32360
Published on মে 17, 2018১৫ই মে ২০১৮ তারিখে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ভোটারেরা আগামী ৫ বছরের জন্য তাদের নগরপিতা নির্বাচনের জন্য ভোটে অংশগ্রহণ করে। পরদিন আনুষ্ঠানিক ফলাফলে দেখা যায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক ১,৭৪,৮৫১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটবর্তী প্রতিদন্দ্বী বিএনপির মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু পেয়েছেন ১,০৯,২৫১ ভোট। অনিয়মের অভিযোগে ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩টি কেন্দ্রের ভোট বাতিল বলে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। অর্থাৎ তিনটি কেন্দ্রের ৫,৮৩১টি ভোট বাতিল হয় যা মোট ভোটের ১ শতাংশ। নির্বাচনের কমিশনের মতে এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬২.১৯ শতাংশ, যা বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তুলনায় কিছুটা কম।
বিজয়ী প্রার্থী তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে ৬৬,০০০ ভোটে এগিয়ে ছিলেন, যা চোখে পড়ার মতো। খুলনা সিটি কর্পোরেশনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৪,৯৩,০৯৩ জন যার মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৩,০৬,৬৩৬ জন। এর মধ্যে ৬,৫৬৫টি ভোট অনিয়মের অভিযোগে বাতিল করে দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসার। অর্থাৎ ৩,০০,০৭১টি ভোটের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৫৮.২৬ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। বিএনপির মনোনীত প্রার্থী পান মোট গণনাকৃত ভোটের ৩৬.৪ শতাংশ।
দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য এবং অনিয়মের অভিযোগে বাতিল হয়ে যাওয়া ভোট কেন্দ্রের ভোটের এত ক্ষুদ্র সংখ্যা থেকে এটা স্পষ্ট যে কোন ধরনের সমস্যা না হলেও ভোটের ফলাফলে কোন পরিবর্তন আসতো না। নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ‘ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এই তথ্য নিশ্চিৎ করেছে। খুলনার নির্বাচন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যরা বলেন, কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে সমস্যার সৃষ্টি হলেও সেগুলো ছিলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব রাখার মতো যথেষ্ট নয়। (বিস্তারিতঃ https://goo.gl/7kJPJ4)
সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান সত্ত্বেও বিএনপি প্রার্থী ও তার দল ‘ব্যাপক অনিয়ম’ এর অভিযোগ তুলে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের এই দাবীটা মোটেই নতুন কিছু নয়। এর সাথে আছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে পরিকল্পিতভাবে অভিযোগ করা, অস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করা এবং নির্বাচনের ফল অনুযায়ী গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা। এই নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই বিএনপি অভিযোগ করা শুরু করে, দুপুরের পরে তারা বলে ভোট গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা কোন মন্তব্য করবে না, আর যখন তারা বুঝতে পারে যে তাদের প্রার্থী বিপুল ব্যবধানে পিছিয়ে আছে তখন আবার পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে।
মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ থাকলেও, আশ্চর্যজনকভাবে বিএনপি তাদের দলীয় কাউন্সিলরদের বিজয়কে প্রত্যাখ্যান করেনি যা মেয়র নির্বাচনের সাথেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলাফল ঘোষণা হয়েছে এমন ৩৮টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের ১৮ জন কাউন্সিলর এবং বিএনপির ৯ জন কাউন্সিলর জয়লাভ করেছেন। ৩০টি সাধারন ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ১২টি আসন এবং বিএনপি ৯টি আসনে জয়লাভ করে। নারী কাউন্সিলরদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ৬টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে যেখানে বিএনপি একটি আসনও পায়নি। একটি ওয়ার্ডে ভোট বাতিল করা হয় এবং দুইটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ফল বাতিল করা হয়।
বস্তুত, আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের জনপ্রিয়তার কারনে তাঁর বিজয় মোটামুটি প্রত্যাশিতই ছিল। পুর্বে মেয়র থাকাকালীন সময়ে তিনি তাঁর সৎ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। খুলনায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব নিরসন করতে পারাটাও এই বিজয়ে সহায়ক ছিল। ২০১৩ সালে বিএনপি প্রার্থী মঞ্জু’র কাছে তালুকদার খালেকের পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল প্রধান ভুমিকা রেখেছিল বলে ধারনা করা হয়। ১৫ তারিখের নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের প্রচারণাও ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল।
অন্যদিকে, গত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পুরন করতে না পারার কারনে বিএনপি ভোটারদের সমর্থন হারায়। দলীয় অন্তর্কোন্দল এবং দলের সার্বিক অজনপ্রিয়তা মঞ্জু'র পরাজয়ে ভুমিকা রেখেছে। তার নির্বাচনী প্রচারণায় জামাত নেতারা প্রবলভাবে জড়িত থাকার বিষয়টিও ভোটারেরা ভালভাবে নেয়নি। প্রকৃতপক্ষে, মঞ্জু এতটাই অজনপ্রিয় যে তিনি তার নিজের ওয়ার্ডেও জিততে পারেননি। তার ভোটকেন্দ্রে মোট ১,৪২৬টি ভোটের মধ্যে তালুকদার খালেক পেয়েছেন ৫২৯টি আর মঞ্জু পেয়েছেন ৪১০টি ভোট। এমনকি বিএনপিও এই কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা নিয়ে বিভিন্ন জরিপগুলো পর্যবেক্ষন করলে এই ফলাফলকে স্বাভাবিকই মনে হবে। বিভিন্ন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, যেমন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট (আইআরআই) এর সাম্প্রতিক জরিপগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ধারাবাহিকভাবে বেশি। একই ভাবে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার চাইতে অনেক বেশি। আইআরআই এর একতি সাম্প্রতিক ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও দেশের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সাথে নিবিড় সম্পর্ক থাকার কারনে বাংলাদেশের মানুষ বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের দিকেই বেশি ঝুঁকে আছে। (বিস্তারিতঃ https://goo.gl/TPosBS)