6287
Published on মার্চ 17, 2019রামেন্দু মজুমদারঃ
বঙ্গবন্ধু, আর এক বছর পর আমরা আপনার জন্মশতবার্ষিকী পালন করব। একটা কথা জানবেন, যত দিন যাচ্ছে আপনি বাঙালির হৃদয়ে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক। আপনি যেখানে আছেন সেখান থেকে হয়তো দেখছেন, আপনার সুযোগ্য কন্যা আপনার আদর্শকে বুকে ধারণ করে বাংলাদেশকে কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আপনার অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করার জন্য, সোনার বাংলা গড়ে গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি নিরলস কাজ করে চলেছেন। আপনি নিশ্চয়ই তাঁকে আশীর্বাদ করছেন।
বঙ্গবন্ধু, শ্রদ্ধাস্পদেষু
জানি আপনার কাছে কোনো দিন পৌঁছাবে না আমার এ চিঠি। তাই আকাশের ঠিকানায় লিখে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম এ চিঠি।
আপনার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের দিন গণনা শুরু হয়ে গেল। আগামী এক বছর ধরে চলবে সেই শুভক্ষণ বরণ করার নানা আয়োজন। রবীন্দ্রনাথের বাণী কণ্ঠে ধারণ করে আমরা গাইব, ‘ওই মহামানব আসে।/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে ...এল মহাজন্মের লগ্ন।’
রবীন্দ্রনাথ আর আপনি। বাঙালির গর্বের দুই শিখর। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির অজেয় প্রতীক আর আপনি আমাদের মুক্তিদাতা, সারা জীবন সংগ্রাম করে আমাদের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে বিশ্বে আমাদের মাথা উঁচু করে চলার সুযোগ করে দিয়েছেন।
আপনার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বা ‘কারাগারের রোজনামচা’ যত পড়ি তত বিস্ময়ে অভিভূত হই। আপনার আত্মজীবনী শুধু আপনার অসমাপ্ত জীবনের নয়, বাঙালিরও অসমাপ্ত ইতিহাস। আপনি সুযোগ পেয়েছিলেন ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত আপনার জীবনের কথা, আমাদের জাতির ইতিহাসের কথা লিখে রেখে যাওয়ার। ভেবে অবাক মানি, জেলখানায় বসে কোনো নোট বা কোনো বইপত্র না দেখে স্মৃতি থেকে কিভাবে সব ঘটনাপ্রবাহ ছবির মতো একের পর এক সাজিয়ে গেলেন। আপনার পক্ষেই সম্ভব এমন কাজ করা। ফলে আমরা জানতে পারলাম আমাদের অনেক অজানা অলিখিত ইতিহাস।
একইভাবে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় কারাগারের বিচিত্র জীবনকে তুলে ধরেছেন। ভিন্ন এক জগৎ কারাগার। সেখানকার আইন-কানুন, বন্দিদের জীবনধারা আপনার দরদি মন দিয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আমাদের একটি অচেনা জগতের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছেন। সঙ্গে জানিয়েছেন ইতিহাসের কত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
আপনার আহ্বানে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আপনি শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকলেও আপনার নামে ৯ মাস ধরে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। আপনার জীবন নিয়ে সবাই উদ্বেগের মধ্যে ছিল। মনে পড়ে ভাইফোঁটার দিন পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্ত শিবিরে হিন্দু রমণীরা আপনার ছবিতে ফোঁটা দিয়ে আপনার কল্যাণ কামনা করেছে। আপনি তো জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবার আত্মার আত্মীয়। আপনিই তো ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখে গেছেন, ‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নেই। সবাই মানুষ।’
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে আপনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে এলেন, আমাদের বিজয় সম্পূর্ণ হলো। এসেই আপনি লেগে গেলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কাজে। স্বাধীন বাংলাদেশে আপনার প্রথম জন্মদিনেই উপহার হিসেবে পেলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মতো অসাধারণ ঘটনা, যা ইতিহাসে বিরল।
মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন আপনি নতুন দেশকে গড়ে তোলার জন্য। কী আশ্চর্য দূরদৃষ্টি ছিল আপনার। এখন দেখছি সব ক্ষেত্রে কাজের সূচনা আপনিই করে গেছেন। আপনি বিশ্বাস করতেন আপনাকে কোনো বাঙালি হত্যা করতে পারে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, যারা আপনাকে সপরিবারে এমন নির্মমভাবে হত্যা করল তারা তো মানুষ নয়, নরকের কীট। এমন মৃত্যু আপনার প্রাপ্য ছিল না। আমরা জাতি হিসেবে এ কলঙ্কের ভাগীদার। আশা করি আপনার উদারতা দিয়ে আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন।
মাত্র ৫৫ বছরের জীবন আপনার। কিন্তু তার মধ্যেই কী বিরাট কাজ করে গেছেন। ১৯৭৫ যদি আপনার জীবনে না আসত, আপনি যদি বেঁচে থাকতেন আমাদের মাঝে, তবে বাংলাদেশের আদলই অন্য রকম হতো। কোথায় পৌঁছে যেতাম আমরা। তা ছাড়া আপনি তো শুধু বাংলাদেশের মানুষের নেতা ছিলেন না, সারা বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের কণ্ঠস্বর ছিলেন। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সে কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিয়েছে চিরতরে।
নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলির বাইরে আপনি ছিলেন উদার, অসাম্প্রদায়িক, সংস্কৃতিমনা ও গরিবের প্রতি সহানুভূতিশীল। আমরা মুখে অনেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলি, কিন্তু জীবনাচরণে তার উল্টোটা লক্ষ করি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আপনার নির্ভীক ভূমিকা আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে রয়েছে।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তানি শাসকদের মদদে পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, থাকতাম তেজগাঁও শিল্প এলাকায় আমার বড় ভাইয়ের স্টাফ কোয়ার্টার্সে। দাঙ্গার প্রথম রাতে আমাদের বাসার পাশের রেললাইনে ট্রেন থামিয়ে কয়েকজন সংখ্যালঘু যাত্রীকে হত্যা করা হয়। তাদের আর্তচিৎকারে আমরা সহজেই বুঝতে পারি বাইরে কী ঘটছে। পরদিন সকালে আমাদের আত্মীয় অধ্যাপক অজিত গুহ আপনাকে ফোন করে জানান, আমার এক আত্মীয় পরিবার তেজগাঁওয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছে, তুমি যদি তাদের উদ্ধার করতে পারো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি আপনি আমাদের বাসায় এসে উপস্থিত। সেই প্রথম আপনাকে আমি কাছ থেকে দেখি। আমাদের বললেন, দুই মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে আপনারা আমার সঙ্গে চলুন। আপনি একটা জিপ নিয়ে এসেছিলেন, ড্রাইভারের পাশে আপনি বসলেন, পেছনে আমরা সবাই। ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন কোথাও না থামিয়ে সোজা আপনার বাসায় যেতে। জিপে যাওয়ার সময় পাশের বস্তি থেকে দু-একটা ঢিল ছোঁড়া দেখে বুঝলাম আপনি কেন ড্রাইভারকে এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৩২ নম্বরে আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখি শহরের অন্যান্য এলাকা থেকে কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবারকে আপনি এরই মধ্যে এনে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখেছেন। বেগম মুজিব পরম যত্নে সবার খাবারদাবারের ব্যবস্থা করছেন। সন্ধ্যায় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এসে আমাদের তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন।
এই যে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করা, কয়জন নেতা এ কাজটি করেন? মুখে বলা সহজ, কিন্তু কাজ করে দেখানো কঠিন। কিন্তু আপনি যা বিশ্বাস করতেন, জীবনাচরণে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি।
বিভিন্ন সময়েই আপনার জীবন ও কর্মে সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ আমরা লক্ষ করেছি। প্রায়ই আপনি ঘরোয়া আলাপ-আলোচনা বা জনসভায় বক্তৃৃতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। আপনার পড়ার ঘরে হাতের কাছেই থাকত ‘সঞ্চয়িতা’। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির ভাষা আন্দোলন স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধনীতে প্রধান অতিথির ভাষণে আপনি বলেছিলেন, ‘বাঙালির স্বাজাত্যবোধকে টুঁটি চেপে হত্যার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বারবার এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর আঘাত হেনেছে, আর তা প্রাণ দিয়ে প্রতিহত করেছে এ দেশের তরুণরা। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কয়জন আছেন? বিবেকের কাছেই তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে। আপনাদের লেখনী দিয়ে বের হয়ে আসা উচিত ছিল এ দেশের গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরসন্তান সূর্য সেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রচেষ্টাই করা হয়নি। তাঁর কথা বলতে আপনারা ভয় পান। কারণ তিনি ছিলেন হিন্দু। এঁদের ইতিহাস লেখা এবং পাঠ করার জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাই। একদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা যেত না। কিন্তু আজ এই জাতীয়তাবাদ সত্য। একে রোধ করতে পারে এমন কোনো ক্ষমতা নেই। এই প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতি একতাবদ্ধ হয়েছে। নিজেদের দাবিতে বাঙালিরা আজ ঐক্যবদ্ধ।’
সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য আপনার সহমর্মিতার দুটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করতে চাই। ১৯৭৪ সালে বন্যার সময় আমরা থিয়েটার থেকে ‘এখন দুঃসময়’ অভিনয় করে যত দূর মনে পড়ে দুই বা তিন হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিতে গেছি। আপনি খুব খুশি হয়ে আমাদের এ সামান্য দান গ্রহণ করে আমাদের অফিস প্রয়োজন কি না জানতে চাইলেন। আমরা ভাবলাম এখন নতুন দেশে সরকারের কত কিছুর প্রয়োজন, এ সময়ে আমাদের অফিসের জন্য বাড়ি না হলেও চলবে। তাই আপাতত আমাদের প্রয়োজন নেই বললাম। আপনার কত দূরদৃষ্টি ছিল। এখন দলের জন্য বা থিয়েটার স্কুলের জন্য একটা স্থায়ী ঠিকানার সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালে আপনি গেছেন রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন ভবন পরিদর্শনে। অভ্যর্থনাকারীদের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তরুণ প্রযোজক আবদল্লাহ আল-মামুন। তাঁকে দেখে আপনি দুই হাত মামুনের গালে ধরে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, কি তোমাদের নাটক কেমন চলছে? সে সময়ে কিন্তু প্রমোদ কর ও সেন্সরশিপের আইন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করার ফলে ঢাকায় নিয়মিত নাট্যচর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মামুন জবাব দিল, আপনি তো নাটক বন্ধ করে দিয়েছেন। আপনি কারণ জানতে চাইলে মামুন এ দুটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করল। পাশে দাঁড়ানো ছিলেন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক। তাঁকে আপনি বললেন, কি মল্লিক সাহেব, নাটকের লোকদের কাছ থেকে টাকা না নিলে কি আমার সরকার চলবে না? আপনি পরদিনই মামুনকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি আর মামুন সে অনুযায়ী গণভবনে গিয়ে হাজির হলাম। আমাদের বন্ধু ড. ফরাসউদ্দীন ছিলেন তখন আপনার ব্যক্তিগত সচিব। ফরাস ভাইকে ডেকে আপনি বললেন, আজই রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করে দাও যে এখন থেকে শৌখিন নাট্যদলগুলোকে কোনো প্রমোদ কর দিতে হবে না, আর সেন্সর পুলিশের বদলে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি নাটক সেন্সর কমিটির মাধ্যমে হবে। মন্ত্রণালয়ে পাঠালে জটিলতা হতে পারে উল্লেখ করে সরাসরি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির কথা বললেন। তারপরই নাট্যচর্চার ওপর থেকে প্রমোদ কর উঠে গেল এবং নাটকের সেন্সর পদ্ধতি সহজতর হলো। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালে আপনারই সুযোগ্য উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা নাটকের সেন্সর আইন পুরোপুরি বাতিল করেন।
বঙ্গবন্ধু, আর এক বছর পর আমরা আপনার জন্মশতবার্ষিকী পালন করব। একটা কথা জানবেন, যত দিন যাচ্ছে আপনি বাঙালির হৃদয়ে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক।
আপনি যেখানে আছেন সেখান থেকে হয়তো দেখছেন, আপনার সুযোগ্য কন্যা আপনার আদর্শকে বুকে ধারণ করে বাংলাদেশকে কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আপনার অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করার জন্য, সোনার বাংলা গড়ে গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি নিরলস কাজ করে চলেছেন। আপনি নিশ্চয়ই তাঁকে আশীর্বাদ করছেন।
আপনি যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন, বঙ্গবন্ধু।
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব