4011
Published on ফেব্রুয়ারি 8, 2020১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শুধু ঢাকার স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক থেকে জানা যায়, সেদিন প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ওই কর্মসূচি পালন করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ এই প্রদেশের বর্ণভাষার আত্মনিয়ন্ত্রণের উপর খাজা নাজিমুদ্দিনের স্বেচ্ছাচারী আক্রমণের প্রতিবাদে শুধু একটা ছাত্র-হরতালের মহড়ার আহ্বান করিয়াছিল। সেই মহড়াই প্রদেশের সর্ব্বত্র শোভাযাত্রা ও সংগঠনে রূপান্তরিত হইয়াছে।’
যা-ই হোক, ৪ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলছিল ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ-দিবস পালনের প্রস্তুতি। অলি আহাদের এক লেখা থেকে জানা যায়, ৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ কর্মিশিবির অফিস ১৫০ মোগলটুলিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজনে ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে পতাকা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১২ ফেব্রুয়ারি কোনো কর্মসূচি না থাকলেও টানা তিন দিন ধরেই চলে এ কর্মসূচি, এতে টাকা খুব বেশি সংগ্রহ না হলেও পতাকা দিবসকে সামনে রেখে আরো নতুন নতুন কর্মী এসে যুক্ত হতে থাকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। সে সময় ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নাদিরা বেগম ও ডা. সাফিয়াকে। তারা দুজন তাদের বান্ধবী ও অন্যান্য ছাত্রীদের নিয়ে পোস্টার লেখার ব্যবস্থা করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভের প্রস্তুতি কেবল ঢাকা শহরে নয়, সমগ্র পূর্ব বাংলায় চলতে থাকে। ৫ ফেব্রুয়ারি নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদের জরুরি অধিবেশন হয়। এতে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আপসহীন সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ছাত্রসমাজের প্রতি আবেদন জানানো হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠানের সংবাদ দেওয়া হয়েছে। এ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত এসব বিক্ষোভের প্রত্যেকটির তারিখেরও উল্লেখ নেই। বেশ কিছু স্থানে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ টানাটানি চলে এই ধর্মঘট পালন নিয়ে। মাদারীপুরের ছাত্রছাত্রীরা ধর্মঘট ও মিছিল করে। স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয় ৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশেষ কারণে’ ধর্মঘট করতে না পেরে ৫ তারিখে ধর্মঘট আহ্বান করলে কর্তৃপক্ষ ওইদিন ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু প্রতিবাদী ছাত্রীরা পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি সাফল্যের সঙ্গে ধর্মঘট পালন করে।
প্রস্তুতিকালের এই দিনগুলোতে বরিশালের রাজাপুর নিজামিয়া হাইস্কুলের ছাত্ররা কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে এ হামিদের সভাপতিত্বে সভা করে।
নীলফামারীতে হরতাল পালিত হয়। সাধারণ জনগণ ও ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহরে মিছিল করে। খয়রাত হোসেন, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, জবানউদ্দিন আহমদ মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন। ছাত্র জাকিউল আলমের সভাপতিত্বে বিরাট জনসভা হয়। খয়রাত হোসেন ছাড়া ছাত্রনেতা সুফিয়ার, এনায়েতুর রহমান, আনোয়ার, সুফিয়া, ফিরোজা বেগম ও রাহেলা বক্তৃতা করেন।
রংপুর স্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন ও শহরে মিছিল করে। জেলার ডোমারে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ধর্মঘট ও মিছিল করে। ৭ ফেব্রুয়ারি এ এলাকার ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হরতাল পালন করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয় এবং দোকানের ঝাঁপ জোর করে খুলে দেয়। কিন্তু তার পরও ব্যবসায়ীরা হরতাল পালন করে।
নারায়ণগঞ্জে ১০ ফেব্রুয়ারি রহমতুল্লা ক্লাবে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র প্রতিষ্ঠানের মিলিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের নির্দেশ অনুসারে এখানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এখানেও কর্মপরিষদ গঠিত হয়। শামসুজ্জোহা সভাপতি ও মফিজউদ্দিন আহমদ আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। পূর্ব-পাক ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুল হক চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। আলমাস আলী, বজলুর রহমান প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সিলেটেও জেলা রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী পূর্ণ হরতাল ও এক মাইল দীর্ঘ শোভাযাত্রা এবং জনসভা করে। পাবনাতেও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ভাষার দাবিতে মিছিল করে।
নোয়াখালীর চাটখিলে স্থানীয় হাইস্কুল এমই স্কুল, জুনিয়র মাদ্রাসা ও ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্ররা পূর্ণ হরতাল ও মিছিল করে। ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষক ও জনসাধারণ মিলে জনসভা করে।
চট্টগ্রামে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এম এ আজিজের উদ্যোগে সর্বদলীয় ভাষা কমিটি গঠনের চেষ্টা চলছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও হরতাল পালনের জন্য আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশের কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক (প্রকাশ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০)