বে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর স্থপতি হিসেবে রয়েছেন তারই দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন ডিজিটালনির্ভর। এ অবস্থায় জি-২০ভুক্ত দেশে যখন ডিজিটাল অর্থনীতির আকার ২০১৬ সালেই ৪.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের জরিপ অনুসারে) ছাড়িয়েছে। আর গুগলের রিপোর্ট অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় ডিজিটাল অর্থনীতির আকার ২০১৮ সালের ৭২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে গত সাত বছরে ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হতে যাচ্ছে।

২০১৫ সালেই বিশ্বে স্পেস অর্থনীতির আকার ৩৩৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়াও বেশ সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাকে হত্যার পর অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রযুক্তির উন্নয়নে দেশে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৯২-৯৩ সালে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে সাবমেরিন কেবল লাইনে অর্থাৎ সাউথ ইস্ট এশিয়া-মিডল ইস্ট-ওয়েস্ট এশিয়ায় (সিমিইউই) সংযুক্ত করার একটি সুযোগ আসে। তবে তৎকালীন সরকার তা করতে দেয়নি। ফলে দেশ পিছিয়ে যায় ১৪ বছর। সেই সাবমেরিন কেবল লাইনে আমরা যুক্ত হই ২০০৬ সালে। সেই হিসাবে বলা যায়, তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় বিশ্বব্যাপী যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নবীনতম আবিস্কার কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার তুঙ্গে, তখন ঢেউয়ের অনেক দূরে অবস্থান করে বাংলাদেশ। আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তবে প্রকৃত এটা দৃশ্যমান হয় শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর। ১৯৯৮-৯৯ সালের বাজেটে শেখ হাসিনা কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক্ক ও ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেন, মোবাইল ফোনের একচেটিয়া ব্যবসা ভাঙেন। পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে সচল করেন। ওই সময়ই দেশে প্রোগ্রামার তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রপ্তানির উপায় উদ্ভাবনের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার উদ্যোগ নেন; কিন্তু পরের সরকার তা বাতিল করে দেয়। ২০০৮ সালে দেশবাসীকে 'ডিজিটাল বাংলাদেশে'র স্বপ্ন দেখান বঙ্গবন্ধুকন্যা। ২০০৯ সালের শুরুতেই সরকার গঠন করে ঘোষণা করেন ভিশন-২০২১ ও ২০৩১। উন্নয়নকে টেকসই করতে ভিশন-২০৪১ এবং শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান-২১০০-এরও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ভিশন-২০২১-এর মূল উপজীব্য 'ডিজিটাল বাংলাদেশ'। এর বাস্তবায়নে বিগত ১১ বছরে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই ঠিক ৪৩ বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ১৯৮টি দেশের মধ্যে ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে জায়গা নিল লাল-সবুজের এই দেশটি। ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর স্যাটেলাইটটি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশনসহ সম্প্রচারমাধ্যম এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে।

আমরা যেহেতু উন্নত বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে, সে ক্ষেত্রে আমাদের এ সংক্রান্ত দক্ষ জনবলও গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের আইসিটি বিভাগ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এই সুযোগটি আমাদের তরুণরা নিতে পারেন। বঙ্গবন্ধু পথ দেখিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদর্শিতা ও চিন্তাশক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারে, সে জন্য নিয়েছিলেন নানা পদক্ষেপ। আজ তিনি থাকলে অনেক আগেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল বিপ্লবের সুফল ঘরে তুলতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু তা নানা বাধার মুখে পড়ে। শেষ পর্যন্ত নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তাঁর স্বপ্ন অনুযায়ী বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করছেন শেখ হাসিনা। সরকার ২০২০-২১ সালকে 'মুজিববর্ষ' ঘোষণা করেছে। বর্ষটি উদযাপনে থাকছে দেশ-বিদেশে নানা অনুষ্ঠানমালা। এই সময়ে আমাদের উচিত হবে তার আদর্শে দেশের কল্যাণে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। এর মাধ্যমে দেশ হবে সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ। তবেই তার প্রতি সম্মান জানানো হবে।

বঙ্গবন্ধু প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন বাস্তববাদী নীতিনির্ধারক। তিনি বাস্তবতার নিরিখেই দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছিলেন। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের যে স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেখিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এই অভিযাত্রায় এগিয়ে যেতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বোপরি ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ডিজিটাল অবকাঠামোর জন্য বড় উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বিরাজমান বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। দেশ এখন বিনিয়োগের অন্যতম গন্তব্য। হাইটেক পার্ক

তৈরি করা হচ্ছে, নির্মিত হচ্ছে অত্যাধুনিক ল্যাব। যেখানে বিনিয়োগে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আকৃষ্ট হচ্ছে। এভাবেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিনিয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র। গড়ে উঠবে সত্যিকারের সোনার বাংলা।

লেখকঃ উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

প্রকাশঃ দৈনিক সমকাল (০৩ মার্চ, ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত