5303
Published on ফেব্রুয়ারি 24, 2019প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্নফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বহুল প্রতীক্ষিত কর্ণফুলী টানেলের বোরিং কাজের উদ্বোধনকালে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়ে তুলবেন যেন সমগ্র বিশ্ব অবাক হয়ে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়ে তুলবো, যেন সারাবিশ্ব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশের দিকে। এটাই আমার চাওয়া, আর কিছু না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ অপরাহ্নে পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল (সুড়ঙ্গ পথের) নির্মাণের বোরিং (খনন) কাজের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে একথা বলেন।
শেখ হাসিনা যোগ করেন, ‘কোন নামও চাই না, কোন ধন-সম্পদও চাই না, কিচ্ছু চাই না। বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে, এটাই আমার চাওয়া। সে কারণেই চেষ্টা করি নতুন নতুন কিছু করার যেন বাংলাদেশের মানুষ সম্মানের সাথে চলতে পারে।’
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং বাংলাদেশে চিনের রাষ্ট্রদূত জ্যাং জোউ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে টানেলের নির্মাণ কাজের কনসালটেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (সিসিসিসি) পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে টানেলের একটি রিপ্লিকা উপহার দেয়া হয়।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না উল্লেখ করে ’৭৫ পরবর্তী শাসকদের অপশাসনের প্রসঙ্গ টেনে সরকার প্রধান বলেন, ‘হ্যাঁ মাঝে ২১টি বছর বাঙালির জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।
অসম্মানের চরম অবস্থায় বাংলাদেশ চলে গিয়েছিল। আমরা সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে আবার ফিরিয়ে এনে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ে তুলছি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আবার নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে এবং দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’
’৭৫ পরবর্তী সময়ে বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের যে পরিচয় ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ, বাংলাদেশ হলেই একটি নেতিবাচক মানভাব তা তাঁকে ভীষণ পীড়া দিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিনিষটা খুব কষ্ট লাগতো, না এটা হতে পারে না।’
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের কল্পিত দুর্নীতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে যখন এত কিছু হয়ে গেছে তাই এটার সঙ্গে আর কোন নাম যুক্ত হবার দরকার নাই।’
ওবায়দুল কাদের তার বক্তৃতায় পদ্মা সেতুটি প্রধানমন্ত্রীর নামে ‘শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু’ করার প্রসঙ্গ টেনে এনে বক্তব্য প্রদানের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আমার মন্ত্রীকে বলবো এখানে রাগ, ক্ষোভের কিছু নেই, আমি কোন নামও চাই না। আমি কিছুই চাই না। জীবনে কোন কিছু আমার চাওয়া পাওয়ার নেই।’
তিনিতো সব হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে এসেছেন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, নইলে আমার মতো একদিনে যখন কেউ সব আপনজন হারায় তাদের পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব হয় না।
তিনি এসব কাজ করে যাচ্ছেন একটা আদর্শের জন্য কারণ তাঁর বাবা এদেশের জন্য সারাটা জীবন কাজ করেছেন, তাঁর মা কষ্ট করেছেন এবং তারা এদেশের গরিব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাজ করে গেছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি যদি এতটুকু কাজ সেই গরিব দুঃখী মানুষের জন্য করতে পারি, আমার জীবনে সেটাই সবথেকে বড় স্বার্থকতা। এর বাইরে আর কিছু চাওয়ার নেই।’
‘কারণ এর বাইরে আমরা আর কোনদিকে তাকাইও না, দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করি ওইটুকু চিন্তা করে- আমার দেশের গরিব, দুঃখী মানুষ যেন গৃহহারা না থাকে, প্রতিটি মানুষ অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান এবং চিকিৎসা সেবা পাবে, সুন্দরভাবে বাঁচবে, ’যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছি, আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি।’
তিনি এ সময় বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন,‘বন্ধু প্রতীম দেশগুলো সকলেই এগিয়ে এসেছে যার কারণে আমরা বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে পারছি। কাজেই সকলে দোয়া করবেন বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে যেন গড়ে তুলতে পারি। ’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরিবার এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির কল্পিত অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, কানাডার একটি আদালত এই অভিযোগকে মিথ্যা এবং বানোয়াট বলে রায় দিয়েছে। ষড়যন্ত্রের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি দেশের দু’টি স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদক এবং ড. ইউনুস যুক্ত ছিলেন বলে ইঙ্গিত করেন।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে আমি বললাম-দুর্নীতির প্রমাণ দিন। মামলায় বিশ্বব্যাংক কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক যা যা বলেছে সব ভুয়া, বানোয়াট। কত যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা আপনারা বুঝবেন না। আজ সেই পদ্মা সেতু দৃশ্যমান।’
‘দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় তাঁর সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে বলেই আজ উন্নয়নগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে’ উল্লেখ করে দেশের বর্তমান জিডিপি ৭ দশমিক ৮৬ ভাগকে দুই অংকে নিয়ে যাওয়াই তাঁর লক্ষ্য, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকার প্রধান বলেন, জনগণ সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ে সন্তুষ্ট হয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ বিজয় উপহার দিয়েছে। তাই, আমরা জনগণের দেয়া প্রতিটি ওয়াদার পূর্ণ বাস্তবায়ন করবো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখব। সকলের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করব। দেশে কেউ গৃহহীন ও গরিব থাকবে না। গৃহহীনদের ঘরবাড়ির ব্যবস্থা আমরা করে দেব। অচিরেই দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। মহেশখালী ও মাতারবাড়ী অঞ্চলে একটি এবং পায়রাতে একটি করে এনার্জি হাব গড়ে তোলা হবে। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অধিকতর কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। দেশে বুলেট ট্রেন চালু করা হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করব।’
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের নতুন ধাপে প্রবেশ করলো। টানেলটি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলাকে শহরাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করবে। কাজেই আরো ১০ কিলোমিটার সড়ক করা গেলে এটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চারলেন সড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ সময় তিনি প্রকল্পটি রিভাইস করে এই সড়ক নির্মাণ করার জন্যও সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে সরাসরি কক্সবাজারের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে চট্টগ্রাম শহরের যানজট কমাসহ যাতায়াতের সময়ও অনেকাংশে কমে যাবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে, জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপিত হবে এবং কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকায় উন্নয়ন ত্বরান্নিত হবে।
এর ফলে পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমান বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ ও উন্নত হবে। পূর্ব প্রান্তের শিল্প কারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমান বন্দর ও দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন সহজ হবে, বলেন তিনি।
বীর চট্টলার গণমানুষের নেতা প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, নদীর ওপর ব্রিজ করলে নদীর ক্ষতি হবে তাই, গণমানুষের এই নেতা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের দাবিতে আন্দোলনও করেছিলেন ।
তিনি বলেন, ‘তিনি থাকলে অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের অনেক আন্দোলন সংগ্রামে তার অবদান রয়েছে। আজ আমি তাকে স্মরণ করছি।’
টানেল নির্মাণ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, চীন সফরে গেলে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। আলোচনার পর ওইদিনই তাঁরা টানেল নির্মাণের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
তিনি বলেন, চীন সরকার সাধারণত ঋণের ৮৫ ভাগ দিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য শতভাগ সহায়তা দিয়েছে তারা। বাংলাদেশের আগ্রহ দেখে চীনের প্রধানমন্ত্রী এ সহযোগিতা দিয়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্টও বেশ সহযোগিতা করেছেন।
চীনের এই সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের এই মহাযজ্ঞে প্রবেশ করা সম্ভব হয়েছে, বলেন তিনি।
চট্টগ্রামে প্রথম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আওয়ামী লীগ সরকার করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এদিন চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, আর এখন লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে আমরা করে দিচ্ছি।
তিনি বলেন, এটি বন্দর নগরী। ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছু এ জায়গা থেকে হয়। চট্টগ্রামে বিশাল আকারে অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। শহরে যানজট কমানোর জন্য বাইপাস করে দিচ্ছি। টানেল নির্মাণ হলে চট্টগ্রামে যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন হবে। কক্সবাজার পর্যটন শহর। যাতে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠে সে লক্ষ্যে আলাদা কর্তৃপক্ষ করে দিয়েছি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’র উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না ইনশাল্লাহ।’
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এখনেই থেমে থাকতে চাই না। বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যেন আরো উন্নত হয় সেজন্যই আমরা শতবর্ষ মেয়াদি ‘ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০’ গ্রহণ করেছি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, তাঁর সরকার ও দেশবাসী ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। এই সময়কে মুজিব বর্ষ হিসেবে ইতোমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে।
এই মুজিব বর্ষ উদযাপনের চট্টলার জনগণও এগিয়ে আসবে বলে আকাঙ্খা ব্যক্ত করে তিনি এই মর্মে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন- ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপিত হবে এবং আমাদের প্রজন্ম উন্নত, সমৃদ্ধশালী দেশে তা উদযাপন করবে।