বাঙালির একক জাতিরাষ্ট্রের নির্মাতা

6018

Published on জানুয়ারি 22, 2020
  • Details Image

- অসীম সাহা

পৃথিবীতে কোনো কোনো মানুষের জন্ম হয় ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য। ইতিহাস যাকে সৃষ্টি করে না, ইতিহাস যার করতলগত হয়, তেমন একজন মানুষ, প্রকৃত অর্থে যিনি মহামানব, তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ইতিহাসে কখনও বাঙালির একক জাতিরাষ্ট্র ছিল না। একাদশ শতকে যাদের হাতে ভারতের শাসনভার ছিল, তারা কেউ বাঙালি ছিলেন না। সেন ও পালবংশের রাজারাও বাঙালি ছিলেন না। এমনকি মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলা, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলে যাকে গৌরবের সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তিনিও বাঙালি ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই হচ্ছেন সেই নেতা, যিনি প্রথম নিজেকে বাঙালি হিসেবে অধিষ্ঠিত করে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। হাজার বছরের ইতিহাসে এ এক মহাকালীন অর্জন, যার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু।

কাজটি সহজ ছিল না। টুঙ্গিপাড়ার মতো একটি অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে একদিন এক ছোট্ট খোকাই যে একটি জাতিগোষ্ঠীর পিতা হয়ে উঠবেন- এ ছিল কল্পনারও অতীত। কিন্তু নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে মুজিব ধীরে ধীরে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনের দিকেই এগিয়ে গেছেন। সেই যাত্রাপথ তাঁর জন্য অনুকূল ছিল না। পদে পদে পাকিস্তানি হায়েনারা তাঁর পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তাঁর চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু যে জীবন অথৈ সমুদ্রে ডিঙি নৌকায় পাড়ি দেওয়ার, তাকে প্রতিহত করতে পারে কে? পারেওনি। তাই জেল-জুলুম উপেক্ষা করে তিনি সগৌরবে মাথা উঁচু করে তার বিজয়ের রথকে ছুটিয়ে নিয়ে গেছেন এবং তাকে গন্তব্যে পৌঁছেই তিনি তাঁর নেতৃত্বের মহিমায় নিজেকে অভিষিক্ত করেছেন।

পৃথিবীতে অনেক নেতা তাঁদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা লাভে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এত আত্মত্যাগ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার মতো আর কোনো নেতা আছেন কিনা, সন্দেহ। একটি তর্জনী ও একটি অমোঘ কণ্ঠের স্বাধীনতার আহ্বান সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে এক মোহনায় মিলিত করে স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করার এই জাদুকরী সম্মোহন আর কোনো নেতার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি জাতির নেতা থেকে বিশ্বনেতা হয়ে উঠেছেন।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যখন বিজয় অর্জিত হয়, তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু জনমতের চাপে পাকিস্তান তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি তাঁর প্রিয় ভূমিতে ফিরে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন আলোতে ভাস্বর করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কাজ করে যেতে থাকেন। কিন্তু '৭১-এর পরাজিত শক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে স্বাধীনতার পথকে রুদ্ধ করতে চেয়েছিল, তারাই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা এবং অবকাঠামো ধ্বংসের মাধ্যমে বাংলাদেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে ব্যর্থ করে দেওয়ার সব ধরনের অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী আর্মি অফিসার খন্দকার মোশতাক ও তার দোসরদের প্ররোচনায় বঙ্গবন্ধুকে তাঁর নিজ বাড়িতেই সপরিবারে হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টি হয় বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের নির্মম ইতিহাস। সূচনা হয় এক ঘৃণ্য কালরাত্রির। তার পরের ইতিহাস শুধুই বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করার ইতিহাস। জাতির পিতাহীন একটি এতিম রাষ্ট্রের অভিধা নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে অবরুদ্ধ সময় অতিবাহিত করা। প্রকৃতপক্ষে কুচক্রীরা জাতির পিতাকে হত্যা না করলে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বিশ্বের বুকে সবচেয়ে উচ্চতায় নিজের মাথাটি তুলে রেখে গৌরবের সিংহাসনে আরোহণ করতে পারত। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য, এমন নেতাকে সপরিবারে নিহত হতে হলো। আবারও বলি, এই অপরিণামদর্শী খুনিরা নিশ্চিতভাবেই মীরজাফরের বংশধর খন্দকার মোশতাকের প্রেতাত্মা ছাড়া কিছু নয়। বেদনাদায়ক হলেও নিষ্ঠুর সত্যি এই যে, আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা সৌভাগ্যক্রমে বিদেশে থাকায় ঘাতকদের বুলেট তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তাই আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারকে পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারছি।

আগামী ১৭ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীতে সারাদেশ ও পৃথিবীব্যাপী পালিত হবে মুজিববর্ষ। গত ১০ জানুয়ারি তারই ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমরা তাঁরই জীবদ্দশায় জাতি হিসেবে তাঁর রক্তঋণ কিছুটা হলেও শোধ করার সুযোগ পেতাম। জাতির স্রষ্টাকে জানাতে পারতাম জাতিগত শ্রদ্ধা।

এই মহাকালের মহানায়ককে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ স্মরণ করবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়, আবেগ ও শোকস্তব্ধ শূন্যতায়। এক বছরব্যাপী এই কর্মযজ্ঞ বাঙালি জাতির রক্তঋণের দায়- সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই; মুজিববর্ষে সেই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখকঃ কবি ও সাংবাদিক

প্রকাশঃ দৈনিক সমকাল

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত