3395
Published on জুলাই 23, 2019শুভ কিবরিয়া:
মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী ২৩ জুলাই ২০১৯। তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) জন্মেছিলেন এখনকার গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই। মেধাবী ছাত্র ছিলেন।
পবিত্র কোরআনে হাফেজ ছিলেন। ভালো ছাত্র হিসেবে উন্নততর শিক্ষার আশায় স্কুলের শিক্ষকদের প্রেরণায় ক্রমাগত স্কুল পাল্টেছেন। পড়েছেন গ্রামের মক্তবে, নিজ বাড়ি থেকে দূরে ভুলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলে, কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি স্কুলে। পরে গেছেন কালীগঞ্জের মিশনারি স্কুল সেন্ট নিকোলাস ইন্সটিটিউশনে।
সেখান থেকে ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুল ঘুরে গেছেন সে সময়ের বিখ্যাত মিশনারি বিদ্যাপীঠ সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে। এখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গেই পাস করেছেন ম্যাট্রিকুলেশন। তৎকালীন কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৪৪ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে ১২তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রি নেন।
তাজউদ্দীন আহমদ স্কুলে থাকতেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের প্রাদেশিক রাজনীতিতে যুক্ত হন স্কুলে থাকা অবস্থায়ই। ১৯৪৩ সালেই ঢাকার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের অফিস ও সংগঠন গড়ার কাজে ব্যাপৃত হন। সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন।
যে ৪ জন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ে ঢাকার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের পার্টি অফিস গড়ে উঠেছিল, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে কনিষ্ঠতম। অন্যরা হলেন : শামসুল হক, শামসুদ্দীন ও মোহাম্মদ শওকত আলী।
ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণেই নিয়মিত ছাত্র হিসেবে যথাসময়ে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৪৮ সালে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। ইন্টারমিডিয়েটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান লাভ করেন।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে এমএলএ নির্বাচিত হন। ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পূর্ণ করে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম রাজনৈতিক সহকর্মী হয়ে ওঠেন।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের বছরই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৭১ সালে প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে স্বাধীন দেশে প্রথম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২. যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী নাম। ব্যতিক্রমী এই কারণে যে, বিশাল ক্যারিশমার অধিকারী না হয়েও শুধু সততা, দক্ষতা, নীতিনিষ্ঠা, চিন্তাশক্তির অনুশীলন, আধুনিক পঠন-পাঠন এবং সার্বক্ষণিক রাজনীতির চর্চা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অমর জায়গা দখল করে আছেন।
অন্যকে মাড়িয়ে, অপরকে ঠেলে কিংবা তোষামোদি আর নীতিহীন আনুগত্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে বড় জায়গায় উঠতে চাননি; বরং এসব পথচলতি ভড়ং আর অসততাকে অগ্রাহ্য করেই তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন।
কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছেন; তখনই সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মকুশলতা আর প্রাজ্ঞসর রাষ্ট্রনায়কসুলভ দূরদৃষ্টি দিয়ে প্রমাণ করেছেন এই ভূখণ্ডের রাজনীতিবিদের মধ্যে তিনি আলাদা।
তিনি কর্মীদের মুখে মুখে, স্লোগানে-মিছিলে উচ্চারিত জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না বটে; কিন্তু দেশে ও বিদেশে যখনই কেউ তার সংস্পর্শে এসেছেন কর্মসূত্রে, তখনই তারা তার কর্মদক্ষতা আর বিচক্ষণতার পরিচয় পেয়ে আমৃত্যু তাকে স্মরণ করেছেন।
সরদার ফজলুল করিম একবার আক্ষেপ করে লিখেছিলেন- হেগেলের দুর্বোধ্য ভাষায় ইতিহাসের দর্শন তত্ত্বের একটি পরিচিত উক্তি হচ্ছে, ‘বুদ্ধিমানেরা ইতিহাসের সঙ্গে যায়। নির্বোধকে ইতিহাস টেনে নেয়।’
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আমাদের সমকালীন সাথীদের অন্যতম সেই ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসের গতিপথকে সচেতনভাবে অনুসরণ করেছেন; যিনি ইতিহাসের সঙ্গে গেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ নির্বোধ ছিলেন না। তাজউদ্দীন আহমদ ‘বুদ্ধিমান’ ছিলেন।
৩. তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনীতি এবং আইনের ছাত্র হলেও বিশ্ব ইতিহাসের পঠন ছিল তার করায়ত্ত। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোয় তার সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করতেন এই বলে, ‘আসুন আমরা এমনভাবে কাজ করি, ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে; তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।’
তিনি নির্দ্বিধায় বলতেন, ‘মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।’
এটাই ছিল তাজউদ্দীন আহমদের অনন্য শক্তির জায়গা। আর এ জায়গায়ই তিনি ছিলেন এই ভূখণ্ডের অন্য অনেক রাজনীতিবিদের চেয়ে একদম আলাদা; হয়তো কিছুটা নিঃসঙ্গও।
৪. মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দিনগুলোয় প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে কাছ থেকে দেখেছিলেন শিক্ষাবিদ খান সারওয়ার মুরশিদ। সেই সময়ের স্মৃতিতর্পণ গ্রন্থিত আছে ‘তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা-প্রথম খণ্ড’ বইয়ে। খান সারওয়ার মুরশিদ লিখছেন-
ক. ‘আমার একটি কথা বিশেষভাবে মনে আছে, যেদিন ভারত আমাদের স্বীকৃতি দিল, ৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) ভারত যখন যুদ্ধের জন্য তৈরি, সেদিন তাজউদ্দীন কিন্তু কেঁদে ফেলেছিলেন সাংবাদিকদের সামনে। তাজউদ্দীনের সঙ্গে শেখ সাহেবের কী যে সম্পর্ক ছিল, সেটা আমি বুঝতে পারিনি।
সেদিন তাজউদ্দীন না কাঁদলে আমি খুশি হতাম হয়তো। সেদিন তাজউদ্দীন বললেন, ‘বাংলাদেশের আজ জন্ম হল। পৃথিবীর একটি প্রধান রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। এবং এই রাষ্ট্রের যিনি সত্যিকার জনক, তিনি এই দৃশ্যটি দেখার জন্য উপস্থিত নেই।
তিনি এ ঘটনাটিতে অংশ নেয়ার জন্য এখানে নেই। আজ তার অনুপস্থিতি আমি অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করছি।’
তাজউদ্দীনের চোখ দিয়ে বেশ খানিকটা জল গড়িয়ে পড়ল। দেশে যুদ্ধ চলছে, এক অর্থে তাজউদ্দীন কিন্তু সেই যুদ্ধেরও জনক। তাই বলছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর চোখ দিয়ে জল পড়বে কেন?
জল যদি থাকেই, সেটা অনুভবে থাকবে। বুঝতে পারছি তার আন্তরিকতা, নেতার প্রতি তার আনুগত্য, ভালোবাসা। এটা পরিষ্কার, তাজউদ্দীন সৎ মানুষ ছিলেন, চোখের পানি চেপে রাখতে পারেননি।’
খ. ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটা ঈদ হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের জন্য সেটা তো আর আনন্দের ঈদ ছিল না, আমাদের সবার মন তো ভারাক্রান্ত, তবু তো আমার ছোট্ট একটা সংসার ওখানে ছিল। যতদূর মনে পড়ে আমার, ঈদ উপলক্ষে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে আগের দিন রাতে তিনি আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন।
আমাকে বললেন না, কেন হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সেই আমির আলি এভিনিউর নিচতলার ফ্ল্যাটে চলে এলেন। আমি যখন এদিকে, তখন তিনি রান্নাঘরে গিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললেন এবং হাতে ক’টা টাকা গুঁজে দিলেন। এই মানবিক টাচটা তুলনাহীন।
আমার দৃঢ়বিশ্বাস, তিনি হয়তো অন্য আরও কারও কারও কথাও মনে করেছিলেন। যদিও আমাদের কারও মনে সেই যুদ্ধদিনে অনুভব ছিল না যে, ঈদ বলে কিছু আছে।
তিনি হয়তো ভাবলেন, এই মানুষগুলো তো আমার চারদিকে আছে, এদের পরিবার আছে; আমার পরিবার থেকে আমি না হয় দূরে থাকছি। এই যে একটা অনুভূতি, শত ব্যস্ততার মাঝে মানুষটি নিজে চলে এলেন, এটি আমাদের জন্য খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল।’
৫. তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এরকম হাজার হাজার ঘটনা আছে, যেগুলো প্রমাণ করে ইতিহাসের এক অনন্য মানুষ ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন ইতিহাসের ডাকে তিনি কখনও পিছপা হন না। আমৃত্যু কথা ও কাজ দিয়ে তিনি সেই সত্য প্রমাণ করে গেছেন।
আজ তার ৯৪তম জন্মবার্ষিকীর দিনে তাই তাকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
লেখক: সাংবাদিক, তাজউদ্দীন আহমদ পাঠচক্র পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম সদস্য