পশ্চিমবঙ্গে শেখ হাসিনার সফর ও বিএনপির অপপ্রচার

7302

Published on মে 29, 2018
  • Details Image

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারিঃ

এরইমধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী অতি সাধারণ মানুষও মিডিয়ার কল্যাণে জেনে গেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন দুদিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতন এবং আসানসোল কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দুটো বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, তথাপিও এটিকে কোনো অবস্থাতেই গতানুগতিক সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সফর বলা যাবে না। রাষ্ট্রীয় সফরের ধরন এবং প্রস্তুতি একেবারেই আলাদা। দুই দেশের শীর্ষ যে কোনো বৈঠকের আগে এজেন্ডা বা আলোচ্য সূচি নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা থাকে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলেই রাষ্ট্রীয় সফরের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়, সেভাবেই সফর অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষও বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছে, বুঝে আসছে। সে ধরনের রাষ্ট্রীয় সফরের আগে আমাদের মিডিয়াগুলোতে দুদেশের অমীমাংসিত ইস্যু কীভাবে মীমাংসা করা সম্ভব, দুদেশের মধ্যে তার অবসান কেমন, দৃষ্টিভঙ্গির নানা বিচার-বিশ্লেষণ করেও থাকে, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়, রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়াও প্রচার করা হয়। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিস্তার জলবণ্টন ইস্যুতে দুপক্ষের একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া অপেক্ষায় আছে, তথাপিও সেটি শুক্র-শনিবারের দুদিনের বিশেষ সফরের চরিত্রের ধারে-কাছেও যায় বলে মনে করার কারণ নেই।

আমরা দেখেছি শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা থেকে বেশ দূরে অবস্থিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন চত্বরে ২৫ কোটি ভারতীয় রুপি ব্যয়ে ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন করা হয়েছে। এর অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ। এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে অবস্থিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদাধিকার বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণও ছিল। দুদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন শেষে যে বক্তৃতা করেছেন তাতে দুদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি, সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতাও একই সুরে অনুরণিত হয়েছিল। তিনি আগ বাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ভবন করার কথাও বলেছেন। এসব বক্তব্য এবং অনুষ্ঠানের পেছনে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অমীমাংসিত অন্যতম প্রধান ইস্যু তিস্তার পানিসহ অন্যান্য নদীর সমস্যার সমাধানে মমতাকে কাছে টানার বিষয়টি থাকা খুবই স্বাভাবিক। তিস্তার জল বণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের চাইতেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আন্তরিকতা অনেক বেশি জরুরি। বিষয়টি অনেক দিন থেকেই আমরা জানি, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও জানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজস্ব হিসাব থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা পূরণে এখনো সমানে সমানে এগুচ্ছেন না। এর আগের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে মমতা কীভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাতো ঢাকা সফরে হঠাৎ মমতার না আসার সিদ্ধান্ত থেকেই আমরা জেনেছি। চুক্তিতে উপনীত হওয়ার অনেক ভালো প্রস্তুতি থাকার পরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীকেই শুধু হতাশ করেননি, বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘদিনের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে দেননি। একই সঙ্গে তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও এ পর্যন্ত আশ্বস্ত করছেন না। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এ মুহূর্তে মোদির বিজেপি-বিরোধী মোর্চা গড়ে ওঠার একটি আলামত দেখা যাচ্ছে। সেই সময়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় দাবার কোন গুটি কীভাবে চাল দেবেন- তা বলা কঠিন। মোদি অবশ্য চাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত বাংলাদেশের নদীর জল সমস্যার অন্যতম তিস্তার জল বণ্টনের বিষয়ে ইতিবাচক একটি অবস্থান গ্রহণ করুক। হতে পারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার কাছাকাছি আসার একটি সুযোগ করে দেয়াও এখানে ক‚টনীতির অন্তর্নিহিত বিষয় থাকতে পারে। শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতীতের সাক্ষাতের চাইতে এবারের সাক্ষাতের বাহ্যিক রূপটি অপেক্ষাকৃত আন্তরিক মনে হয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার একান্ত কথাবার্তায় সেই সম্পর্ক কতটা নিবিড় হয়েছে বা হচ্ছে তা নিকটভবিষ্যতেই হয়তো বোঝা যাবে। যদি সত্যিসত্যিই ভারত-বাংলাদেশের শীর্ষ বৈঠক খুব নিকটভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত হয়, তাতে যদি তিস্তার জল বণ্টনের আলোচ্য সূচি প্রাধান্য পায়, কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় তাহলে বলতে হবে শান্তিনিকেতনে ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিন নেতার উপস্থিত থাকা, বক্তৃতা করা, বৈঠক করা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। ক‚টনীতির জটিল বিষয়গুলো এভাবেই অনেক সময় সমাধান খুঁজে পায়। আমরা আশা করব, শান্তিনিকেতনে তিন নেতার এভাবে একত্রিত হওয়া দৃশ্যত ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধনের হলেও এর অন্তরালে ছিল তিস্তার জল বণ্টনের অমীমাংসিত জটিল সমস্যার সমাধানে পৌঁছানোর উপলক্ষ। বাংলাদেশ ভবনকে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার যেসব ভালো কথা বলেছেন তা হয়তো অচিরেই কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে। সেটি এখন বিশেষভাবে অপেক্ষা করছে নরেন্দ্র মোদির প্রতিশ্রæত বৈঠকের, প্রতিশ্রæত তিস্তার জল বণ্টনের সমাধানের লক্ষে একটি নতুন শীর্ষ বৈঠক শিগগির ঢাকায় অথবা দিল্লিতে অনুষ্ঠিত করা। প্রতিবেশীদের সঙ্গে জটিল সমস্যার সমাধানের উপায় এভাবেই হতে পারে। সম্ভবত শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদি বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক‚টনীতির সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছেন বলে মনে হয়। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়, ধৈর্য ধরতে হয়, সব সমস্যারই রাতারাতি সমাধান হয় না। বিশেষত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বেশকিছু সমস্যা শেখ হাসিনাই ক্ষমতায় আসার পর সমাধান করতে পেরেছেন, সেটি ক‚টনীতির পথেই হয়েছে। গঙ্গার পানি বণ্টন, ছিটমহল সমস্যার মতো জটিল বিষয় কোনো সরকারই ভারতের সঙ্গে ক‚টনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করতে পারেনি। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া অন্য কোনো সরকার ভারতের সঙ্গে সমস্যার সমাধান যথার্থ বা আন্তরিকভাবে চেয়েছিল, নাকি সমস্যা জিইয়ে রেখে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভারতবিরোধী প্রচার-প্রচারণা নিয়ে নির্বাচনে বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল- সেটি মৌলিক প্রশ্ন। আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের বিএনপির মতো বড় দলটি ভারতবিরোধিতার নামে যে ধরনের প্রচার-প্রচারণায় এখনো রয়েছে, তাতে ভারতের সঙ্গে কোনো সমস্যার সমাধানের চাইতে জটিল হওয়ার কূটকৌশলই বেশি ক্রিয়া করে। তাতে আসলে শেষ বিচারে জনগণ ও রাষ্ট্রের কোনো লাভ হয় না, ক্ষতিই বেশি হয়, বৈরী মনোভাব চাঙ্গা থাকে, মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাই কেবল এ ধরনের হিসাব-নিকাশের রাজনীতি করে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিজেদের মর্যাদা অক্ষুণœ রেখে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি করার মাধ্যমে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে। দুদেশ যখন বাংলাদেশ-ভারতের মতো নিকটতম প্রতিবেশী হয় তখন আবেগ আর অপপ্রচারের চাইতে বাস্তবতা ও ক‚টনীতির বিষয়গুলোই মেনে চলতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো সরকারই ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত কোনো সমস্যার সমাধানে বন্ধুত্ব সম্পর্ক নিয়ে অগ্রসর হয়নি। এর জন্য আওয়ামী লীগকে বিএনপিসহ নানা প্রতিক্রিয়াশীল মহলের অনেক গালমন্দ খেতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বিএনপি একদিকে সর্বক্ষেত্রে ভারতবিরোধিতার মনোভাব কথা ও আচরণে দেখাচ্ছে, অন্যদিকে সরকার যখনই ভারতের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনায় বসে, রাষ্ট্রীয় সফরে যাওয়া-আসা করে তখনই নানা রকম জিগির তোলা শুরু করে। ভারতকে বিএনপি ‘কারুরাষ্ট্র’ হিসেবে দেখানোর যে চেষ্টা ও প্রমাণ রাখে তা একুশ শতকের এই সময়ে কতটা গ্রহণযোগ্য সেটি বিবেচ্য বিষয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্দেশ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন তা সবার জানা থাকা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহাসচিব মির্জা আলমগীর, রিজভি আহমেদসহ বিভিন্ন নেতা যে সব কথা মিডিয়ার সম্মুখে বলেছেন তাতে বোঝা গেল যে, তারা তিস্তার ইস্যুতে আবারো মাঠ গরম করতে চাইছেন। বিএনপি তো অনেক বছরই ক্ষমতায় ছিল। যদি প্রশ্ন করা হয়, তারা কেন তখন তিস্তার সমাধান করতে পারলেন না? তিস্তা কেন, অন্য কোনো একটি সমস্যারও কি সমাধান তারা করতে পেরেছিলেন? এখন তো শেখ হাসিনা সে ধরনের কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে পশ্চিমবঙ্গে যাননি। এটি তো হতে পারে পরবর্তী ফলপ্রসূ কোনো সফরের গ্রাউন্ডওয়ার্ক। বিএনপির বক্তব্য যদি হতো তেমন ধাঁচের তাহলে যতবেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যেত, এখন স্পষ্টই মনে হয়েছে বিএনপি বিশেষ এই সফরকে কেন্দ্র করে ভারত ও আওয়ামী লীগবিরোধী বিশেষ অপপ্রচারের একটা মওকা খুঁজেছিল। মনে হয় সেটি করতেও বিএনপি সফল হয়নি। সাধারণ মানুষও বুঝেছে যে, এটি তিস্তা চুক্তির রাষ্ট্রীয় সফর নয়, এমন সফর থেকে চুক্তি পাওয়ার আশা কেউ করে না। বরং এ ধরনের সফরের মাধ্যমেই জটিল সমস্যার সমাধানের বাধা অপসারণ করতে হয়। শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদি হয়তো সেভাবেই এই সফরের আয়োজন করেছিলেন। আমরা অপেক্ষা করব অচিরেই নরেন্দ্র মোদির প্রতিশ্রুত শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, তিস্তার সমস্যার সমাধান হবে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আস্থা ও বন্ধুত্বের ভিত্তির ওপর দিয়েই যেন সম্মুখে অগ্রসর হয়, কোনো প্রকার বৈরী ও শত্রুতার প্রচারণা যেন হালে পানি না পায়।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত