চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষায়

6105

Published on সেপ্টেম্বর 11, 2019
  • Details Image

বিশ্ব সভ্যতাকে নতুন মাত্রা দিতে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই বিপ্লবের প্রক্রিয়া ও সম্ভাব্যতা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে আমাদের দেশেও। এই আলোচনার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অনেক আগে হয়ে গেছে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রক্রিয়াও শুরু হয় বাংলাদেশের জন্মের আগে। তবে ২০০৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব আমাদের দেশে পড়তে শুরু করেছে। এখন আমরা স্বপ্ন দেখছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়ার।

প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব বাংলাদেশে সেভাবে পড়েনি তার বিবেচনায় বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দানের উপযোগী করে গড়ে তুলে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা বাংলাদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন, যার আইনে বলা হয়েছে এখান থেকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভিশনারি চিন্তার ফল।

বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা ডাইডেকটিক পেডাগোজিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিচ্ছি। এই ডাইডেকটিক পেডাগোজি হলো শিক্ষক ক্লাসে এসে শিক্ষার্থীদের সামনে একটা লেকচার দেন এবং শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। এই শিক্ষণ পদ্ধতি পৃথিবীতে এখন আর সেভাবে নেই। তবে আমাদের ক্লাসগুলো এখনো সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। এখনো আমাদের শিক্ষার্থীদের চার দেয়ালের মধ্যেই বসিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছি এবং শিক্ষা দিচ্ছি, যা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এখন আর নেয় না। তারা সহজ পদ্ধতির দিকে ধাবিত হয়েছে, যা বাংলাদেশে আমরা এখনো আলোচনাই করছি। আসলে আমাদের মানসিকতা এখনো গ্লোবাল হয়নি।

আমাদের কারিকুলাম এখনো পাঠ্যবই কেন্দ্রিক। আমাদের শিক্ষার্থীরা একটা বিষয় মুখস্থ করছে এবং তা পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে আসছে। এর বেশি দূর আমরা এগোতে পারিনি। অনেকে বলে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে জ্ঞান বিতরণ করা। কথাটা ঠিক, তবে সেটা তৃতীয় শিল্পবিপ্লব পর্যন্ত ছিল। বর্তমান বিশ্ব এখান থেকে বের হয়ে এসে নতুন একটি পদ্ধতির দিকে ধাবিত হয়েছে। সেটা হলো রিক্রিয়েশন অব নলেজ (জ্ঞানের পুনরুৎপাদন)। এই পদ্ধতির মাধ্যমে যে নলেজ আছে সেটাকে শিক্ষকদের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে তৈরি করবে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে আমাদের কী করতে হবে বা আমাদের কী করা উচিত ছিল? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোন দিকে নিয়ে যেতে হবে? আমরা কীভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য তৈরি করব? একটা ক্লাসে যে ক’জন শিক্ষার্থী আছে তাদের সবার অনুধাবন ক্ষমতা কিন্তু এক নয়। সব শিক্ষার্থীকে যে শিক্ষক বুঝিয়ে দেবেন সেই ধারণাও সঠিক নয়। একেকজনকে এককভাবে বোঝাতে হবে। এটাকে বলা হচ্ছে ডিফারেনশিয়েটেড লার্নিং। ডিফারেনশিয়েটেড লার্নিং ক্লাসে দেয়াটা খুবই কঠিন। তবে প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্ভব। যেমন ক্লাসের আগে একটি ভিডিও লেকচার তৈরি করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে দিলে তারা সেটা দেখে ক্লাসে আসবে। এরপর শিক্ষক দেখবেন যে কে কে বিষয়টি বুঝতে পারল আর কে কে বুঝতে পারল না। পরে তাদের নিজেদের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সুযোগ করে দেবেন শিক্ষক। এটাকে আমরা বলছি কোলাবোরেটিভ লার্নিং। কারণ সহপাঠীর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা খুব সহজে বুঝতে পারে। এখন তার সহপাঠীকে কে শেখাবে? সহপাঠীকে শিক্ষক শেখাবে অন্য ভাবে। এটাকে আমরা বলছি ফ্লিপ লার্নিং, যা ব্লেন্ডেড লার্নিংয়ের একটি অংশ। ব্লেন্ডেড লার্নিং পদ্ধতিতে ফেইস টু ফেইস যেমন থাকবে তেমনি অডিও, ভিজুয়াল অনলাইন সব থাকবে। এর একটা অংশ হচ্ছে ক্লাসের বাইরে নিয়ে যাওয়া সেটা হচ্ছে ফ্লিপ লার্নিং। এখানে শিক্ষার্থীকে অনলাইন কিংবা যে কোন ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রের মাধ্যমে উপাত্ত দেয়া হবে, যা সে ক্লাসের বাইরের সময়ে দেখে আসবে। দেখে এসে কোলাবোরেটিভ এবং পিয়ার পদ্ধতিতে আলোচনা করবে, যেখানে শিক্ষক একজন সহযোগীর ভূমিকা পালন করবেন।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কোনো মানুষ একা কাজ করতে পারবে না। তাকে সবার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সবার সঙ্গে কাজ করতে গেলে আপনি যা জানেন তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। নতুন জিনিস নিজে থেকে কীভাবে শেখা যায় আমাদের শিক্ষার্থীদের সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের অপরিচিত ভবিষ্যতের জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের তৈরি করছি না। বাংলাদেশে আমরা এখন যে প্রফেশনে আছি সেখানে আমরা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা নিয়ে সেই বিষয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করছি। এটাকে আমরা বলি ধারাবাহিক দক্ষতার উন্নয়ন। কিন্তু প্রফেশনটা হয়তো এক সময় পরিবর্তন হয়ে যাবে। প্রফেশন যেহেতু পরিবর্তন হয়ে যাবে তাই তাকে অন্য শিক্ষাও নিতে হবে এবং আগের জ্ঞান যেহেতু অনেক সময় কাজে লাগবে না তাই তাকে লার্ন, আন লার্ন এবং রি-লার্ন পদ্ধতির দিকে যেতে হবে। এই পদ্ধতিতে লার্ন হচ্ছে শিক্ষার্থী কোনো একটা বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করবে। আন লার্ন হচ্ছে সময়ের প্রয়োজনে তার শেখা বিষয়টি ভুলে যাবে এবং রি লার্ন হচ্ছে নতুন একটি প্রযুক্তি আসার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থী তা পুনরায় শিখে নেবে।

আমরা জানি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে ফিউশন অব ফিজিক্যাল, ডিজিটাল এবং বায়োলজিকাল স্ফেয়ার। এখানে ফিজিক্যাল হচ্ছে হিউমেন, বায়োলজিকাল হচ্ছে প্রকৃতি এবং ডিজিটাল হচ্ছে টেকনোলজি। এই তিনটিকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কী হচ্ছে? সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে? এর ফলে ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশন হচ্ছে, হিউমেন মেশিন ইন্টারফেস হচ্ছে এবং রিয়েলটি এবং ভার্চুয়ালিটি এক হয়ে যাচ্ছে। এখন যদি আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে চাই তাহলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সি, ফিজিক্যাল ইন্টেলিজেন্সি, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্সি, কনটেস্ট ইন্টেলিজেন্সির মতো বিষয়গুলো তাদের মাথায় প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে আমরা একজন শিক্ষার্থীকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে পারব। তবে ভবিষ্যতে কী কী কাজ তৈরি হবে সেটা অজানা। এই অজানা ভবিষ্যতের জন্য প্রজন্মকে তৈরি করতে আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করতে পারি।

এক. শিক্ষায় ফ্লেক্সিবিলিটি : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গুণগত শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে। যথাযথ যোগ্যতা, শিক্ষা, আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক, ভৌত বা ডিজিটাল যাই হোক না কেন এগুলোকে লেগো পদ্ধতিকে রূপান্তর করতে হবে, যাতে করে পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা তৈরিতে ব্যবহার করতে পারে।

দুই. শিক্ষায় স্বাধীনতা : আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে আমরা কারিকুলাম প্রণয়ন করে থাকি। এই পদ্ধতিকে আমরা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বলি। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন মানে হায়ার স্ট্যান্ডার্ড নাও হতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে তাদেরই দক্ষতার প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে নতুন কারিকুলাম পদ্ধতি ও মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে।

তিন. শিক্ষায় মানবিকীকরণ : সমাজের শিক্ষাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

চার. শিক্ষায় ব্যক্তিগতকরণ : প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মেধা, যোগ্যতা এবং চাহিদার নিরিখে শিক্ষা দিতে হবে। যেহেতু একটা ক্লাসে যে কজন শিক্ষার্থী আছে তাদের সবার বোঝার ক্ষমতা এক নয়। স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন থেকে বের হয়ে আমাদের পার্সোনালাইজেশনের দিকে যেতে হবে।

পাঁচ. শিক্ষায় বিশেষায়িতকরণ : জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন কর্মসূচি এবং নতুন নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন করতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোর বিকাশে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে।

শিক্ষাব্যবস্থাকে উল্লেখিত কয়েকটা ভাগে ভাগ করতে পারলে দেশ হিসেবে আমরাও প্রযুক্তির অপ্রত্যাশিত বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে পারব। তা না পারলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ থাকবে, আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে অনেকটা পথ।

লেখকঃ উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত