12343
Published on জুন 23, 2018তোফায়েল আহমেদঃ
সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ যারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা তাদের আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ঐতিহাসিক ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাগণ দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দল। যদিও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই ’৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে প্রাণপ্রিয় ছাত্রপ্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই বছরের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পথে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সংগঠিত করে বাঙালির ইতিহাসে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এই তিনটি নাম সমার্থক হয়ে আছে।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস অবিরাম পরিবর্তন ও বিপ্লবের ইতিহাস। ’৫৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ২২৮টি আসনে জয়লাভ কার্যত মুসলিম লীগের কবর রচনা করে এবং রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সাম্প্রদায়িকতা বিদায় করার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ফলাফল, ’৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ’৫৫-এর ২১ অক্টোবর হয় অসাম্প্রদায়িক ‘আওয়ামী লীগ’। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ‘বজ্র কঠিন শপথ’ চেতনায় ধারণ করে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পথচলা। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ’৬২তে আমাদের স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। ’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়েছিলেন লাহোরে। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ’৬৬-এর ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আমাদের বলতেন ‘সাঁকো দিলাম, এই সাঁকো দিয়েই একদিন আমরা স্বাধীনতায় পৌঁছাব।’
ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলার আসামি করে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। জাগ্রত ছাত্রসমাজ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। আমরা ৬ দফাকে হুবহু ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে আসাদ, মকবুল, রুস্তম, মতিউর, আলমগীর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহাসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে ’৬৯-এ প্রবল গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে জাতির জনককে ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে মুক্ত করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করি। তখন আমাদের স্লোগান ছিল ‘পাঞ্জাব না বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা’। জাতির জনককে ফাঁসির মঞ্চ থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। এরপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যখন ১ মার্চ জাতীয় সংসদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়, তখন দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। শুরু হয় ১ দফা তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেন এবং বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষাধিক শহীদ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়! ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি যেদিন তিনি স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন মনে হয়েছে আজ আমরা প্রকৃতই স্বাধীন। এরপর ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আমাকে তার রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন।
দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। গোলাঘরে চাল নাই, ব্যাংকে টাকা নাই, বৈদেশিক মুদ্রা নাই, রাস্তাঘাট-পুল-কালভার্ট সব ধ্বংসপ্রাপ্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধুর একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ’৭২-এর ৪ নভেম্বর মাত্র ৭ মাসে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস্’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। আজকে যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উেক্ষপণ করা হয়েছে, তারও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধু ’৭৫ বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। ’৭৪-৭৫-এ বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উত্পাদিত হয় যা ’৭৩-৭৪-এর চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতির পিতা বিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশটাকে যখন স্বাভাবিক করেছিলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, বাংলার মীরজাফর বেঈমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ওই সময় তার দুই কন্যা আমাদের প্রিয় বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনিচক্র মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ’৮১-এর ১৭ মে বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করেন। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ’৯৬-এর ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। এই সরকারের ইতিহাস সৃষ্টিকারী সাফল্য ’৯৭-এর ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’। ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন হয়। এ কালপর্বে সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। জাতির জনককে হত্যার পর ঘাতকচক্র পবিত্র সংবিধান কলঙ্কিত করে হত্যাকারীদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। নিম্ন আদালতে হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৬.৪ শতাংশে উন্নীত এবং মুদ্রাস্ফীতি ১.৪৯ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভবপর হয়। ’৯৮-এর জুনে ৯৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার ৫ম এবং বিশ্বের ৯২তম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে ওঠায় সমগ্র দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর সুফল পরিলক্ষিত হয়।
মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের ৬৯-তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই বছরটি সবিশেষ তাত্পর্য বহন করে। ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত সাড়ে ৯ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরেও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুতে রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৃথক রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ, মেট্রো রেল, এলিভেটরি এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনসহ সর্বমোট ১১৯টি নতুন বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন, বিদ্যুত্ উত্পাদন ৩,২০০ থেকে এই ডিসেম্বরে ১৮,০০০ মেগাওয়াট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩.৫ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার, রপ্তানি আয় ১০.৫২ থেকে ৩৪.৪২ বিলিয়ন ডলার, পায়রা বন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশ করে জনগণের মাথাপিছু আয় ১,৭৬৫ ডলারে উন্নীত করেছেন। সবল-সমর্থ আর্থ-সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি।
২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ইতোমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছি। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেন নাই। সেই কাজটি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা করে চলেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা সেই পথেই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
প্রকাশঃ দৈনিক ইত্তেফাক