2452
Published on ফেব্রুয়ারি 18, 2020ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ একটি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। কারণ তারা অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। তা ছাড়া প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে ছিল। আওয়ামী লীগের উভয় প্রার্থীই রাজনৈতিকভাবে পরিপকস্ফ ও অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ইমেজের। শেখ ফজলে নূর তাপস তিনবার সংসদ সদস্য ছিলেন। অন্যদিকে, আতিকুল ইসলাম এক বছরের কম সময় হলেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। অন্যদিকে, বিএনপিও বয়সে তরুণ ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের প্রার্থী নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল। তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন তরুণ হলেও উভয়েই রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। একটি কথা আবারও প্রমাণ হলো, স্থানীয় বা জাতীয় যে কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রেই প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিপকস্ফতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই আমার মনে হয়েছে, ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিল। অন্যদিকে, নির্বাচনে হারার ব্যাপারে বিএনপির আগ্রহ বেশি ছিল বিধায় তারা নির্বাচনের প্রথম দিন থেকেই একটি নেতিবাচক কৌশল নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এখানে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো :কোন কারণগুলো ভোটারদের আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষে ভোট প্রদানে অনুপ্রাণিত করেছে? গত দু'মাসের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পরিবেশ পর্ববেক্ষণ করে কয়েকটি বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, যেগুলো ভোটারদের প্রভাবিত করেছে। প্রথমটি হলো, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের চলমান উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ভোটারদের আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রতি আস্থা রাখতে অনুপ্রাণিত করেছে। দ্বিতীয়ত, ভোটাররা একটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে যে, মেয়র বিরোধী দলের হলে সরকারের সহাযোগিতা কমে যাবে। ফলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ২০১৩ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে যে কয়েকটি সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা কেউই তেমন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেননি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় ও নগর সরকারের সংস্থাগুলোকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তৃতীয়ত, শুরু থেকেই বিএনপি নেতাদের নেতিবাচক কৌশল ভোটার ও বিএনপির কর্মীদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। ভোটের এক সপ্তাহ আগে একটি ইংরেজি দৈনিকে আমার একটি লেখায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম, বিএনপির এই কৌশল তাদের জন্য ক্ষতিকারক ফল বয়ে আনতে পারে। নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে আমার আশঙ্কা সত্য হলো। তাদের কার্যক্রম খুব সুনির্দিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, তারা নির্বাচনে জেতার চেয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিল। এ ধরনের মানসিকতা দলের সমর্থকদের হতাশ করেছে বিধায় তারা নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি। চতুর্থত, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ডিএসসিসি ও ডিএনসিসিতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তৎপর ছিলেন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরের কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন করার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। এ নির্বাচনের ফলাফল তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে সাহায্য করবে। এই বিষয়গুলো নির্বাচনের ফলাফলকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছে বলে আমি মনে করি।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের নির্বাচনে কূটনীতিকদের তৎপরতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। সাধারণত, আমরা জাতীয় নির্বাচনের সময় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে দেখি। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসে না। সুতরাং এ দুটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের অধিক তৎপরতা দেশের জন্য ইতিবাচক নয়। যে কারণেই কূটনীতিকরা এ কার্যক্রম পরিচালনা করুন, তা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত, যা কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সমর্থন করা উচিত নয়।
এই নির্বাচনের একটি ইতিবাচক দিক হলো, মূল বিরোধী দল সুস্পষ্টভাবে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আনতে পারেনি। এটি আমাদের দেশের নির্বাচনী পরিবেশের প্রেক্ষাপটে একটি উল্লেখযোগ্য উন্নতি। যদিও নির্বাচনের আগে ইভিএম ব্যবহারের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছিল, তবুও এটি তুলনামূলক সফলভাবে ব্যবহার হয়েছে ভোটকেন্দ্রগুলোতে। যেহেতু ইভিএমে ভোট প্রদানে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রয়োজন, সেহেতু এর মাধ্যমে ভোট কারচুপি করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। তা ছাড়া ইভিএমে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণে ফলাফল পাল্টে দেওয়া কঠিন। ভোটপরবর্তী সময়ে ইভিএম সম্পর্কে প্রধান বিরোধী দল সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে ব্যর্থ হয়েছে বিধায় বলা যায়, এ পদ্ধতি নতুন হলেও বেশ কার্যকর হয়েছে।
ভোটের দিন বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ও আশপাশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট শান্ত ছিল বিধায় নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবান জানানো যেতে পারে। তবে নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার প্রথমদিকে আইন মেনে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তা ছাড়া, নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ন্ত্রিত মন্তব্য সবাইকে হতাশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থীদের। আমি এ জাতীয় মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, নির্বাচন কমিশনের উচিত তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করা, যাতে তারা উৎসাহ সহকারে সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করে। সুতরাং সাংবিধানিক পদে থেকে দায়িত্ব পালন ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নির্বাচন কমিশনকে একটি টিম হিসেবে কাজ করা উচিত। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সদস্যদের মধ্যে যদি কোনো দ্বিমত দেখা দেয় তাহলে সেটি কমিশনের মধ্যেই সমাধান করা উচিত।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেশের উভয় রাজনৈতিক দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিএনপি যদি নির্বাচনে জিততে পারত তাহলে খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনসহ সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হতো। তবে তারা এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করল।
যদিও নির্বাচন তুলনামূলক অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, তবে ভোটার উপস্থিতির হার অত্যন্ত কম হওয়ার বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। তরুণ ভোটারদের ভোট প্রদানে অনীহা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। যদিও ঢাকার নির্বাচনে একটি দল জিতেছে এবং অন্য একটি দল পরাজিত হয়েছে; তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে উভয় রাজনৈতিক দলের উচিত এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলা।
লেখকঃ অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশঃ দৈনিক সমকাল (১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০)