2264
Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2020অজয় দাশগুপ্ত:
বাংলা ভাষা (বাঙলা, বাঙ্গলা, তথা বাঙ্গালা নামগুলোতেও পরিচিত) একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা। মাতৃভাষীর সংখ্যায় বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের চতুর্থ ও বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। বাংলা সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তথা সরকারি ভাষা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রধান কথ্য ভাষা বাংলা। এছাড়া ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, ওড়িশা রাজ্যগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাভাষী জনগণ রয়েছে। ভারতে হিন্দির পরেই সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা বাংলা। এছাড়াও মধ্য প্রাচ্য, আমেরিকা ও ইউরোপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাভাষী অভিবাসী রয়েছে। সারা বিশ্বে সব মিলিয়ে ২৬ কোটির অধিক লোক দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ব্যবহার করে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং ভারতের জাতীয় সংগীতও বাংলাতে রচিত।
এমন গৌরবময় ইতিহাসের ধারক একটি জাতির তারুণ্য শুদ্ধ বাংলা জানে না, বলতে পারে না, লিখতে পারে না—এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? এর কারণগুলো কি আমরা খতিয়ে দেখেছি আদৌ? আজ দেশের নতুন প্রজন্মে বাংলা ভাষার বিকৃতি ভয়াবহ। কাউকে যদি আপনি প্রশ্ন করেন—কোথায় যাচ্ছে বা কেমন আছে—তারা উত্তর দেয় : দৌড়ের ওপর আছি। এর মানে কী? ইংরেজি অন দ্য রান আর দৌড়ের ওপর আছি কি সমার্থক? সম্বোধনে ঢুকে গেছে ইংরেজি। হাই হ্যালো ছাড়া কেউ কাউকে সম্বোধনই করে না। ফেইসবুক টুইটার কিংবা প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চয়ই দরকারি। আমরা আধুনিক হব, উত্তরোত্তর এগিয়ে যাব—এটাই চাওয়া; কিন্তু মাতৃভাষাকে অমর্যাদা করে বা এড়িয়ে তা কীভাবে সম্ভব? নতুন প্রজন্মকে দোষ দেওয়ার আগে আমাদের নিজেদের চেহারা দেখা দরকার। এই প্রবণতার পেছনে নাটকের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ঢাকার নাটকে হঠাত্ আঞ্চলিক ভাষার নামে ডাইরেক্ট কে ভাষা বলার শুরু বিস্ময়কর। মানুষ বাংলাদেশে এক এক জেলায় এক এক উচ্চারণ আর পরিবর্তিত বাংলায় কথা বলেন। চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালীর কথা বোঝাই অন্য জেলার মানুষের জন্য কঠিন। মূলত অন্যরা চট্টগ্রামের ভাষাই বোঝে না। সেখানে আচমকা ঢাকার ভাষা জাতীয় ভাষা মনে করার কারণ বোধগম্য না; কিন্তু তার প্রকোপ এখন এমনই যা অস্বীকার করা যাবে না। বরং আগামীর জন্য তা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আকাল রোধে ভাষার পরিচর্যা আজ জরুরি। কারণ আজকালকার জনপ্রিয় তরুণ-তরুণী লেখকরাও প্রমিত বাংলায় লিখছেন না। মাঝে-মধ্যে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি—আমরাই কি পশ্চাত্পদ না আমরা অনাধুনিক? কিন্তু দুনিয়া দাপিয়ে বেড়ানো ভাষাগুলোর দিকে তাকালে আমার ভাবনা উত্তর খুঁজে পায়। ইংরেজি স্প্যানিশ কিংবা আরবি তো বিকৃত না। হিন্দিও না। আমরা যত গালমন্দ করি না কেন হিন্দি তার আপন মহিমায় আছে এবং উলটো আমাদেরও পাকিস্তানের বাস্তবতাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তার এই আগ্রাসন যতটা ভাষাভিত্তিক ততটাই বিনোদননির্ভরতার কারণে। ফলে আমাদের উচিত নিজেদের বিষয়গুলোর দেখভাল করা। অপরের ভাষা ও সংস্কৃতি কেন কি নিচ্ছে তার চেয়ে জরুরি ঘরের তালা ঘরের চাবি ঠিক রাখা। বাংলা ভাষা ঢাকায় একদিকে যেমন তার গৌরবে বাড়ন্ত আরেকপ্রান্তে হতাশ আর দিকভ্রান্তদের হাতে আছে বিপদে। এটা মনে রাখা দরকার প্রমিত ভাষা একদিনে তৈরি হয়নি। বহু মনীষার বহু চেষ্টার ফল আজকের এই রূপ। আমরা কি বাংলাকে আরো শ্রীবৃদ্ধির দিকে নেব না তার শরীরে আঁচড় কাটতে দেব? এই মীমাংসার দায় বুদ্ধিজীবী ও অগ্রসর মানুষের। আজ নানা কারণে তারা আগের মতো সরব না; কিন্তু তারাই পারেন তারুণ্যকে বাঁচাতে।
প্রায় সত্তর বছর আগে আমাদের অগ্রজেরা প্রাণ দিয়ে যে ভাষা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তার দান অপরিসীম। তার মূল্যায়ন করেছে সময়। আমাদের তারুণ্য আজ যে স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়িয়ে মাতৃভাষায় মাকে মা ডেকে আনন্দ করে, দুঃখে কাতর হয়, যে ভাষায় ভালোবাসে তার জন্য হলেও ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আর প্রয়াতদের জন্য ভালোবাসা রাখা চাই। এমনিতেই নানা বিষয়ে আমরা একটি অকৃতজ্ঞ জাতি। আমাদের কৃতজ্ঞতা বোধ আর সুধী সমাজের মিলনেই বাংলাদেশের উজ্জ্বলতার বহিরাঙ্গিক রূপ মূর্ত করতে পারে আমাদের ভাষা। এমন সুললিত মধুর ভাষায় জন্ম নেওয়া সৌভাগ্যের। তারুণ্যকে মনে করিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার খুব কম ভাষায় এত গুণী এত মেধাবী মানুষ জন্মেছেন। মেধায় থইথই করা বাংলা বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের আজীবনের অহংকার। বাঙালি বলে লজ্জা নাই বরং তা গৌরবের।
লেখক :সিডনি প্রবাসী লেখক