9047
Published on জুলাই 16, 2018এম. নজরুল ইসলাম:
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম কালো দিন ১৬ জুলাই। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশকে সত্যিকার অর্থেই দুর্যোগের মেঘে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তার আগেই গণতন্ত্র চেপে বসা শাসকদের চাপে পিষ্ট। রাজনীতি তখন যেন গর্হিত অপরাধ। এমনকি রাজনীতিক পরিচয় দিতেও অনেকে তখন কুণ্ঠিত ছিলেন। চার বছরের জোট অপশাসনের পর চেপে বসা শাসককুল তখন রীতিমতো ত্রাস। রাতারাতি সব কিছু বদলে ফেলার আভাস দেওয়া হচ্ছিল। রাজনীতি থেকে জঞ্জাল পরিষ্কার করার কথা তখন এমন করে বলা হচ্ছিল, যেন রাজনীতি এক গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত। অবশ্য চারদলীয় জোট অপশাসনের কারণেই চেপে বসে তত্ত্বাবধায়ক নামের নতুন এক দীর্ঘমেয়াদি শাসনব্যবস্থা। ওয়ান-ইলেভেন নামের পটপরিবর্তনের পর সরকার পরিচালনায় আসা এই সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি এভাবেই হয়? এভাবেই কি ফিরে ফিরে আসে ইতিহাস? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও বোধ করি তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। আমরা যদি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে থাকতে হয়েছে কারা অভ্যন্তরে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের এই মহান নেতাকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানের চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধুর মতোই যেন ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকে। দেশের মানুষ যখন অধিকারবঞ্চিত, ১৯৮১ সালে তিনি সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশে ফিরেছিলেন। দাঁড়িয়েছিলেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের পাশে। যেমন দাঁড়িয়েছিলেন জাতির পিতা, ঠিক সে রকমই। শেখ হাসিনার চলার পথটা কিন্তু কোনো দিনই সহজ ছিল না। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশবিরোধী জামায়াত নিয়ন্ত্রিত বিএনপি জোট ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিতে চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যাতে তাদের পক্ষে কাজ করে তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই পাকা করে ফেলেছিল প্রায়। সেই সুযোগ নিয়ে চেপে বসে নতুন এক শাসকগোষ্ঠী। তাঁদের শর্তের বেড়াজালে নতুন করে আটকে যায় বাংলাদেশ। নতুন করে মানুষের অনেক অধিকারই তখন উপেক্ষিত হয়।
বরাবরই আমরা দেখে এসেছি, চেপে বসা শাসকদের চরিত্র এ রকমই হয়। সেখানে মানুষ উপেক্ষিত থাকে। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা চেপে বসা শাসকদের পছন্দ নয়। মানুষ নয়, অন্তরালের অন্য কিছু যখন ক্ষমতার নিয়ামক হয় তখন জনমত যে উপেক্ষিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব তখন অপরাধ হয়ে দেখা দেয়। এমনটিই ঘটেছিল ২০০৭ সালে। চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী তখন মানুষের কণ্ঠরোধ করেছে। সব কিছুই তখন চলেছে শর্তের বেড়াজালে। অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার নামে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সে সময়। মানুষের অধিকার আদায়ের অগ্রনেত্রী শেখ হাসিনা যখন মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার, তখনই রুদ্ধ করা হলো তাঁকে।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই রাতে নতুন এক রাজনৈতিক প্রহসন যেন সম্প্রচারিত হলো। দেশের মানুষ রাত জেগে সে প্রহসন দেখেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার তখনকার বাসভবন সুধাসদন ঘিরে রেখেছে যৌথ বাহিনী। মানুষের কাছে খবরটি পৌঁছে যেতে মোটেও সময় লাগেনি। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো আদালতে। এমন সময়ে যা হয়, কারাগারেই যেতে হলো তাঁকে। যেখানে তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয়, সংসদ ভবনের সেই বাসভবনটি আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। অর্থাৎ আগে থেকেই পরিকল্পনা করে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এমন অনেক ঘটনাই তো ঘটেছে। দিনের পর দিন তাঁকে থাকতে হয়েছে কারাগারে। এমনকি নিজের মেয়ের বিয়ের দিনও তিনি ছিলেন কারাগারে। বাবাকে কারাগারে যেতে ও আসতে দেখেছেন তিনি। নিজেও কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন অনেকবার। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তাঁকেই যেতে হলো কারাগারে। এভাবেই বাবার ইতিহাস ফিরে এলো তাঁর জীবনে।
এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে জেল-জুলুম নতুন কোনো ঘটনা নয়। রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। আজকের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে অনেক কালো অধ্যায় পার হয়ে আসতে হয়েছে। এখনো বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে চলতে হচ্ছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, শেখ হাসিনার পায়ে পায়ে পাথর। সেই পাথর সরিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে এক সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গভীর এক ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের আপামর দুঃখী জনসাধারণের নেতা। তাঁর পরিবারকে নিয়ে ষড়যন্ত্র আজকের নয়, দীর্ঘ কয়েক যুগ থেকেই চলছে। সাহসী রাজনীতির পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাসকে মুছে ফেলে দেওয়ার কী কুৎসিত-নির্মম ও ভয়াবহ চক্রান্তই না করেছিল প্রতিক্রিয়াশীল চক্র—রাজনৈতিক নিষ্ঠুর প্রতিহিংসাপরায়ণতার সেই চক্রান্তের জাল ক্রমেই বিছিয়েছে গোপনে! শুধু কী তাই, চেষ্টা করেছে সংকীর্ণ রাজনীতির হীনম্মন্যতার ছদ্মাবরণে তাঁর ভাবমূর্তিকে নস্যাৎ করতে।
সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলি তো তারই রেশ। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই। বঙ্গবন্ধুকন্যাই পারেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরে উন্নয়নের নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর এখন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
দেশ আমাদের। আমরা জনগণই দেশের প্রাণশক্তি। সেই জনগণকে রক্ষা ও সুসংহত করেই রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। দেশটিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তৎপর। ঘাপটি মেরে আছে রাজনৈতিক অপশক্তিও। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সম্মিলিত প্রয়াস।
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গানে আছে, ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার/ও কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা/ও কি পাখির কূজন নাকি হাহাকার।’ তেমনি হাহাকারে ভরা এক অন্ধকার ভোর এসেছিল আমাদের জাতীয় জীবনে।
জনগণের জয় হোক—১৬ জুলাই এই মন্ত্রে নতুন করে উজ্জীবিত হই আমরা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের বিস্ময় হবে, এ বিশ্বাস আমাদের সবার। ১৬ জুলাইয়ের মতো অন্ধকারে ঢেকে থাকা ভোর নয়, সত্যিকারের আলোয় উদ্ভাসিত দিন আসবেই আসবে।
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ