মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে গড়িমসি করছে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

5094

Published on জুন 10, 2019
  • Details Image

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তাঁদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মিয়ানমার গড়িমসি করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশংকা ব্যক্ত করেছেন, এখানে কর্মরত আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোও সমস্যাটি জিইয়ে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের সাথে চুক্তি করেছি, সবরকম উদ্যোগও নিয়েছি এবং তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগও রাখছি। কিন্তু তাঁদের সাড়াটা পাইনি, সেটাই সমস্যা। মিয়ানমারই আগ্রহী নয়। আর এত লোক রাখা আসলেই সমস্যা।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে একথা বলেন।

গত ২৮ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর জাপান, সৌদি আরব এবং ফিনল্যান্ড সফর নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলেও রোহিঙ্গাদের সফল প্রত্যাবাসন, জঙ্গি ইস্যু এবং বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা সহ সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গ সাংবাদিকদের প্রশ্নে উঠে আসে। সকল প্রশ্নের অনুপুঙ্খ উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিদেশি সাহায্য সংস্থার কর্মকান্ড নিয়ে আশংকা ব্যক্ত করে বলেন, ‘সমস্যা যেটি আমি এখানে দেখি যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা এখানে ভলান্টিয়ারি সার্ভিস দিতে আসে বা যারা কাজ করে এরা কোনদিন চায় না যে, কোন রিফিউজি তাদের দেশে ফেরত যাক। এখানেই সমস্যাটা।’ শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমরা পৃথকভাবে চিন, ভারত এবং জাপানের সঙ্গে কথা বলেছি এবং এরা প্রত্যেকেই এটা মেনে নেন যে, এরা মিয়ানমারের নাগরিক এবং এদের প্রত্যেকেরই মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া উচিত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চুক্তি করলাম, তালিকা করলাম, তারপরে হঠাৎ এরা (রোহিঙ্গা) আন্দোলন করলো-এরা যাবে না। এই আন্দোলনের উস্কানিটা কারা দিল। আরেকটা হচ্ছে- তাদের সবসময় একটা ভয় সেখানে তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী গিয়ে দেখে এসেছেন সেখানে রাখাইন স্টেটে এখনো কিছু পরিবার অবশিষ্ট রয়েছে। কিন্তু, মূলত এই সংস্থাগুলি এরা কখনো চায়না যে রোহিঙ্গারা ফেরত যাক,’যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এখানে বিরাট অংকের ফান্ড আসে, সেখানে তারা চাকরী-বাকরী করছেন তারা চলে গেলেতো আর সেটা থাকবে না। তাছাড়া কেনই বা এটা হবে। মুশকিলটা হচ্ছে মিয়ানমারকে নিয়ে তারা কোনভাবেই এদের নিতে চাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

আগামী জুলাই মাসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সামার সামিটে যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী চিন সফরে যাবেন উল্লেখ করে বলেন, ‘তারাও চায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফেরত যাক। কিন্তু মিয়ানমার এদের নিতে চায় না, এখানেই সমস্যাটা।’ অপর এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চিন এবং ভারত দুটি দেশের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্ব এবং আমরা সেই বন্ধুত্ব রক্ষা করেই চলছি।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় ভারত সফরে যাবেন বলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান। আর নরেন্দ্র মোদী তাঁকে দাওয়াত দেওয়ার প্রেক্ষিতে তিনিও তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেন তিনি।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

মন্ত্রি পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সংবাদ সংস্থার সম্পাদক এবং সিনিয়র সংবাদিকবৃন্দ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন এবং এ ব্যাপারে আমি ইতোমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছি যে, আমাদের বিজিবি যারা বর্ডার দেখে তাদের একটি অংশ, পুলিশ বাহিনী এবং সেনাসদস্যদের ক্লাষ্টার করে করে তাদের চারদিকে একটি সিকিউরিটি বেরিকেড দেওয়া, সবসময় টহলে রাখা।

তিনি বলেন, এসব রোহিঙ্গাদের ভাষাণচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে দেখা গেছে যারা এখানে ভলান্টেয়ারি সার্ভিস দিতে আসে তাঁদের আপত্তি রয়েছে।
তারা কক্সবাজারে এসে আরাম আয়েশে থাকার সুযোগ পায়, বিধায় আর সেখানে যেতে চাচ্ছেনা, সেটা নিয়েও কথা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এত সুন্দর ঘর-বাড়ি আমরা সেখানে করে দিয়েছি তার পরেও সেখানে তাঁদের নেওয়া যাচ্ছে না।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, সরকার ডেল্টা প্ল্যান (শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা) নিয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে কারও কাছে পানির জন্য মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। সেজন্য তিনি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়েও খুব বেশি চিন্তা করতে বারণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের ডেল্টা প্ল্যান নিয়েছি। নদীগুলো ড্রেজিং করে দিচ্ছি। কারও কাছে পানির জন্য মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। কারণ আমাদের বাংলাদেশ একটা ব-দ্বীপ।’

তিনি বলেন, ‘হিমালয় থেকে যে নদীগুলো আসছে, সেগুলোকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে যেতেই হবে। এখন পানি আমরা কতোখানি ধরে রাখতে পারবো, সেই ব্যবস্থা যদি করি, তাহলে পানি আমাদের চাইতে হবে না। কাজেই এটা নিয়ে বেশি চিন্তা করার দরকার নেই।’

‘বিমানের পাইলটের পাসপোর্ট বিহীনভাবে কাতারে গমন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটাতো একটা লক্ষণীয় বিষয়। কেননা যখনই বিমানে উঠি তখনই একটা ঘটনা ঘটে বা নিউজ হয়। এটা কেন হয় আমি জানি না।

তিনি এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের নজরদারি বাড়ানোর আহবান জানিয়ে জড়িতদের এবং সে সময় যারা ইমিগ্রেশনের ডিউটিতে ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

তাঁর সরকার ইমিগ্রেশন ব্যবস্থায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা ভিআপি বা ভিভিআইপি যেই হোক না কেন এরপর আর কাউকে ছাড়া হবে না। প্রত্যেকের পাসপোর্টে সিল মারা হয়েছে কিনা, তাদের চেকিং ভালভাবে হচ্ছে কি না, ভিআইভি বা ভিভিআইপি প্রত্যেকেরই লাগেজ চেক করার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি ডিপারচার লাউঞ্জে আরো কড়াকড়ি আরোপ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, এতদিন পরিশ্রম করে বিমান বহরে নতুন বিমান সংযোজন করে বিমানের অবস্থা যখন একটা পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে এবং আরো কয়েকটি নতুন রুট চালু করার চেষ্টা হচ্ছে, তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

মামলার দ- নিয়ে লন্ডনে নির্বাসনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিভিন্ন অপকর্মের খতিয়ান তুলে ধরে তার নাম মুখে নিতেও ঘৃণা হয় বলে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা হচ্ছে। আজ হোক কাল হোত তাকে শাস্তি পেতেই হবে।’

তিনি বলেন, ‘নাম নিতেই তো ঘৃণা লাগে। তাকে নিয়ে দেখি অনেকের দরদ উতলে ওঠে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা কীভাবে ভুলে যান? হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে, এতিমের টাকা আত্মসাৎকারী, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানকারী এদের জন্য মায়াকান্না করলে কিভাবে দেশে বিচার হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কথা বলছি। এত টাকা তৈরি করেছে তারা সেখানে খুব আরাম-আয়েশে আছে। আর আমি যখন যাই তখন প্রত্যেকবার এক একটা সমস্যা তৈরি করে।’

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘কে ভালো মুসলমান কে ভালো মুসলমান না সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করা বন্ধ করতে হবে। কে ভালো, মন্দ সেটার বিচার আল্লাহতায়ালা শেষ বিচারে করবেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে রক্তপাত হচ্ছে। কিন্তু লাভবান হচ্ছে অস্ত্র যারা তৈরি ও বিক্রি করছে তাদের। ওআইসিকে এটা বন্ধ করতে হবে। আমি সেখানে এই কথা বলেছি। এটা আমি বলে যাবো। জানি এতে সমস্যাও হতে পারে। তারপরও যা সত্য তাই বলবো। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করি না। আমার বাবাও করেননি।’

বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এক সময় শুনতাম কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা সন্ত্রাসী কাজ করে। এখন কী দেখি। বাপ মা সব দিয়ে দিয়েছে, উচ্চ শিক্ষিতরা এ কাজ করছে।’

ধর্মীয় বক্তারা নারীর বিরুদ্ধে কথা বলেন- এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইসলামে নারীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সেই ধর্মের লোকেরা কীভাবে নারীদের নিয়ে এসব কথা বলেন। আমি মনে করি নারীরা যত বেশি শিক্ষিত হবে, প্রতিটি জায়গায় নিজেরা অবস্থান তৈরি করতে পারবে সেটাই জবাব। এর থেকে আর বেশি কী!’

শেখ হাসিনা সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন থেকে উন্নয়নের গতি যেন কোনভাবেই ব্যাহত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার আহবান জানান।

সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে দেয়া সাক্ষাৎকারে একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে সম্পাদকের ‘যা চাচ্ছি তা লিখতে পারছি না’ এমন মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তার নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে তাদের ভালো লাগে না। তারা অন্য কোনো প্রক্রিয়া চান। অন্য কোনো প্রক্রিয়া থাকলে তারা সুবিধা পান। তিনি এখন ফরমায়েশি লেখা পান না তাই লিখতে পারেন না।’

বিশেষ কোনো সাংবাদিকের লেখার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নির্দেশনা থাকার প্রশ্নটি অবান্তর-এমন মনোভাব ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘এমন নির্দেশনা থাকলে তারা লিখে কীভাবে, কথা বলে কীভাবে!

তিনি বলেন, ‘আমি বুঝছি কার কথা বলছেন। টিভিতে সেই সম্পাদক কয়েক বছর আগে নিজেই স্বীকার করেছিলেন ডিজিএফআইয়ের দেয়া খবর তিনি যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করেছিলেন। এখন হয়ত ডিজিএফআই কিছু দিচ্ছে না তাই তিনি লিখতে পারছেন না।’

শেখ হাসিনা বলেন,‘ ওনার যা খুশি লিখুক। এদের কখনো কোনো সহযোগিতা পেয়েছি? পাইনি। কে কী লিখলো সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না।’

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত