বঙ্গমাতার শুভ জন্মদিন

4157

Published on আগস্ট 9, 2018
  • Details Image

- অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ হাসান খান

আমরা একজন বঙ্গবন্ধুকে জানি, যিনি কেবল একটি নাম নয়, বরং নিজেই একটি ইতিহাস। যাকে বাঙালি জাতিসহ বিশ^বাসী ভালোবাসে ও সম্মান করে। যার একটি অঙ্গুলি হেলনে হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে। প্রশাসনে না থেকেও যার কথায় সুপ্রিমকোর্ট বন্ধ হয়ে যায়, সারাদেশ স্থবির হয়ে যায়। যার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন একটি ভূখ- পেয়েছি। তিনি কেবল একজন সফল রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি সফল মানুষও ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাই নন, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাকে নিয়ে দেশে-বিদেশে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, প্রচুর ডকুমেন্টারি প্রচার করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ মানেই একজন বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। এই মহামানবের সফলতার নেপথ্যে ছিলেন এক মহীয়সী নারী। তার কথা ইতিহাসে ওইভাবে বলা হয়নি। অথচ তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে বাঙালির জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন। এই মহীয়সী নারীর নাম বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি আমাদের বঙ্গমাতা। ৮ই আগস্ট এই মহীয়সী নারীর ৮৮তম জন্মদিন। দেশ, জাতি ও বঙ্গবন্ধুর জন্য তার অবদানের কিছু কথা তুলে ধরে আমি সামান্য কিছু ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করছি।

বেগম ফজিলাতুন্নেছার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। তিনি বঙ্গবন্ধুর গ্রাম গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফজিলাতুন্নেছা মাত্র তিন বছর বয়সে তার বাবা শেখ জহুরুল ইসলাম এবং পাঁচ বছর বয়সে তার মা হোসনেয়ারা বেগমকে হারান। মাত্র ১৩ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বঙ্গবন্ধু যতটা না ঘরের মানুষ ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন সাধারণ মানুষের। সেজন্য বিয়ের পর আর দশজন সাধারণ নারীর মতো স্বামীকে কাছে পাননি। বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে। অন্যদিকে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি জেলে জেলে কাটিয়েছেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিল না। কখনো তার কোনো কথাবার্তায় বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায়নি। বরং তিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুর পাশে ছায়ার মতো ছিলেন। তিনি শেখ মুজিবকে কখনো সংসারের ঝামেলায় জড়াতেন না। সংসার, সন্তান সবকিছুই তিনি একা সামলাতেন। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার কারণে বহু ঈদ তিনি বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু সন্তানদের তিনি কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেননি। ছেলেমেয়েদের তিনি বোঝাতেন তার বাবা বাংলার মানুষের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে। বাংলাদেশের সবার জন্য তাকে ভাবতে হয়। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি রাজপথকে বেছে নিয়েছিলেন। তাই আর দশজন বাবার মতো সন্তানরা তাকে কাছে পাবে না। সংসারের হাল শক্ত হাতে ধরেছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুকে তাই পরিবার নিয়ে বেশি ভাবতে হয়নি। সে কারণে তিনি পরিবারের স্বাভাবিক বাঁধন ছাড়াই আজীবন রাজনীতি করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তার ‘কারাগারের রোজনামচা’য় সংসার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘রেণু বলল, ‘(সংসার নিয়ে) চিন্তা তোমার করতে হবে না।’ সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি।’’ ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িটিও করেছিলেন ফজিলাতুন্নেছা। তিনি হাউস বিল্ডিংয়ের লোন নিয়ে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। নিঃসন্দেহে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তিনি কেবল বঙ্গবন্ধুর পাশেই ছিলেন না, তিনি দুঃসময়ে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। দলের কাছে তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। দলের জন্য নিজের গহনা বিক্রি করতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। এমনকি সংসারের বাজার-হাটের টাকা থেকেও তিনি প্রয়োজনে দলীয় নেতাকর্মীদের টাকা দিতেন। ’৭৫-এর অন্যতম ঘাতক মেজর ডালিমকেও তিনি ব্যবসা করতে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।

ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। এরপর তিনি কিছুদিন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেন। তিনি বড় বড় ধরনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি জানতেন তাকে কীভাবে চলতে হবে। তিনি তার সন্তানদের আজীবন সাধারণ জীবনযাপনের শিক্ষা দিয়েছেন। আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত এক আবহমান বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি। প্রধানমন্ত্রী হয়েও শেখ হাসিনা সন্তান জয়ের জন্য খাবার রান্না করছেন, এ দৃশ্যটি ফজিলাতুন্নেছা মুজিবেরই প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’। তিনি বার্ট্রান্ড রাসেলের জীবনদর্শন অনুসরণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা শুনতে শুনতে ফজিলাতুন্নেছা নিজেও লেখকের ভক্ত হয়ে গেলেন। তিনি তার কনিষ্ঠ ছেলের নাম রাখেন ‘রাসেল’! এ থেকেই বোঝা যায় তার একটি জ্ঞান পিপাসু মন ছিল। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও তার মায়ের মতো জ্ঞান পিপাসু। তিনি বইমেলায় যান, বই পড়েন এবং বই লিখেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখা ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বৈরাচারের অভ্যুত্থান’ এ বইটি তদানীন্তন সময়ে রাজনৈতিক লেখার ভেতরে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর মতো অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও তার কোনো চাহিদা ছিল না। তিনি তখনো আর দশজন বাঙালি নারীর মতোই স্বামী-সন্তানদের জন্য নিজের হাতে রান্না করতেন। পোশাক, অলঙ্কার নিয়ে বিলাসিতা দূরের কথা, তিনি সাধারণ চাকচিক্যও পছন্দ করতেন না। তিনি গায়ে গহনাও পরতেন না। অথচ এটি আজকের বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর বেলায় চিন্তাই করা যায় না। বঙ্গবন্ধু এ দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গভবনে থাকতেন না। তিনি ছিলেন ইতিহাসে মণ্ডিত ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে। তার যোগ্য সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কোনো রকম রাষ্ট্রীয় প্রটোকল চাইতেন না। এত বিলাসবর্জিত জীবন আর কোনো রাষ্ট্রপতির স্ত্রী যাপন করেছেন কিনা সন্দেহ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যারা রাজনীতি করতেন, এমনকি যারা বঙ্গবন্ধুর গঠনমূলক সমালোচনা করতেন, তারাও একবাক্যে বঙ্গমাতার সাধারণ জীবনযাপনের কথা স্বীকার করবেন। আজীবন নিভৃতচারী এই নারী বঙ্গবন্ধুর সব সংগ্রামে পাশে থেকেছেন। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী নন, জীবন সঙ্গিনীও। তিনি আজীবন তার স্বামীর আদর্শকে লালন করে গেছেন। তাই নিয়তিও যেন মৃত্যুক্ষণটি একদিনে একই সময়ে লিখে দিল।

বঙ্গবন্ধু বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে ডাকতেন রেণু বলে। আজ এই মহামানবীর জন্মদিনে তাকে নতুন করে শ্রদ্ধা জানানোর কিছু নেই। কারণ ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুদিন থাকে না, প্রতিদিনই তাদের জন্মদিন।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, চাঁদপুর জেলা

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত