জনহৃদয়ে প্রোথিত আওয়ামী লীগ

3333

Published on জুন 23, 2019
  • Details Image

ড. এম এ মাননানঃ

বিশ বছরের অধিক সময় ধরে সামরিক আর স্বৈরশাসকদের মাইনাস ফর্মুলার শিকার জনহৃদয়ে প্রোথিত বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ফিনিক্স পাখির মতোই জেগে উঠেছে আর একই সঙ্গে জাগিয়ে দিয়েছে সারা বাংলাদেশ। জাতি মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে যে রাজনৈতিক দলটি সেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন থেকে যুগে যুগে বাঙালি জাতির নেতৃত্ব দিয়েছে, ঘোর অমানিশার মাঝে আলোর পথ দেখিয়েছে, উড়িয়েছে স্বাধীনতার ঝাণ্ডা, নির্যাতিত-নিষ্পেষিত জনতার ভরসা হিসেবে যুগে যুগে পাশে দাঁড়িয়ে ইতিহাস রচনা করেছে, তার নামই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ সংগঠনটির রয়েছে লড়াই, সংগ্রাম, রক্তস্নাত রাজপথে অনড় অবস্থান, ত্যাগ আর গৌরবের বর্ণাঢ্য ইতিহাস।

ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ ভাগ ও পাকিস্তান শাসনামলের শুরুর সময়ে বিদেশি প্রভুতোষণ ও পদলেহনকারী, অথর্ব, লোভী রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র বিশ্লেষণ থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়কার গভর্নর জেনারেল অগ্নি-উপাসক পার্সি মায়ের সন্তান মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, সামন্ত প্রভুদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী, জমিদারদের প্রতিনিধিত্বকারী পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আহমেদরা পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে একটি প্রজা-নিপীড়ক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল।

এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জনসমর্থিত একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ছিল ঐতিহাসিক প্রয়োজন। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ গড়ে না উঠলে আমরা বাঙালি জাতি সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়তাম শত শত মাইল দূরে। অতীতের মতো জেল-জুলুম, অন্যায়, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনাই জুটত আমাদের নিয়তিতে।

এমনি এক পরিস্থিতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর এমকে দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য বুঝতে সক্ষম হয় এ দেশের সব শ্রেণির মানুষ। সে সময় জেলে বসেই আন্দোলনের ছক কষেন অভূতপূর্ব দূরদর্শী আজকে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই বছরেই তিনি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর মার্শাল ল’ বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়, ’৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনসহ নয় মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব লড়াই-সংগ্রাম আর বীর বাঙালির অর্জনে আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১-এ ৩০ লাখ শহীদ আর অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম হাল ধরেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সুমহান ঐতিহাসিক নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশই ঘটায়নি, অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের বিরুদ্ধে করেছে নিরলস লড়াই।

জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল, স্বাধীন এ দেশ মাথা তুলে দাঁড়াবেই একদিন। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট একদল স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধু ও তার দুই কন্যা ব্যতীত পরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান তারা।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে তার স্বপ্নে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ। দেশজুড়ে গণহারে গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। প্রাচীন এই সংগঠনকে ভেঙে ছিন্নভিন্ন করতে নানা কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র চালায় পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী। শত শত মিথ্যা মামলার জালে জড়ানো হয় প্রবীণ ও নেতৃত্বদানকারী নেতাদের। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলায় সৃষ্টি করা হয় সেনানিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ধারার। আর সুকৌশলে চালানো হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা।

১৯৮১ সালের ১৭ মে আবেগ-আশ্রয়ী বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। মূলত সেদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বুননে নতুন করে হাল ধরেন শেখ হাসিনা। মাঝপথে এসে থমকে যাওয়া আওয়ামী লীগ আবারও যেন নতুন প্রাণ পায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে শেখ হাসিনা পা রেখেছিলেন। এর আগেও কয়েকবার বিদেশের মাটি থেকে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন তিনি।

এ দিনটা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ, অনন্য একটা দিন। অস্থির বাংলাদেশে তখন বাঙালি জাতি ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের দখলদারি ও জবরদস্তি শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট, বুটের তলায় স্তব্ধ তাদের অধিকার। অবরুদ্ধ ছিল বাকশক্তি। বাংলাকে পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত পেয়ে বসেছিল পাকিস্তানপ্রেমী শাসকচক্রের। সেদিন দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বপ্নের সোনার বাংলা পাননি শেখ হাসিনা।

পাহাড়সম বাধা আর পথের বাঁকে বাঁকে বিছানো ছিল বিরুদ্ধাচরণ-বিপত্তির কাঁটা। এ কাঁটার ভয় উপেক্ষা করে তিনি ফিরেছিলেন বাংলায়, সমবেত হয়েছেন জনতার কাতারে। মানুষের ভালোবাসা ও আস্থার ওপর ভরসা রেখে তিনি সব ঝুঁকি উপেক্ষা করেছিলেন সেদিন। ভালোবাসা, আবেগের বিবেচনায় এ দিনটি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে যেমনটি স্মরণীয়, তেমনি মুক্তিকামী বাঙালির ইতিহাসে ১৭ মে দিনটি নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। দীর্ঘ বিরতির পর ওইদিন থেকে আবারও যেন হাঁটা শুরু করে আওয়ামী লীগ।

বঙ্গবন্ধুর দুই যুগ আর তার কন্যা শেখ হাসিনার প্রায় তিন যুগের বেশি সময় ধরে লালন করা আজকের আওয়ামী লীগ একটি পরিপূর্ণ আদর্শ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বাংলার জনগণের অন্তরে প্রোথিত ও রাজনীতির মূল ধারার ধারক-বাহক আওয়ামী লীগের সফল নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক, এগিয়ে যাবে বহুদূর।

ড. এম এ মাননান : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত