7423
Published on জুন 24, 2019প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে এই উপমহাদেশের একটি প্রাচীন এবং সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, একে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি প্রাচীন সুসংগঠিত দল যে দল শত আঘাতেও এই দলকে ছিন্নভিন্ন করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না, ইনশাল্লাহ।’
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শেকড় বাংলার মাটির সাথে এমনভাবে প্রোথিত, শত চেষ্টা করেও একে কেউ উপড়ে ফেলতে পারেনি। আর পারবেও না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্য ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাজ করে যাওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও এটাই মনে রাখতে হবে যে, আমাদের পূর্বসূরীরা যেভাবে আত্মত্যাগ করে গেছেন ঠিক প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে চলতে হবে।’
তিনি শৈশবের নৈতিক শিক্ষা ‘সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং’ এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘সাধারণ জীবন যাপনের মধ্যদিয়েই, ত্যাগের মধ্যদিয়েই অর্জন করা যায়। কারণ বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন মহৎ অর্জনের জন্য মহান ত্যাগের প্রয়োজন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এবং তাঁর সরকার বঙ্গবন্ধুর নীতি মেনে চলার কারণেই বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নের উচ্চ শিখরে এগিয়ে যাচ্ছে ।
প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ ভাগে এবং মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলারে উন্নীত করেছে তাঁর সরকার এবং একে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন বাংলাদেশের মানুষের কোন অর্জন হয় তখন তাঁর মৃত বাবার আত্মা শান্তি পায় বলেও নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং মোহাম্মদ নাসিম এবং অধ্যাপক মুনতাসির মামুন আলোচনা সভায় বক্তৃতা করেন।
এছাড়া, দলের যুগ্ম সম্পাদক আব্দুর রহমান ও অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহ এমপি এবং আবুল হাসনাত বক্তৃতা করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সভায় প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন।
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং তথ্য মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। এ সময় দলের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সহ দলের জেষ্ঠ্য নেতৃবৃন্দ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের একটি মানুষও যদি কষ্ট পায় আমি জানি আমার বাবার আত্মা কষ্ট পাবে। কাজেই আমাদের এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে করে এদেশের প্রতিটা মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়।’
তিনি এ সময় ভোট দিয়ে তাঁর সরকারকে নির্বাচিত করায় দেশের উন্নয়নের গতিধারাটা অব্যাহত রাখতে পেরেছেন উল্লেখ করে দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
তিনি বলেন, ‘কৃতজ্ঞতা জানাই যারা আওয়ামী লীগের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন, ভোট দিয়েছেন, নির্বাচিত করেছেন, বার বার নির্বাচিত করে তাঁদের সেবা করার সুযোগ আমাদেরকে দিয়েছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের ধারাবাহিকতা আছে বলেই এই উন্নয়ন আজকে আমরা করতে পেরেছি ।
তিনি এ সময় কোনভাবেই কোন প্রকার আত্ম অহংকারকে মনের মধ্যে ঠাঁই না দেওয়ার জন্য দলের অগণিত নেতা-কর্মীদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘আমরা অহমিকা করবো না, মাটির সঙ্গে মিশে চলবো। মানুষের সঙ্গে মিশে চলবো। কিন্তু দেশের মানুষের যেন কল্যাণ হয় এবং বাংলাদেশের মানুষ যেন আন্তর্জাতিভাবে মর্যাদা নিয়ে সম্মানের সঙ্গে চলতে পারে দেশকে আমরা সেইভাবে গড়ে তুলবো।’
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ৭০ বছরে যে সংগ্রামের ইতিহাস এবং যে অর্জন, সেই অর্জনের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ আজ উজ্জ্বল।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগের সদস্যদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন এবং সহমর্মিতার যে সম্পর্ক ছিল সেটাই আওয়ামী লীগের প্রকৃত শক্তি ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সে সময়কার কিছু স্মৃতিচারণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদককে (শামসুল হক) গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি দিনের পর দিন কারা নির্যাতন সহ্য করতে পারেননি। জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী যদি আপনারা ভাল করে পড়েন তাহলে দেখবেন শামসুল হক কিভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।
তিনি বলেন, বহুবছর তাঁর কোন খবর পাওয়া যায়নি, পরে জেনেছি তিনি নিজের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মারা যান। তবে, আমি দেখেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁকে বড় ভাইয়ের মত সম্মান করতেন।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করেন যে, মওলানা ভাসানী দল ত্যাগ করে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করলেও বঙ্গবন্ধু তাঁকে সবসময় সম্ভাব্য সবরকমের সহযোগিতা করতেন। তেমনি পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর তিনি তা অব্যাহত রাখেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মওলানা ভাসানী দল ছেড়ে চলে গেছেন। ‘কিন্তু তিনি তো বাঙালির ইতিহাসের একটা অংশ।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা-কর্মীদের ওপর বার বার আঘাত এসেছে, ১৯৪৮, ’৫২ এবং ’৫৪ সালে যখন ৯২ ক ধারা দিয়ে যুক্তফ্রণ্টের মন্ত্রিসভা বাতিল করা হলো তখন বঙ্গবন্ধুসহ সকল নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হলেন। এরপর ৫৮ সালে মার্শাল ল’ এলেও সবার আগে আঘাত আসলো আওয়ামী লীগের ওপর। প্রতিটি বার আওয়ামী লীগ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পাশাপাশি এই আওয়ামী লীগ কর্মীরাই জাতির পিতার বক্তব্যকে হৃদয়ে ধারণ করে নিজের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে জীবন পর্যন্ত দিয়ে গেছেন।
তিনি বলেন, ‘কত মানুষ (দলীয় নেতা-কর্মী) তাঁদের ঘর, সংসার পরিবার-পরিজনের কথা চিন্তাও করেননি। দেশের কথা চিন্তা করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সব থেকে বড় গুণ হলো দেশের মানুষের প্রতি তাঁদের কর্তব্য বোধ, দায়িত্ববোধ, ভালবাসা, ত্যাগ-তিতীক্ষা।’
তিনি বলেন, ‘এই এত ত্যাগ-তিতীক্ষা রয়েছে বলেই বার বার আঘাত আসা সত্ত্বেও এই দলটি ৭০ বছর টিকে আছে। স্বাধীনতার পর পরই এবং ’৭৫ এ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর যে অত্যাচার- নির্যাতন হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনাতীত।’
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের ইতিহাস যদি দেখি আমার মনে হয়না কোন রাজনৈতিক দল একটা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এতটা আত্মত্যাগ করেছে, যতটা আওয়ামী লীগ করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এতটা নির্যাতন সহ্য করেছে যা আর কেউ করেনি।
দলের ওপর বার বার শাসক গোষ্ঠীর তীক্ষè দৃষ্টি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণের জন্য কাজ করি কাজেই জনগণের অধিকার যারা কেড়ে নেয় তাঁদের একটা শ্যেণ দৃষ্টি থাকে আওয়ামী লীগের ওপর। এই দলটাকে ধ্বংস করার।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এরপর ভাঙ্গা গড়ার খেলাতো রয়েছেই। তবে, আওয়ামী লীগ এমনই একটি রাজনৈতিক দল ষড়যন্ত্রকারীরা এটাকে বারবার ভেঙ্গেছে। হিরার টুকরো যত বেশি কাটা হয় সেটার যেমন ঔজ্জ্বল্য বাড়ে, আওয়ামী লীগের বেলায় সেটাই হয়েছে।’
এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, এই আঘাতটা শুধু যে পাকিস্তান আমলেই হয়েছে তা নয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও হয়েছে। পূর্ববর্তী সরকার প্রধান বেগম জিয়াকে গ্রেফতার না করে বিরোধীদলে থাকার পরেও আমাকে আগে গ্রেফতার করা হয়, মিথ্যা মামলা দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবার আগে আঘাত আসলো আওয়ামী লীগের ওপর, আমার ওপর। দেশে আসতে দেবে না, যখন জোর করে দেশে আসলাম তখন আমাকেই আগে গ্রেফতার করা হলো।’
যতবারই ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে দলটা তত বেশি শক্তিশালী হয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘সেটা প্রমাণ হয়েছে ২০০৮ সালের নির্বাচনে।’
তিনি বলেন, ‘সাবেক সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ভোটে শতকরা ৮৪ শতাংশ ভোট পড়ে এবং খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি মাত্র ২৯টি আসন লাভ করে। অর্থাৎ জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা সেবারই তারা হারিয়েছিল।’
তিনি বলেন, বিএনপি’র দুর্নীতি, খালেদা জিয়ার এতিমের অর্থ আত্মস্যাৎ, মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও বাংলাভাই সৃষ্টি, সারাদেশে একযোগে ৫শ’ স্থানে বোমা হামলা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, সংসদ সদস্য শাহ এএমএস কিবরিয়া এবং আহসানউলাহ মাষ্টার হত্যাকান্ড, হাওয়া ভবন খুলে দুর্নীতি এবং মানুষের সম্পদ লুট করে খাওয়া, স্বজনপ্রীতি এবং তাঁদের দুঃশাসনে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর আওয়ামী লীগ সরকারে আসলে দেশের উন্নতি হয়, বাংলার মানুষ কিছু পায়- যেটা প্রমাণিত সত্য।
গত ১০ বছরে বাংলাদেশের চিত্র বদলে গেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দারিদ্র্যের হার আমরা ৪০ ভাগ থেকে ২১ ভাগে নামিয়ে এনেছি এবং ঘোষণা দিয়েছি অনেক উন্নত দেশে যেখানে ১৭/১৮ ভাগ দারিদ্র্য রয়েছে তার থেকে অন্তত একভাগ বেশি হলেও আমরা দারিদ্র্য কমিয়ে আনবো।’
শেখ হাসিনা দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘সেই বাংলাদেশে তখন হত দরিদ্র বলে কিছু থাকবে না। কারণ দেশের মানুষের কল্যাণ করাই আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য।’
এদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন সুন্দর এবং উন্নত জীবন পায় তা নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করবো, ২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হবে। আর ২০৭১ সালে আজকের প্রজন্ম উদযাপন করবে স্বাধীনতার শতবর্ষ। যে জন্য আমরা শতবর্ষ মেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান করেছি।’
তিনি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলের সকল নেতা-কর্মীকে মুজিব আদর্শে আদর্শবান কর্মী হিসেবে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাওয়ার আহবান জানান।