8372
Published on আগস্ট 9, 2018- ড. জিনাত হুদা
এ লেখার রেণু একজন অতিসাধারণ নারী, তবু তিনি আশ্চর্যজনকভাবে অসামান্য। তিনি বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী, জীবনসঙ্গিনী, মৃত্যুপারের সহযাত্রী।
আনুমানিক ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় রেণুর জন্ম হলেও শৈশবেই তিনি হন পিতৃ-মাতৃহীন। অতঃপর তিন বছর বয়সেই তিনি হয়ে আসেন শেখ মুজিব তথা বঙ্গবন্ধুর ঘরনি। এটি কোনো রূপকথার গল্প নয়, কল্পকাহিনিও নয়। অবিভক্ত ভারতবর্ষের সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় গ্রামবাংলার এ ধরনের বাল্যবিয়ের চিত্র অতিচেনা কাহিনিও বটে। কিন্তু যেটি অভিনব এবং ব্যতিক্রমধর্মী সেটি হচ্ছে এই রেণুর একজন নিরন্তর সংগ্রামী, আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মত্যাগী ও মুক্তিযোদ্ধা নারীতে রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনি।
কবি জসীমউদ্দীনের নায়িকা ‘পুতুলের বিয়ে’ ভেঙে যাওয়াতে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনের নায়িকা রেণু পুতুলের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরও কখনো কেঁদে বুক ভাসাননি। পুতুল নয়, বরং রেণুর নিজের সংসারই চলেছে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে। মূলত শৈশবেই রেণু বঙ্গবন্ধুর জীবন চলার সঙ্গী হয়ে এলেও কৈশোর বা তারুণ্যের প্রণয়পাশা দিয়ে তাঁর জীবন গড়ে ওঠেনি। বরং রাজনীতিবিদ স্বামী, যিনি কখনো থেকেছেন ঢাকায়, কলকাতায় কিংবা কারাগারে, সেই স্বামীর সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন নিজের সংসারের চাকা। কেমন করে পারলেন রেণু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো একজন বহির্মুখী, বহুবার কারাবরণকারী রাজনীতিবিদের সংসারকে সামলে নিতে? আজ এ প্রশ্নটি আমাদের মনে বারবার ঘুরপাক খায়। আজ আমরা নারীবাদের কথা বলি, নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, লিঙ্গ সমতার কথাও বলি। টুঙ্গিপাড়ায় বেড়ে ওঠা রেণুর সঙ্গে নিঃসন্দেহে এসব কেতাবি কথার কোনো পরিচয়ই ছিল না। তবু স্বামীর বিপদে-আপদে, জেলজীবনে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দৈহিক উচ্চতায় ছোটখাটো এ মানুষটি ছিলেন কী ভীষণ রকম দৃঢ়চিত্ত ও আত্মপ্রত্যয়ী। জীবন ও রাজনীতিকে উপলব্ধির এ পাঠ, এ শিক্ষা তিনি নিয়েছিলেন নিজের জীবন থেকে, নিজের চারপাশের অভিজ্ঞতা থেকে।
গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া রেণু তাই যেমন বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্রকে পড়েছিলেন, তেমনি বার্ট্রান্ড রাসেলকে নিয়েও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন বহুবার। আর তাঁদের এ আলোচনার ফলে কনিষ্ঠ ছেলের নামকরণ হয় শেখ রাসেল। টুঙ্গিপাড়া নামক একটি অজপাড়াগাঁয়ের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও সংগীতের প্রতি রেণুর যেমন ছিল অনুরাগ তেমনি তিনি সংগ্রহও করেছিলেন সংগীতের বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র। রেনেসাঁ-উত্তর অবিভক্ত বাংলার একটি গ্রামে বেড়ে ওঠা রেণু এভাবেই ছিলেন আধুনিক, রুচিশীল ও সংস্কৃতিপ্রেমী। কিন্তু রেণুকে শুধু একজন আধুনিক নান্দনিক রুচিবোধসম্পন্ন পরিশীলিত নারী হিসেবে মূল্যায়নের সুযোগ নেই। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন জাতীয়তাবাদী এবং নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঠিক প্রয়োগ। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একজন দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী, দেশপ্রেমিক বীর নারীযোদ্ধা। বিশ্বের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রায়ই নারীদের ভূমিকা থাকে অদৃশ্যমান। চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও মনস্তাত্ত্বিক গড়নের কারণে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীর ভূমিকা মূল্যায়িত হয় নিষ্ক্রিয় উপস্থিতির বিচারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শিকড় ও মনস্তত্ত্বের বিরুদ্ধে রেণু এ লড়াই করেছেন নিরলসভাবে, কখনো বা একাকী। বারবার কারারুদ্ধ স্বামীকে যেমন সাহস জুগিয়েছেন বাঙালির মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা দিয়েছেন নিজের আত্মজীবনী লেখার জন্য। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে অকপটে স্বীকার করেছেন তাঁর স্ত্রী রেণুর কাছে তাঁর কৃতজ্ঞতার কথা, যিনি জেলগেটে বঙ্গবন্ধুর জন্য কয়েকটি খাতা কিনে রেখে যান। রেণুর সেই আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লেখার কাজ।
আমরা সবাই জানি, ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধুকে সে সময় প্যারোলে মুক্তির মাধ্যমে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বেগম মুজিব সব রাজনৈতিক নেতার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে প্যারোলে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে মতামত জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ আলী মিয়ার মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সত্যি, কি অসীম সাহসী নারী! কতটা চৌকস ও প্রজ্ঞাবান ছিলেন তিনি! তথাকথিত রাজনীতির পাঠ তিনি গ্রহণ করেননি, নেত্রী হিসেবে নিজের ইমেজ গড়ে তোলার চেষ্টাও কখনো করেননি। অথচ এক আশ্চর্য তেজ ও মেধার মিশ্রণে এক অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রেণু তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে একজন অদৃশ্য নারীযোদ্ধা নন। বরং তিনি একজন সক্রিয় ও লড়াকু জাতীয়তাবাদী নেত্রী, যিনিই শুধু বঙ্গবন্ধুকে বলতে পারেন, ‘আজ যদি তুমি প্যারোলে যেতে রাজি হতে, তাহলে তোমার বিরুদ্ধে আমি পল্টনে জনসভা করতাম।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্দিদশা ছিল রেণুর জীবনের এক বিশাল অগ্নিপরীক্ষা। তাঁর এ অগ্নিপরীক্ষা ছিল শুধু স্বামী শেখ মুজিব কিংবা দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামালের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনার কারণেই নয়, সে সময় রেণুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনাও ছিলেন সন্তানসম্ভবা। সন্তান জন্মদানের কঠিন সময়টিতে শেখ হাসিনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও সন্তানসম্ভবা কন্যার সহগামী হওয়ার অনুমতি মেলেনি জননী ফজিলাতুন্নেছার। বরং তিনি ভর্ত্সনার শিকার হয়েছিলেন কঠিন ভাষায়, ‘তুমি কি ডাক্তার যে যেতে চাও?’ রেণুর হৃদয় এভাবেই ভেঙেছে বারবার, বেদনায় নীল হয়েছে হাজারবার। তবু সে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়েই রেণু লড়ে গেছেন কখনো প্রবল প্রতাপে, কখনো একাকী নিঃশব্দে। স্বামীর সহগামী সীতা বনবাসে গিয়ে অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিলেন। রেণুর সারাটি জীবনের নামই ছিল অগ্নিপরীক্ষা—তাঁর এ অগ্নিপরীক্ষাটি কখনো ছিল অসম শক্তির বিরুদ্ধে, কখনো ছিল বহুমুখী। তিনি অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিলেন স্বামীর মুক্তির জন্য, সন্তানদের কল্যাণের জন্য, বাংলাদেশ নামক মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য।
স্বামী ও সন্তানদের জন্য ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করাটাকে অনেকেই বাঙালি নারীর চিরন্তন বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন। রেণু সেটি করেছিলেন। কিন্তু অন্য বাঙালি নারীকে ছাড়িয়ে রেণুর মহীয়সী হয়ে ওঠার কারণ অনুসন্ধানে এ সত্যই উদ্ঘাটিত হয় যে তিনি কখনোই তাঁর কষ্টসহিষ্ণু আত্মত্যাগের জীবনকাহিনিকে নিজের বাড়ির সীমানা পেরোতে দেননি। তিনি সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো সব কষ্ট, বেদনা, দুঃখ, যন্ত্রণার গরলকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে গেছেন। নিজের শখের গয়না বিক্রি করেছেন কোনো অভিযোগ ছাড়াই। সংসারের আসবাব বিক্রি করেছেন আর্থিক কষ্টের দিনগুলোতে অন্ন জোগানোর জন্য। কারাবন্দি স্বামীর অনুপস্থিতিতে পাঁচটি সন্তান নিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পাল্টিয়েছেন সীমাহীন ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে। জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এত বড় ঝড়, এত ঝাপটার সামনে কখনো ভেঙে পড়েননি, কখনোই বিশ্বাস হারাননি নিজের প্রতি, স্বামীর রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের প্রতি।
নিজের পুতুলের বিয়ে দেওয়ার আগে রেণু নিজেই পুতুল রূপে বউ সেজে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঘরে। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গী হলেও বালিকাবধূ বা তরুণী ভার্যার মতো নিজের শখ-আহ্লাদ মেটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুকে কখনোই বিব্রত করেননি। বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে রেণু কখনোই জীবনকে উপভোগ করার দর্শন গ্রহণ করেননি। অথচ মন্ত্রীপত্নী ছিলেন সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই। ভোগবাদিতার দর্শনকে পরিহার করে সাধারণভাবে জীবন চালানোর দর্শনই ছিল তাঁর যাপিত জীবনের দর্শন, যে শিক্ষা তিনি দিয়েছিলেন তাঁর সন্তানদেরও। রেণুর জীবন-দর্শন তাই সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার দর্শন, তাঁর সংগ্রাম একজন নারীর জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার সংগ্রাম। একজন বিনয়ী, নম্র রেণু তাই শুধু মুজিবপত্নী নন, নন শুধু একজন গৃহবধূ কিংবা শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার জননী। নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকা রেণু একজন আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মমর্যাদাশীল অসামান্য নারী, একজন বীরযোদ্ধা, নেত্রী, আমাদের বঙ্গমাতা।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ