বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার তাৎপর্য

15853

Published on জুন 3, 2021
  • Details Image

ড. এম এ মাননানঃ

বঙ্গবন্ধুর পদচারণা এ দেশের অনেক কিছুতেই। সমতলের মেঠোপথ, হাওর-বাঁওড়ের কূলঘেঁষা সবুজ গ্রাম, সাগরপাড়ের মৎস্যজীবী অঞ্চল, পাহাড়ের অরণ্যভূমি, নদী সিকস্তির নিম্নভূমি, শহরের অলিগলি, কোথায় ছিল না তার পদচারণা। সদর্প পদচারণা ছিল রাজনীতির সুবিশাল ময়দানে, অর্থনীতির পরতে পরতে, শিল্পাঞ্চলের মেহনতি মানুষের আঙিনায়। অনেক পদচারণার অন্যতম ছিল পাকিস্তানি সামরিক শাসক-শোষকদের বুকের মধ্যিখানে প্রচ- জোরে খোঁচা দেওয়া ঐতিহাসিক ছয় দফা। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, আছে তার ছয় দফার বোনা বীজের ফলবান বৃক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ।

২০২১ সালের ৭ জুন ৫৫তম ছয় দফা দিবস। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের দুই অংশের সব বিরোধী দলের কনভেনশনের সাবজেক্ট কমিটিতে বঙ্গবন্ধু প্রথম তার প্রণীত ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করার চেষ্টা করেন, যদিও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার বিরোধিতার কারণে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সর্বপ্রথম সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিমানবন্দরে লাহোর কনভেনশন থেকে ফেরার পর। একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ছয় দফা শুধু গ্রহণই করেনি, দেশব্যাপী বিতরণ করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া নিজস্ব দফাওয়ারি ব্যাখ্যাসহকারে একটি পুস্তিকা প্রকাশেরও সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকৃতপক্ষে ছয় দফা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হিসেবে চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। রাজনৈতিক টালমাটালের সেই দুর্যোগের সময় (পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের প্রতি প্রশাসনিক বঞ্চনা, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিনিয়ত অর্থ পাচার ইত্যাদি) পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমগ্র দেশে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয় নিয়ে ছয় দফা প্রণয়ন করা হলেও ছয় দফার সংগ্রাম ছিল কণ্টকাকীর্ণ, বিপদসঙ্কুল। পাকিস্তানি শাসকরা এটিকে ভালো দৃষ্টিতে নেয়নি। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করে বন্দি করা হয়। নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অবিচল এবং ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস করেননি। তার দৃঢ়তার কারণেই ছয় দফার সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি। পরবর্তী সময়ে ছয় দফার ভিত্তিতেই গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। বাঙালিদের মুক্তির ম্যাগনাকার্টা নামে অভিহিত ছয় দফাকে ভিত্তি করেই বঙ্গবন্ধুর সাহসিক নেতৃত্বে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই এ দেশের জনগণ হঠকারী-প্রবঞ্চক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে মুক্ত করে ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন ভূখ- প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন দেশ, নতুন পতাকা সংযোজন করতে সক্ষম হয়।

যদিও প্রথম প্রথম কেউ কেউ ছয় দফাকে দরকষাকষির বিষয় হিসেবে দেখেছেন, আসলে তা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের শোষণ থেকে রক্ষাকল্পে গণমুক্তির মহাসনদ। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় : ‘...পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ছয় দফা কর্মসূচি ... আমার প্রস্তাবিত ছয় দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড় পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই।’

এখন দেখা যাক, ছয় দফায় কী ছিল। প্রথম দফার বিষয়বস্তু ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে রূপান্তর, সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থাকরণ, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার এবং আইন পরিষদের সার্বভৌমত্ব। দ্বিতীয় দফায় বলা হয়, বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে এবং অন্যান্য খাত ন্যস্ত থাকবে প্রদেশের হাতে। তৃতীয় দফায় পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের জন্য পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। তবে এ কথাও বলা হয়েছে যে, একটি মুদ্রাব্যবস্থাও থাকতে পারে কিন্তু এরূপ হলে একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ পাচার না হতে পারে। চতুর্থ দফার বিষয়বস্তু হলো পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর হাতে শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা অর্পণ এবং এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদেশের শুল্ক আয়ের একটি অংশ প্রদান। পঞ্চম দফাটি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব রাখা সম্পর্কিত। আর শেষ দফাটি ছিল প্রত্যেক প্রদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষমতা প্রদানবিষয়ক।

সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলির নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের লক্ষ্যে প্রণীত একটি বাস্তবায়নযোগ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি। এতে উভয় প্রদেশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হয়। বস্তুত ছয় দফা কর্মসূচিতে উভয় প্রদেশের জন্য নিয়মতান্ত্রিক গ-ির ভেতরে থেকে ন্যায়বিচার চাওয়া হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ১৫ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে মানিক মিয়ার ‘সার্বভৌম বাংলা থেকে গৃহযুদ্ধ’ শীর্ষক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন : ‘সামগ্রিকভাবে দেশের স্বার্থকে বুলন্দ করিবার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে জনসাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে দেশের দুই অঞ্চলের সমান অধিকার, সমান মর্যাদা ও সমান ক্ষমতা নিজ নিজ অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা তদারকের অধিকারী করিয়া জাতীয় জীবনে অধিকতর ঐক্য ও সংহতি বিধান এই কর্মসূচির লক্ষ্য। দেশকে দুর্বল করা নয়, বরং দেশের দুই অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে অংশীদারিত্বের মনোভাব সৃষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করিয়া দেশ ও রাষ্ট্রকে সত্যিকার শক্তিশালী করাই ছয় দফা কর্মসূচির মর্মকথা।’ এর আগে ৪ মার্চ তিনি ইত্তেফাকে লিখেছিলেন : ‘...সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলোকে জাতীয় সমস্যাবলি যখন নতুন করে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, ঠিক সেই সময় তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) বিস্তারিত কর্মসূচিটি প্রণয়ন করে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন।’

ছয় দফার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করায় এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালের ৭ জুন প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। সেদিন পুলিশের গুলিতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে ১১ জন নিহত হয়। পুলিশ প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেপ্তার করে এবং অগণিত লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ প্রতিবছর ৭ জুন দিনটিকে ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। দিনটি বাংলাদেশের জনগণের কাছে বিশেষভাবে তাৎপর্যম-িত। ছয় দফাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে একটি টার্নিং পয়েন্ট। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ শাসকগোষ্ঠীর পদলেহনকারীরা যেভাবে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলা শুরু করেছিল, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিপুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই বুঝতে পেরেছিল, স্বায়ত্তশাসন ছাড়া বাঙালি অধ্যুষিত এ প্রদেশটির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সেই যে গণআন্দোলন বেগবান হয় তা আর কারো পক্ষেই রোধ করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা লাভ করে।

ছয় দফা দিবসে সেই দূরদর্শী মহান ব্যক্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই যিনি সময়োপযোগী ছয় দফা কর্মসূচি দিয়ে এবং পরবর্তীকালে একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে সবাইকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

লেখকঃ শিক্ষাবিদ, কলাম লেখক ও উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক আমাদের সময়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত